হাওরে স্কুল মানেই আতঙ্ক-ঝরে পড়ার কারণ দুর্গমতা, ক্ষুধা by এহসানুল হক ও অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

'শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও, সাহস থাকলে ইশকুলে যাও'। দেশের সাত জেলার বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের লাখো শিক্ষার্থীর দুর্দশার চিত্রটি বোঝার জন্য অভিভাবকদের এই একটি খেদোক্তিই যথেষ্ট। পানির কারণে ছয় মাসে যাতায়াত হয় নৌকানির্ভর। শুষ্ক মৌসুমের ছয় মাসের চিত্রও সুখকর নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দূরে। যোগাযোগব্যবস্থা যাচ্ছেতাই। দীর্ঘ পথ হেঁটে স্কুলে গিয়ে শিশুরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এরপর দুপুরে কিছু খাওয়ার উপায় থাকে না।


এসব কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানদের স্কুলেই দেন না। যাঁরাও বা সাহস করে দেন, তাঁদের সন্তানদের অনেকেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতেই ঝরে পড়ে। যারা থেকে যায়, তারাও পাচ্ছে না যথার্থ শিক্ষা। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে যোগ্য শিক্ষকরা প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে থাকতে চান না। ভ্রমণ ভাতায় পোষায় না বলে শিক্ষা কর্মকর্তাও নিয়মিত স্কুল পরিদর্শনে যান না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনজিওর জরিপ এবং কালের কণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। জানা গেছে, শিশুর বয়স ১৫ বছর হতে না হতেই হাওরাঞ্চলের ৬০ শতাংশ শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে। এরপর তারা আয়-উপার্জনের জন্য ফসল কাটাসহ নানা ধরনের কাজে যোগ দেয়। প্রতিকূল যাতায়াতব্যবস্থা, বিদ্যালয়ে শিক্ষণের দুর্বল মান এবং শেখানোর ক্ষেত্রে যত্নের অভাবকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সমস্যা এমন প্রকট হওয়ার পরও হাওরাঞ্চলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা অবকাঠামো উন্নয়নে আলাদা কোনো প্রকল্প নেই। সারা দেশের জন্য নেওয়া শিক্ষা প্রকল্পের আওতায় যে কাজ হাওরাঞ্চলে হওয়ার কথা, সেগুলোর অগ্রগতিও হতাশাব্যঞ্জক।
হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন না হওয়ায় সম্প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদসহ মহাজোটের শরিক দলের সংসদ সদস্যরা। তবে সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করেননি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু হাওর এলাকার নয়, দেশের সব পশ্চাৎপদ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে এসব অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ শুরু হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য জায়গায় যেখানে একটি স্কুল ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানে হাওরাঞ্চলে দুটি ভবন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি অর্থ বরাদ্দও দেওয়া হচ্ছে সেখানে। এ ছাড়া শিক্ষা বিস্তারের জন্য হাওরাঞ্চলে শিক্ষিকাদের কোটাও শিথিল করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে অল পার্টি পার্লামেন্টারিয়ান গ্রুপ (এপিপিজি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, হাওর উন্নয়ন বোর্ড হলেও সেই বোর্ড তিন বছরে মাত্র একবার বৈঠক করেছে। সময় শেষ হয়ে গেলেও এই বোর্ড কোনো কাজ করেনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী নিজেই হাওর উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। হাওর অঞ্চলের মতো উপকূলীয় অঞ্চলও এখন ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। এ বিষয়গুলো সরকারকে এখনই বিবেচনা করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই সভায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আবদুল জব্বার বলেন, হাওর অঞ্চলের মতো দেশের উপকূলীয় অঞ্চলও এখন ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। সংসদের ভেতরে-বাইরে দাবি জানানোর পরও সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
পাওয়া গেল ভয়াবহ চিত্র : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের (মাধ্যমিক) নেতৃত্বে পরিচালিত এক জরিপ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'গণসাক্ষরতা অভিযান'-এর গবেষণা এবং কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে হাওরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্র। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া_এ সাত জেলার হাওরাঞ্চলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছয় হাজার ৯১টি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এসব জেলার হাওরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা এখনো পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে নৌকাডুবির আশঙ্কায় অভিভাবকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হন। বছরে গড়ে প্রায় ছয় মাসই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া হয় না। যাতায়াতের প্রতিকূল অবস্থায় স্কুলে সন্তানদের না পাঠানোর বিষয়ে এলাকার অনেক মানুষই কালের কণ্ঠকে এক কথায় বলেছেন_'শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও, সাহস থাকলে ইশকুলে যাও'।
১১ সমস্যা : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপে হাওরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার ১১টি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে : ১. হাওর অধ্যুষিত উপজেলাগুলোতে বছরের ছয় মাস বিদ্যালয়ের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। এ কারণে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম থাকে। ২. যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ থাকায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের পক্ষে স্কুলে যাওয়া কঠিন হওয়ায় তারা স্কুলে যায় না। ৩. যাতায়াতব্যবস্থা খারাপ থাকায় শিক্ষার্থীদের পক্ষে দুপুরের খাওয়ার জন্য বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয় না। আবার প্রতিষ্ঠানের আশপাশে আহারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দীর্ঘ সময় অভুক্ত থেকেই ক্লাস করতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান করতে চায় না। ৪. হাওর এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় স্কুলভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ উপকরণ পরিবহনে ব্যায় বেশি। তাই সাধারণ অঞ্চলের সমান বরাদ্দে নির্মাণকাজ করতে ঠিকাদাররা আগ্রহী হন না। ৫. হাওর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে না। ৬. হাওর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যে পরিমাণ ব্যয় হয় সেই অনুপাতে সরকারি ভ্রমণ ভাতা দেওয়া হয় না। ফলে কর্মকর্তারা 'একাডেমিক পরিদর্শনে' উৎসাহ পান না। ৭. পর্যাপ্ত যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় সমতলের কোনো শিক্ষক হাওরে শিক্ষকতা করতে চান না। ৮. প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে হাওর অঞ্চলে শিক্ষার হার কম থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। ফলে বাইরে থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয় এবং এ ধরনের বেশির ভাগ শিক্ষক বিদ্যালয়ে থাকতে চান না। ফলে পদগুলো বেশির ভাগ সময় শূন্য থাকে। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধনপ্রক্রিয়া শুরু করার পর দেখা যায়, হাওর এলাকার তেমন কোনো প্রার্থী শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেন না। তাই বারবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও শিক্ষক পাওয়া যায় না। ৯. মাধ্যমিক পর্যায়ের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক চাঁদা বা ফসলের বিনিময়ে নৌযানের ব্যবস্থা থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্রাবাস বা ছাত্রীনিবাস নেই। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। ১০. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত ও যোগাযোগব্যবস্থা সুবিধাজনক নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানবিহীন গ্রামে প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো উদ্যোক্তা না পাওয়া যাওয়ায় ওই সব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না ১১. হাওরে ফসল কাটার মৌসুমে বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিকের জোগান থাকে না। ফলে এ মৌসুমে শিক্ষার্থীরা স্কুলে না এসে বড়দের সঙ্গে ফসল কাটার কাজ করে।
অগ্রগতি নেই প্রকল্পের : শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাওরাঞ্চলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা অবকাঠামো উন্নয়নে আলাদা কোনো প্রকল্প নেই। সারা দেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে একযোগে প্রকল্প নেওয়া হয়। 'নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন' শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের তিন হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় আনা হয়েছে। এর মধ্যে পড়েছে হাওরাঞ্চলের মাত্র ১৫০টি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এটি ২০১৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। এ ছাড়া 'নির্বাচিত বেসরকারি মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন' নামে আরেকটি প্রকল্পে সারা দেশে এক হাজার মাদ্রাসার উন্নয়ন করা হবে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলের মাত্র ৭৫টি মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে এ প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হলেও ধীরগতিতে চলছে এর কর্যক্রম। ২০১৫ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। আর 'নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন' শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় দেশের এক হাজার ৫০০ কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। এতে স্থান পেয়েছে হাওরাঞ্চলের ৪৪টি কলেজ। তবে হাওরাঞ্চলের কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নকাজে এখনো হাত দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক সিরাজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, হাওরাঞ্চলে শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমানে কোনো প্রকল্প নেই। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে টিকিউআই-২ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলে আলাদাভাবে শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে একটি কারিগরি কমিটি কাজ করছে। সেই কমিটিও হাওরে আলাদাভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করার জন্য কিছু সুপারিশ দেবে। সেই সুপারিশের আলোকে হাওরে শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা এবং 'গণসাক্ষরতা অভিযান'-এর প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সব শিশুকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া। আর এ উদ্দেশ্য সফল করতে প্রয়োজন দুুর্গম হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চল, দেশের প্রত্যন্ত এলাকাসহ অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করা। এসব এলাকার উন্নয়নের জন্য গৃহীত সব পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা জরুরি। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেই হাওরাঞ্চলের শিক্ষর্থীদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হবে। গৃহীত পদক্ষেপগুলো মেয়াদি প্রকল্প হিসেবে না নিয়ে নিয়মিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হিসেবে নেওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে দেখা যায় রাস্তাঘাট বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি আর সহজে মেরামত করা হয় না, দ্বিতীয় প্রকল্পের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘদিন।
সমস্যা নিরসনে ১১ সুপারিশ

No comments

Powered by Blogger.