দয়া বাবুরা সবখানেই আছেন! by মাহবুব মিঠু
একটা কথিত ঘটনা... যেটা সত্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি। বেশিরভাগ প্রচলিত গল্পই কথিত, যেসবের কোন্ও ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। তবে বাস্তব ঘটনাকে সহজ করে বোঝানোর জন্য এর জুড়ি মেলা ভার। সে রকমই গল্প হবে এটা। দয়া বাবু প্রতিদিন তার বউকে পেটাতো। একদিন বউয়ের চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মশাই, দয়া নাম নিয়ে কিভাবে বউকে এমন করে নির্দয়ভাবে পেটাও। সে উত্তরে বলেছিল, ‘আমিতো নামে দয়া, কামেতো না।’ গল্পের কথায় পরে আসি।
এবার একটা বাগধারা নিয়ে কথা চলুক। ‘ধামাচাপা’ কথাটা কে যে চালু করেছিল। ছোটবেলায় বাগধারা মুখস্ত করতে করতে বিরক্ত হয়ে যেতাম। ঘটনা চাপা দেবার সাথে ধামাচাপার মিলটা কোথায় খুঁজে পাইনি। তবে এর অর্থের সাথে আমাদের জাতীয়ভাবে রয়েছে ভীষণ রকম মিল। এই দেখুন না, পারসোনার ঘটনার পরে কেএফসির আলোচিত ঘটনাও শেষ হয়ে যাচ্ছে, মানে ধামাচাপা পড়ে পড়ে ভাব। ফাঁকে আবার আশিয়ান সিটির ঝামেলা এসে গোল বাঁধিয়েছে। এটাও একদিন ধামার নিচে চাপা পড়ে যাবে। আমাদের মতো দেশে সমস্যার এতো পাহাড় যে, একটা শুরু হলে কয়েকদিন উট পাখির মতো মাথা গুঁজে সহ্য করে টিকে থাকতে পারলেই ধামার নিচে ঘটনা পাচার করে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যায়। একটা শেষ না হতেই আরেকটা সমস্যার সুনামি পুরানোটাকে দমিয়ে দেয়। বলতে পারেন এটাও একটা সমাধান।
এমনইতো দেখছি যুগে যুগে। পারসোনার নোংরামির শিকার যারা, ঘটনার প্রকৃতির কারণে কেউ কেউ লজ্জায় চেপে যাবেন, কেউ হয়তো কথিত ২০ লাখ টাকা এবং পারিপার্শ্বিক হুমকিতে দমে যাবে। কেএফসির বিষয়টাও সে রকম! তেলাপোকা খেয়ে দুই চারবার ছোট ঘরে যাতায়াতের ফাঁকে কয়েকটা ট্যাবলেট গিলে ফেললেই হলো। তাছাড়া মনে নেই: অতিকায় ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটলেও ছোট তেলাপোকাগুলো এখনো টিকে আছে! তাই তেলাপোকা খেয়ে কেউ হয়তো দীর্ঘজীবী হলেও হতে পারেন।
তবে কিছু কিছু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে এভাবে পাশ কাটিয়ে চলার কোনও উপায় থাকে না। এইতো গেল তিস্তা চুক্তি নিয়ে একটা বিশাল হুলস্থুল! সেটা কাটতে না কাটতে এখন পত্রিকার পাতা টিপাইমুখ বাঁধের বাঁধভাঙ্গা তুমুল স্রোতে ভেসে যাবার উপক্রম। এতো বড় ধামা পাবে কোথায় যে চাপা দেবে এই ঘটনাগুলো?
টিপাইমুখ নামটা নিরীহ হলেও বাঁধ নির্মাণ হলে যে বিপর্যয়গুলো ঘটবে তা একটা যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। যুদ্ধ যেভাবে একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় তার চেয়েও নির্মম এবং নিষ্ঠুর। প্রকৃতিকে বিগড়ে দিলে সে মানুষসহ পরিবেশকে তিলে তিলে শেষ করে ছাড়ে। বাঙালি জাতি একবার গণহত্যার শিকার হয়েছিল ১৯৭১ সালে। আরেকবার হতে চলেছে এই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে। কিভাবে সেটা? প্রসংগে যাবার আগে গণহত্যার সংজ্ঞায় একটু চোখ বোলানো যাক।
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা মতে, গণহত্যা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে, পরিকল্পনামতো কোনও জাতি অথবা এথনিক গোষ্ঠী অথবা রেসিয়াল কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরিভাবে কিংবা আংশিকভাবে হত্যা করা।
জাতিসংঘের ১৯৪৮সালের প্রণীত সিপিপিসিজি রেজুলেশনের ২৬০(৩) ধারার অনুচ্ছেদ ২ এ বর্ণিত গণহত্যার সংজ্ঞায় শুধু হত্যাকেই প্রাধান্য না দিয়ে আরো কিছু অপরাধকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা হচ্ছে-
- পরিকল্পিতভাবে কোন জাতি, এথনিক/রেসিয়াল গোষ্ঠী অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরিভাবে অথবা আংশিকভাবে হত্যা বা ধ্বংস করা;
- একই উদ্দেশ্যে মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি সাধন;
- এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়;
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা অন্য কোনও উপায়ে এমন বিরূপ পরিবেশ তৈরি করা যাতে তাদের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অথবা;
- শিশুদের অন্যত্র সরিয়ে তাদের জাতিসত্তা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।
আমাদের দেশে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ (২) (সি) ধারায় গণহত্যার সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক গ্রুপকে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনা করা।
জাতিসংঘের সংজ্ঞায় অপরাধের প্রক্রিয়া এবং এর ফলাফল কি হলে তাকে গণহত্যা বলা হবে সেটা পরিষ্কার। প্রক্রিয়াটা হতে হবে ইচ্ছাকৃত, সংঘটিত এবং পরিকল্পনা মাফিক (এবং ফলাফল হচ্ছে) হত্যা অথবা সেই উদ্দেশ্যে শারীরিক অথবা মানসিক ক্ষতি সাধন করা। সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে যে ক্ষতিগুলো হতে পারে তা গণহত্যার মধ্যে পড়ে কিনা আলোচনা করা যেতে পারে।
বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামত পড়ে যা সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় তা হলো, বরাক নদীর উপরে এই বাঁধ নির্মিত হলে সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ কমে গিয়ে বৃহত্তর সিলেট এবং আশপাশ অঞ্চলে ফসল আর আগের মতো ফলবে না। বন্ধ হয়ে যাবে হাওড় অঞ্চলের এক ফসলী ধান। বর্ষায় জলমগ্ন হয়ে পড়বে বিশাল এলাকা। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ২০০৫ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, এর ফলে প্লাবন ভূমির প্লাবনের ধরন, পরিমাণ এবং ঋতুই বদলে যাবে। বাধের ফলে পানি প্রবাহের প্রকৃতি পরিবর্তনের ফলে ঐ অঞ্চলের জনজীবন, মৎস্য সম্পদ, কৃষি সব কিছুর উপরেই বিরূপ প্রবাহ পড়বে।
ভূ বিজ্ঞানীরা বলেন, এর ফলে ঘটে যেতে পারে প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের মতো ঘটনা। বাঁধ নির্মাণের ফলে ভূমিকম্পের ঘটনা প্রথম চোখে পড়ে ১৯৩২ সালে আলজেরিয়ায়। দেশটির কুঢে ফড্ডা বাঁধ নির্মাণের পর এ ঘটনা ঘটে। এ রকম ৭০টিরও বেশি নজির জানা আছে গোটা বিশ্বে।
উপরোক্ত সমূহ ক্ষতির কথা বিবেচনা করলে ভারতকে বন্ধুবেশী আততায়ী বলেই মনে হয়। ধীরে ধীরে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশের অধিবাসীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং দাঁড়াবে। পরিবেশের জন্য যেটা অপূরণীয় ক্ষতি। এবার দয়া করে গণ হত্যার উপরোক্ত সংজ্ঞার ছকে ফেলে দেখুনতো, টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় যে প্রাকৃতিক সুনামিগুলো ঘটার সম্ভাবনা আছে এবং সেই অঞ্চলের জনগণের যে মানসিক বিপর্যয়গুলো ঘটতে যাচ্ছে, তার আলোকে আমরা আরেকটি গণহত্যার শিকার হতে যাচ্ছি কিনা।
এখন প্রশ্ন, ভারত কি পারে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণ করতে? দ্ইু দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক নদী আইনের আওতায় ভারতের কোনওভাবেই এককভাবে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণের আইনগত এক্তিয়ার নেই। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকী নদী ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় যা বলা হয়েছে তা সংক্ষেপ করলে দাড়ায় কোনও রাষ্ট্র্ নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সেখানে কোনও অবকাঠামো নির্মাণের আগে নদী অববাহিকায় অবস্থিত অন্য রাষ্ট্র কোনও ভাবে স্বার্থহানি ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তাদের অবহিত করতে হবে।
ঐ একই সূত্র আসিফ নজরুলের বরাত দিয়ে লিখেছে যে, টিপাইমুখীসহ অভিন্ন নদীতে যে কোন উদ্যোগ গ্রহণের বেলায় ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিটি হচ্ছে বিবেচ্য। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে অভিন্ন নদী বিষয়ক কোন স্বিদ্ধান্ত হতে হবে ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায্যতা এবং কারো ক্ষতি যাতে না হয় সেই নীতির ভিত্তিতে। তিনি ওখানে আরো কিছু চুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন যেগুলো প্রমাণ করে ভারতের এই এক তরফা উদ্যোগ কতোটা আইন বিরুদ্ধ।
ভারত বারবার দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে একটার পর একটা সমস্যা তৈরি করে চললেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুখ ফুটে একবারও বলা হচ্ছে না যে, এগুলো ভারতের করার অধিকার নেই। যখন কোনও সমস্যা দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন এবং বিভিন্ন চুক্তির আলোকে না হবে তখন আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘের কাছে না যাওয়া ছাড়াতো উপায় থাকে না। সেতো দূরের কথা। একবারও ভারতকে এই সব আইন এবং চুক্তির কথা প্রকাশ্যে জোরালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন, সেটাই প্রশ্ন।
ভারতের বিভিন্ন আগ্রাসী পদক্ষেপ বন্ধে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। মনমোহনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষমেষ আতœীয়ের বাড়ীতে বেড়ানো ছাড়া কোনও কাজে দেয়নি। দীপু মণি মমতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও কোনও ফল হোল না। ট্রানজিট, তিস্তা এবং ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক অন্যান্য ইস্যুতে সরকারকে যে পরিমাণে গোপনীয়তা লক্ষ্য করে চলেছে তাতে মনে হয় ঘরের চেয়ে পরই তাদের কাছে বেশি আপন। জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে এ ধরনের গোপনীয়তা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়।
ওদিকে সরকারের দুই উপদেষ্টাকে মনে হয়েছে তারা ভারতের হয়ে বাংলাদেশকে ম্যানেজ করতে এসেছেন।
বড় বড় কয়েকটি কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে এখন প্রয়োজন দলীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে একটা জাতীয় ঐক্যমত গঠন করা। খালেদা জিয়া একটা ভাল কথা বলেছেন। তিনি সরকারকে ভয় না পেয়ে ভারতের এই অন্যায় সিদ্বান্তের প্রতিবাদ জানাতে বলে নিজেরাও সাথে থাকার প্রস্তাব করেছেন। উনি সম্প্রতি মনমোহন বরাবর একটা চিঠিও পাঠিয়েছেন। সেটাকেও সমালোচনা করতে দেখলাম কাউকে কাউকে। সরকার গঠন করলেই কিন্তু দেশটা সেই ক্ষমতাসীন দলের হয়ে যায় না। বিরোধী দলেরও দেশের ভাল মন্দ দেখভালের একটা দায়িত্ব আছে। খালেদা জিয়ার কথায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। এটাইতো রাজনীতির খেলা। শেখ হাসিনার কথায় কি সেটা নেই? খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সরকারের উচিত তাতে সাড়া দেওয়া। যুক্তির ভারে নুইয়ে পড়া কোনও কোনও বিজ্ঞ ব্যক্তি বিরোধী নেত্রীর আহবানে বেশ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেই একই মহলের আস্থা আছে নারায়ণগঞ্জের বিচ্ছিন্ন এবং ভিন্নধর্মী নিরপেক্ষ নির্বাচনকে উদাহরণ টেনে, সন্দেহ মিশ্রিত রাজনৈতিক সম্পর্ক সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক বাতিলকে সমর্থন দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে সমর্থন করা। কাক নাকি সাবান চুরির সময়ে নিজে চোখ বন্ধ করে কর্মটি সারে। সে মনে করে নিজে যেমন দেখছে না, তেমনি বাকিরাও বুঝি অন্ধ। ‘কাক-চালাকী’ করেতো লাভ নেই। জনগণ বেশ ভালই বুঝে তাদের উদ্দেশ্য। তবে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে প্রতি-উত্তরের সময় না দিয়ে হুট করে হরতাল ডেকে বসাটাও সমীচীন হয়নি।
দেশে যখন দেশের স্বার্থ পকেটে রেখে দুই দল ব্যস্ত রোড মার্চ আর জনসভা করায়, ওদিকে, বাংলাদেশের ভাঙ্গা গলার চিৎকার শুনে প্রতিবেশী বলছে, টিপাইমুখী বাঁধ নির্মাণ হবে কিন্তু বাঙলাদেশের কোনও ক্ষতি হবে না। লে ঠ্যালা সামলা! এ যেন ‘গলা কাটিব, তবে এমনভাবে কাটিব যে মরিবে না। ব্যথা পাইবে না, মরিলেও আধমরা হইয়া বাঁচিয়া থাকিবে। কারণ শত হইলেও আমি তোমার বন্ধুতো বটে!’
কি দারুণ বন্ধুত্বের নিদর্শন! মরি! লাজে মরি! এ বন্ধুত্বও দয়া বাবুর মতোই। কামে নাই নামে আছে শুধু।
এমনইতো দেখছি যুগে যুগে। পারসোনার নোংরামির শিকার যারা, ঘটনার প্রকৃতির কারণে কেউ কেউ লজ্জায় চেপে যাবেন, কেউ হয়তো কথিত ২০ লাখ টাকা এবং পারিপার্শ্বিক হুমকিতে দমে যাবে। কেএফসির বিষয়টাও সে রকম! তেলাপোকা খেয়ে দুই চারবার ছোট ঘরে যাতায়াতের ফাঁকে কয়েকটা ট্যাবলেট গিলে ফেললেই হলো। তাছাড়া মনে নেই: অতিকায় ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটলেও ছোট তেলাপোকাগুলো এখনো টিকে আছে! তাই তেলাপোকা খেয়ে কেউ হয়তো দীর্ঘজীবী হলেও হতে পারেন।
তবে কিছু কিছু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে এভাবে পাশ কাটিয়ে চলার কোনও উপায় থাকে না। এইতো গেল তিস্তা চুক্তি নিয়ে একটা বিশাল হুলস্থুল! সেটা কাটতে না কাটতে এখন পত্রিকার পাতা টিপাইমুখ বাঁধের বাঁধভাঙ্গা তুমুল স্রোতে ভেসে যাবার উপক্রম। এতো বড় ধামা পাবে কোথায় যে চাপা দেবে এই ঘটনাগুলো?
টিপাইমুখ নামটা নিরীহ হলেও বাঁধ নির্মাণ হলে যে বিপর্যয়গুলো ঘটবে তা একটা যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। যুদ্ধ যেভাবে একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় তার চেয়েও নির্মম এবং নিষ্ঠুর। প্রকৃতিকে বিগড়ে দিলে সে মানুষসহ পরিবেশকে তিলে তিলে শেষ করে ছাড়ে। বাঙালি জাতি একবার গণহত্যার শিকার হয়েছিল ১৯৭১ সালে। আরেকবার হতে চলেছে এই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে। কিভাবে সেটা? প্রসংগে যাবার আগে গণহত্যার সংজ্ঞায় একটু চোখ বোলানো যাক।
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা মতে, গণহত্যা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে, পরিকল্পনামতো কোনও জাতি অথবা এথনিক গোষ্ঠী অথবা রেসিয়াল কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরিভাবে কিংবা আংশিকভাবে হত্যা করা।
জাতিসংঘের ১৯৪৮সালের প্রণীত সিপিপিসিজি রেজুলেশনের ২৬০(৩) ধারার অনুচ্ছেদ ২ এ বর্ণিত গণহত্যার সংজ্ঞায় শুধু হত্যাকেই প্রাধান্য না দিয়ে আরো কিছু অপরাধকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা হচ্ছে-
- পরিকল্পিতভাবে কোন জাতি, এথনিক/রেসিয়াল গোষ্ঠী অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরিভাবে অথবা আংশিকভাবে হত্যা বা ধ্বংস করা;
- একই উদ্দেশ্যে মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি সাধন;
- এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়;
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা অন্য কোনও উপায়ে এমন বিরূপ পরিবেশ তৈরি করা যাতে তাদের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অথবা;
- শিশুদের অন্যত্র সরিয়ে তাদের জাতিসত্তা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।
আমাদের দেশে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ (২) (সি) ধারায় গণহত্যার সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক গ্রুপকে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনা করা।
জাতিসংঘের সংজ্ঞায় অপরাধের প্রক্রিয়া এবং এর ফলাফল কি হলে তাকে গণহত্যা বলা হবে সেটা পরিষ্কার। প্রক্রিয়াটা হতে হবে ইচ্ছাকৃত, সংঘটিত এবং পরিকল্পনা মাফিক (এবং ফলাফল হচ্ছে) হত্যা অথবা সেই উদ্দেশ্যে শারীরিক অথবা মানসিক ক্ষতি সাধন করা। সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে যে ক্ষতিগুলো হতে পারে তা গণহত্যার মধ্যে পড়ে কিনা আলোচনা করা যেতে পারে।
বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামত পড়ে যা সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় তা হলো, বরাক নদীর উপরে এই বাঁধ নির্মিত হলে সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ কমে গিয়ে বৃহত্তর সিলেট এবং আশপাশ অঞ্চলে ফসল আর আগের মতো ফলবে না। বন্ধ হয়ে যাবে হাওড় অঞ্চলের এক ফসলী ধান। বর্ষায় জলমগ্ন হয়ে পড়বে বিশাল এলাকা। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ২০০৫ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, এর ফলে প্লাবন ভূমির প্লাবনের ধরন, পরিমাণ এবং ঋতুই বদলে যাবে। বাধের ফলে পানি প্রবাহের প্রকৃতি পরিবর্তনের ফলে ঐ অঞ্চলের জনজীবন, মৎস্য সম্পদ, কৃষি সব কিছুর উপরেই বিরূপ প্রবাহ পড়বে।
ভূ বিজ্ঞানীরা বলেন, এর ফলে ঘটে যেতে পারে প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের মতো ঘটনা। বাঁধ নির্মাণের ফলে ভূমিকম্পের ঘটনা প্রথম চোখে পড়ে ১৯৩২ সালে আলজেরিয়ায়। দেশটির কুঢে ফড্ডা বাঁধ নির্মাণের পর এ ঘটনা ঘটে। এ রকম ৭০টিরও বেশি নজির জানা আছে গোটা বিশ্বে।
উপরোক্ত সমূহ ক্ষতির কথা বিবেচনা করলে ভারতকে বন্ধুবেশী আততায়ী বলেই মনে হয়। ধীরে ধীরে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশের অধিবাসীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং দাঁড়াবে। পরিবেশের জন্য যেটা অপূরণীয় ক্ষতি। এবার দয়া করে গণ হত্যার উপরোক্ত সংজ্ঞার ছকে ফেলে দেখুনতো, টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় যে প্রাকৃতিক সুনামিগুলো ঘটার সম্ভাবনা আছে এবং সেই অঞ্চলের জনগণের যে মানসিক বিপর্যয়গুলো ঘটতে যাচ্ছে, তার আলোকে আমরা আরেকটি গণহত্যার শিকার হতে যাচ্ছি কিনা।
এখন প্রশ্ন, ভারত কি পারে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণ করতে? দ্ইু দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক নদী আইনের আওতায় ভারতের কোনওভাবেই এককভাবে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণের আইনগত এক্তিয়ার নেই। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকী নদী ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় যা বলা হয়েছে তা সংক্ষেপ করলে দাড়ায় কোনও রাষ্ট্র্ নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সেখানে কোনও অবকাঠামো নির্মাণের আগে নদী অববাহিকায় অবস্থিত অন্য রাষ্ট্র কোনও ভাবে স্বার্থহানি ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তাদের অবহিত করতে হবে।
ঐ একই সূত্র আসিফ নজরুলের বরাত দিয়ে লিখেছে যে, টিপাইমুখীসহ অভিন্ন নদীতে যে কোন উদ্যোগ গ্রহণের বেলায় ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিটি হচ্ছে বিবেচ্য। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে অভিন্ন নদী বিষয়ক কোন স্বিদ্ধান্ত হতে হবে ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায্যতা এবং কারো ক্ষতি যাতে না হয় সেই নীতির ভিত্তিতে। তিনি ওখানে আরো কিছু চুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন যেগুলো প্রমাণ করে ভারতের এই এক তরফা উদ্যোগ কতোটা আইন বিরুদ্ধ।
ভারত বারবার দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে একটার পর একটা সমস্যা তৈরি করে চললেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুখ ফুটে একবারও বলা হচ্ছে না যে, এগুলো ভারতের করার অধিকার নেই। যখন কোনও সমস্যা দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন এবং বিভিন্ন চুক্তির আলোকে না হবে তখন আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘের কাছে না যাওয়া ছাড়াতো উপায় থাকে না। সেতো দূরের কথা। একবারও ভারতকে এই সব আইন এবং চুক্তির কথা প্রকাশ্যে জোরালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন, সেটাই প্রশ্ন।
ভারতের বিভিন্ন আগ্রাসী পদক্ষেপ বন্ধে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। মনমোহনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষমেষ আতœীয়ের বাড়ীতে বেড়ানো ছাড়া কোনও কাজে দেয়নি। দীপু মণি মমতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও কোনও ফল হোল না। ট্রানজিট, তিস্তা এবং ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক অন্যান্য ইস্যুতে সরকারকে যে পরিমাণে গোপনীয়তা লক্ষ্য করে চলেছে তাতে মনে হয় ঘরের চেয়ে পরই তাদের কাছে বেশি আপন। জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে এ ধরনের গোপনীয়তা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়।
ওদিকে সরকারের দুই উপদেষ্টাকে মনে হয়েছে তারা ভারতের হয়ে বাংলাদেশকে ম্যানেজ করতে এসেছেন।
বড় বড় কয়েকটি কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে এখন প্রয়োজন দলীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে একটা জাতীয় ঐক্যমত গঠন করা। খালেদা জিয়া একটা ভাল কথা বলেছেন। তিনি সরকারকে ভয় না পেয়ে ভারতের এই অন্যায় সিদ্বান্তের প্রতিবাদ জানাতে বলে নিজেরাও সাথে থাকার প্রস্তাব করেছেন। উনি সম্প্রতি মনমোহন বরাবর একটা চিঠিও পাঠিয়েছেন। সেটাকেও সমালোচনা করতে দেখলাম কাউকে কাউকে। সরকার গঠন করলেই কিন্তু দেশটা সেই ক্ষমতাসীন দলের হয়ে যায় না। বিরোধী দলেরও দেশের ভাল মন্দ দেখভালের একটা দায়িত্ব আছে। খালেদা জিয়ার কথায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। এটাইতো রাজনীতির খেলা। শেখ হাসিনার কথায় কি সেটা নেই? খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সরকারের উচিত তাতে সাড়া দেওয়া। যুক্তির ভারে নুইয়ে পড়া কোনও কোনও বিজ্ঞ ব্যক্তি বিরোধী নেত্রীর আহবানে বেশ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেই একই মহলের আস্থা আছে নারায়ণগঞ্জের বিচ্ছিন্ন এবং ভিন্নধর্মী নিরপেক্ষ নির্বাচনকে উদাহরণ টেনে, সন্দেহ মিশ্রিত রাজনৈতিক সম্পর্ক সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক বাতিলকে সমর্থন দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে সমর্থন করা। কাক নাকি সাবান চুরির সময়ে নিজে চোখ বন্ধ করে কর্মটি সারে। সে মনে করে নিজে যেমন দেখছে না, তেমনি বাকিরাও বুঝি অন্ধ। ‘কাক-চালাকী’ করেতো লাভ নেই। জনগণ বেশ ভালই বুঝে তাদের উদ্দেশ্য। তবে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে প্রতি-উত্তরের সময় না দিয়ে হুট করে হরতাল ডেকে বসাটাও সমীচীন হয়নি।
দেশে যখন দেশের স্বার্থ পকেটে রেখে দুই দল ব্যস্ত রোড মার্চ আর জনসভা করায়, ওদিকে, বাংলাদেশের ভাঙ্গা গলার চিৎকার শুনে প্রতিবেশী বলছে, টিপাইমুখী বাঁধ নির্মাণ হবে কিন্তু বাঙলাদেশের কোনও ক্ষতি হবে না। লে ঠ্যালা সামলা! এ যেন ‘গলা কাটিব, তবে এমনভাবে কাটিব যে মরিবে না। ব্যথা পাইবে না, মরিলেও আধমরা হইয়া বাঁচিয়া থাকিবে। কারণ শত হইলেও আমি তোমার বন্ধুতো বটে!’
কি দারুণ বন্ধুত্বের নিদর্শন! মরি! লাজে মরি! এ বন্ধুত্বও দয়া বাবুর মতোই। কামে নাই নামে আছে শুধু।
No comments