পৃথিবীর সন্ধানে কেপলার by আসিফ

ম্প্রতি নাসা কেপলার নামের নতুন একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। ঐতিহাসিক এই অভিযানের মধ্য দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে পৃথিবীর মতো গ্রহের সন্ধান করবে কেপলার। ১৭ শতকের জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহান কেপলারের নামানুসারে গ্রহানুসন্ধানী নভোযানটির নামকরণ করা হয়েছে। পৃথিবীর মতো বসবাস উপযোগী নতুন গ্রহের সন্ধানে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই অভিযান কমপক্ষে সাড়ে তিন বছর চলবে।


কেপলার প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী বিল বোরুকি এ প্রসঙ্গে জানান, তাদের লক্ষ্য পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ খুঁজে বের করা। যেখানে পানির উপস্থিতি থাকবে। তাহলেই বোঝা যাবে পৃথিবীর বাইরেও জীবনধারণের মতো অনেক জায়গা আছে। আর তা যদি না পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে পৃথিবী একটা ব্যতিক্রমী গ্রহ। সৌরজগৎ ছেড়ে কেপলার ৬০০ থেকে ৩ হাজার আলোকবর্ষ দূরে চলে যাবে। সেখানে সিগনাস ও লিরা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে বিরামহীনভাবে প্রায় ১০ লাখ গ্রহে অনুসন্ধান চালাবে।
বিজ্ঞানী কেপলার থেকে মহাকাশযান কেপলার
ভূকেন্দ্রিকতা থেকে সৌরকেন্দ্রিক ধারণায় যাওয়া ছিল এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের পথ, যার মধ্য দিয়ে পৃথিবী যাচ্ছিল। এই দ্বন্দ্ব ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে চূড়ান্ত সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। এ রকম একটি সময়ে জন্ম জোহানস কেপলারের। যিনি টলেমির মতো জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিদ উভয় সত্তাই ধারণ করতেন। এটা এমন এক সময় ছিল যখন মানবীয় উদ্দীপনা ছিল মানসিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ। যখন বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোর চেয়ে দুই হাজার বছর আগের গির্জার মতকে অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করা হতো। ঈশ্বরের মহিমাকীর্তন থেকে সামান্য বিচ্যুতিও মৃত্যুর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হতো। কেপলার নামের এই মানুষটির সাহস এবং নিঃসঙ্গ সংগ্রাম আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের দীপশিখাকে প্রজ্বলিত করেছিল।
জোহানস কেপলারের জন্ম জার্মানিতে ১৫৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বালক বয়সে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য মলব্রনের প্রাদেশিক শহরে প্রোটেস্ট্যান্ট সেমিনারি স্কুলে পাঠানো হয়। এটা এমন প্রকৃতির শিক্ষাআশ্রম, যেখানে রোমান ক্যাথলিজমের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়া হতো। কেপলার ছিলেন দৃঢ় একগুঁয়ে, বুদ্ধিমান এবং ভীষণ স্বাধীনচেতা। দুই বছর নিরানন্দে মলব্রনে কাটালেন তিনি, পরিণত হলেন গুটিয়ে নেওয়া স্বভাবের মানুষে।
১৫৮৯ সালে টুবিনগেনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে তিনি মলব্রন ত্যাগ করেন। ওই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবাহের মুখোমুখি হলেন, কোপার্নিকাসীয় প্রকল্পের বিপজ্জনক রহস্যগুলো। কেপলারের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্ব মিলে গিয়েছিল, তাই তিনি একে জড়িয়ে ধরলেন আবেগে। সূর্য হলো একটি ঈশ্বরের রূপক, যার চারদিকে সবকিছু আবর্তনশীল। কেপলার কীভাবে গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘোরে তার সূত্র আবিষ্কারে সামর্থ্য হন, তিনটি সূত্রের মাধ্যমে।
জোহানস কেপলার বিশ্বাস করতেন যে, একদিন আসবে 'নভোলোকের হাওয়ায় মহাজাগতিক জাহাজে অভিযাত্রী নিয়ে আকাশপথের সন্ধানে ছুটবে, কিন্তু মহাকাশের বিশালতা দেখে তারা আতঙ্কিত হবে না'। আজ সেই সব অভিযাত্রীরা মহাশূন্যের বিশালতার মধ্য দিয়ে তাদের অব্যর্থ অনুসন্ধান পরিচালনা করে গ্রহগতির তিনটি সূত্র প্রয়োগে যা কেপলার উন্মোচন করেছিলেন তার জীবনব্যাপী কঠোর পরিশ্রমে। গ্রহের গতিবিধি বুঝতে, জোহানস কেপলারের জীবনব্যাপী অনুসন্ধান তার মৃত্যুর ছত্রিশ বছর পরে আইজ্যাক নিউটনের কাজের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে।
ফ্লোরিডার কোকা সমুদ্র উপকূল থেকে উৎক্ষিপ্ত গ্রহানুসন্ধানী নভোযান কেপলার তার যাত্রা শুরু করেছে। পরিষ্কার রাতে আলোর ঝড় তুলে সে এগিয়ে যাচ্ছে অজানার পথে। যদি কখনও কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী আছে এমন গ্রহের সন্ধান পায়, তাহলে তাদের কী বলবে? হয়তো মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের সর্পিল পথের কথা বা পৃথিবীর প্রথম জ্যোতির্বিদ এবং শেষ জ্যোতিষী কেপলারের কষ্টকর জীবনের কথাই জানাবে। পৃথিবীর দিকে ইঙ্গিত করে বলবে ওই হলো পৃথিবী, নীলাভসাদা।

No comments

Powered by Blogger.