সমকালীন প্রসঙ্গ-ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্য, নিম্নমুখী মজুরি by বদরুদ্দীন উমর

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এখন সারা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এক বড় সমস্যা। তবে এই সমস্যার তীব্রতা সব দেশে একই রকম নয়। তীব্রতার কমবেশি হয় তখনই যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আয় তাল রাখতে পারে না, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি হয় আয়ের বৃদ্ধি থেকে দ্রুততর এবং অধিক। এদিক দিয়ে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যকে শুধু তীব্র সমস্যা বললেই হয় না। এখানে দ্রব্যমূল্য এক চরম সংকট। এর কারণ দ্রব্যমূল্য এখানে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকলেও শারীরিক শ্রমজীবী থেকে নিয়ে মধ্যবিত্ত
শ্রমজীবীদের আয়ের কোনো বৃদ্ধি নেই। এমন কোনো নীতি এখানে নেই যাতে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির কোনো ব্যবস্থা হতে পারে। কাজেই একদিকে স্থির আয় এবং অন্যদিকে অস্থির মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে পড়ে জনগণের জীবন দুর্বিষহ ও বিপন্ন হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যে শুধু এই মুহূর্তে দুনিয়ার এক সাধারণ সমস্যা তাই নয়। এ সমস্যা অতীতেও যুগে যুগে দেখা গেছে। কথিত আছে, শায়েস্তা খানের সময় বাংলায় এক টাকায় পাওয়া যেত আট মণ চাল। কিন্তু তখনও এমন লোকের অভব ছিল না যারা অনাহারে-অর্ধাহারে থাকত। কারণ জিনিসপত্রের দাম যেমন কম ছিল, তেমনি মানুষের আয়ও ছিল কম। তখন সৈন্য থেকে নিয়ে অন্য নিম্ন কর্মচারীদের বেতনও হতো মাসে আট-দশ আনা! তখন আবার ছিল কড়ির প্রচলন। সাধারণ অনেক বেচাকেনা চলত কড়ি দিয়ে। কড়ির চলন বাংলাদেশে আঠারো উনিশ শতক পর্যন্ত ছিল।
অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের আয়েরও বৃদ্ধি হয়। তবে মূল্যবৃদ্ধির হার আয় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির চাপ প্রাক্-পুঁজিবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জনগণের ওপর থাকে। শুধু তাই নয়, এই চাপ অনেক ক্ষেত্রেই বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের জনগণ, কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্তরা, এখন এক অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চাপের মধ্যে অস্থির জীবনযাপন করছেন। আগে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের সময় শাকপাতা খেয়ে জীবনধারণের কথা বলা হতো। এখন শাকপাতা খাওয়াও অনেকের পক্ষে অসম্ভব। শাকপাতা যখন কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা বিক্রি হয়, তখন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অথচ এই বাংলাদেশেও কিছুদিন আগে এই অবস্থা ছিল চিন্তার বাইরে। বিশ শতকের ষাটের দশকেও চালের দাম ছিল সেরপ্রতি দশ-বারো আনা, সরষের তেল চার টাকা, ঘি দশ টাকা, চিনি এক-দেড় টাকা, গরুর গোশত দেড় টাকা ইত্যাদি। ইলিশ মাছ পাওয়া যেত দুই-তিন টাকায়।
এটা এক সাধারণ নিয়ম যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সাধারণ অল্প আয়ের মানুষের ওপরই বেশি পড়ে। তারাই এর দ্বারা বিপর্যস্ত হন। যাদের আয় মাসে ৫০ হাজার, লাখ লাখ টাকা তাদের কাছে চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকা হলে অসুবিধা নেই। নানা রকম শাকসবজি ৪০-৫০-৬০ টাকা কেজি হলেও তাদের কিছু যায়-আসে না। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এ রকম হলে মাসে ৩-৪-৫ হাজার টাকা আয়ের লোকদের সপরিবারে নুন-ভাত খেয়ে থাকতে হয়। আগে মানুষ তরকারি ছাড়া ভাত খেলেও সেটা খেত নুন-মরিচ দিয়ে। এখন মরিচের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত! এ অবস্থায় গরিব মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকলেও তাদের দেহের পুষ্টির অবস্থা কী এটা বোঝা কঠিন নয়। এই অসুবিধার কারণে বাংলাদেশে মানুষ এখন নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুমৃত্যু, প্রসূতি মৃত্যুর হারও যথেষ্ট বেশি।
দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে হাজার হাজার লোক খাদ্যাভাবে মারা যায়। কিন্তু দুর্ভিক্ষের অবস্থা না থাকলেও খাদ্যের অভাব থাকলে মানুষ সেভাবে মারা না গেলেও অপুষ্টির কারণে তাদের দেহে নানা রোগ দেখা দেয়, তারা দুর্বল হতে থাকে এবং তিলে তিলে তাদের মৃত্যু হয়। শারীরিক শ্রমজীবীদের পক্ষে অপুষ্টি শুধু যে তাদের নিজেদের জীবনকেই বিপর্যস্ত করে তাই নয়। এর দ্বারা উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত হয়। এ জন্য মালিকরাও বলে শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরির কথা। কিন্তু শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার তো কথাই নেই, শরীর রক্ষার মতো মজুরিও এখন তাদের দেওয়া হয় না। মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করলে তারা যেটুকু মজুরি বৃদ্ধি করে, তার থেকে বেশি বৃদ্ধি হয় দ্রব্যমূল্য। কাজেই এই বৃদ্ধি দ্বারা তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিক, পাট শ্রমিক, সুতাকল, চিনিকল শ্রমিকরাসহ সব ধরনের শ্রমিক উৎপাদনের জন্য যে শ্রমশক্তি প্রদান করে, সেটা দেখলে অবাক হতে হয়। শ্রমিকদের এই সাধ্যাতীত শ্রমশক্তির জোরে মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে কিন্তু তারা এতই অকৃতজ্ঞ যে, এর জন্য তারা শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিছুই করে না। উপরন্তু মজুরি বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবি এবং তার জন্য আন্দোলন করলে তারা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ঠিকমতো শ্রম না দেওয়া থেকে নিয়ে সন্ত্রাসের অভিযোগ পর্যন্ত করতে দ্বিধা বা অসুবিধা বোধ করে না।
বাংলাদেশে এখন যেভাবে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে বিভিন্ন কলকারখানা এবং অফিসে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি ও বেতন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বৃদ্ধি করা দরকার। শুধু একবার বৃদ্ধি করেই শেষ করা নয়। এমন মজুরি ও বেতন নীতিনির্ধারণ করা দরকার, যাতে নিয়মিতভাবে পরিস্থিতি রিভিউ বা পর্যালোচনা করে এক বছর অন্তর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে, তার সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে মজুরি ও বেতন বৃদ্ধি করা যায়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে জিনিসপত্রের নিয়মিত মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে এভাবেই শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা আছে। পুঁজিবাদের বিশ্বজোড়া সংকটের কারণে অনেক উন্নত দেশে এখন মজুরি বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার জন্য শ্রমিক বিক্ষোভ, শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষ ও সরকারের সংঘর্ষ হচ্ছে; কিন্তু তবু সাধারণভাবে এসব দেশে এ নিয়ম স্বীকৃত। আমাদের দেশেও ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির মুখে এ ধরনের নীতিনির্ধারণের প্রয়োজন জরুরি হলেও সরকার ও মালিক পক্ষের কোনো চিন্তাভাবনা এ ব্যাপারে তো নেই-ই, এমনকি শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও এ ধরনের দাবি মালিক পক্ষ ও সরকারের কাছে করা হয় না। তারা মাঝে মধ্যে শুধু মজুরি বৃদ্ধির দাবি ও সেই দাবির ভিত্তিতে কিছু কিছু আন্দোলন করা ছাড়া আর কিছুই করেন না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার একটি পরিচিত ও পরীক্ষিত উপায় হচ্ছে রেশনিং ব্যবস্থা চালু রাখা। বাজার অর্থনীতিতে জিনিসপত্রের মূল্য চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর তো করেই; উপরন্তু নানা রকম ফন্দি-ফিকির করে বেশি মুনাফার জন্য জিনিসপত্রের দাম কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি করা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস রেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করলে এসব জিনিসের মূল্য অবাধে ও বেপরোয়াভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তানি আমলের গোড়ার দিকেও চাল, ডাল, তেলসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস শুধু শহর এলাকাতেই নয়, গ্রামেও রেশনে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এ ছাড়া রেশনের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল অনেক শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের জন্য। বাংলাদেশে এখন এই রেশন ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু অস্তিত্ব না থাকলেও চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি রেশনে দেওয়ার ব্যবস্থা ছাড়া অবাধ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মুখে মানুষের জীবনধারণ করাই হয়ে দঁড়াচ্ছে এক অসম্ভব ব্যাপার। এই পরিস্থিতিতে কারখানার শ্রমিকদের জন্য রেশন ব্যবস্থা এখন অপরিহার্য হয়েছে। তাদের যে মজুরি দেওয়া হয় তা দীর্ঘদিন পর সামান্য বৃদ্ধি হলেও তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। তবে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, কাপড় ইত্যাদি রেশনে দেওয়ার ব্যবস্থা হলে এই পরিস্থিতি অনেকখানি সহনীয় হওয়ার সম্ভাবনা। শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা কোনো নতুন বা অভিনব ব্যাপার নয়। এ ব্যবস্থা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলেও বিভিন্ন কলকারখানায় মজুরদের জন্য ছিল। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রেশন ব্যবস্থা শ্রমিকদের শ্রম দেওয়ার ক্ষমতা বজায় রাখা এবং উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য হয়েছে। এ কাজ নিজে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের কোনো সরকারেরই করার মতো চিন্তাভাবনা ও ইচ্ছা নেই। এ ব্যবস্থা আন্দোলনের দ্বারাই প্রবর্তন করতে হবে এবং এর জন্য বিভিন্ন শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রমজীবীদের সংগঠন, শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠনসহ অন্যদের এগিয়ে আসতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত এবং অবাধ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মুখে রেশনিং চালু করার বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকলে সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ও সেই সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থাকে চরম সংকট, এমনকি বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
৩১.১০.২০১১

No comments

Powered by Blogger.