ওয়াসার পানি-একটু ব্যয় বাড়ালেই নিয়মিত সরবরাহ by গোলাম মোস্তফা

ঢাকা ওয়াসাকে অবশ্যই বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে।আর তা হলো নিজস্ব সম্পদ আহরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিদেশি দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমানো। আর তা করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন বাণিজ্যিকভাবে লাভবান সংস্থা হিসেবে ঢাকা ওয়াসাকে


দাঁড় করানো ঢাকা ওয়াসা বোর্ড ঢাকায় পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে এবং তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়। তবে একাধিক পত্রিকায় প্রস্তাবিত এ মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করে ওয়াসাকে তার সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানির চাহিদা অনুপাতে সরবরাহের পরিমাণ ও গুণগত মান নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মহানগরীর পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা। মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে খোলামেলা আলোচনায় উঠে আসে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ সেবা নিশ্চিত করতে ঢাকা ওয়াসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ তা বাস্তবায়নে নানা সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের উপায়।
গোলটেবিল বৈঠকে যে বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো_ ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বর্তমান ও ভবিষ্যতে চাহিদা অনুযায়ী বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ঢাকা ওয়াসার করণীয় নির্ধারণ। বর্তমানে লোডশেডিং না থাকলে (যেমন শীতকালে) ঢাকা ওয়াসা ২২০ কোটি লিটার দৈনিক চাহিদার প্রায় পুরোটাই উৎপাদন করতে পারে। বিদ্যুৎ বিষয়ে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হলে আগামী ২০১২ সালের মধ্যেই লোডশেডিং থেকে ঢাকাবাসী মুক্ত হবে; কিন্তু তখন সমস্যা দেখা দেবে ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতা নিয়ে। আর তা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা ওয়াসার প্রয়োজন ভূউপরিস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করা। বর্তমানে সরবরাহকৃত পানির গুণগত মান সম্পর্কে যেসব অভিযোগ আছে তা থেকেও ২০১২ সালের মধ্যে বহুলাংশে মুক্ত হওয়া যাবে সায়েদাবাদ দ্বিতীয় ফেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বর্তমানে চালু ঢাকা ওয়াটার সাপল্গাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অধীনে ২৫০০ কিমি পুরনো পাইপলাইন পরিবর্তন কাজ সমাপ্ত হলে। সে ক্ষেত্রে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে ঢাকা ওয়াসার প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে পরিকল্পিত পাগলা ও খিলক্ষেতে যথাক্রমে ৪৫ কোটি ও ৫০ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাগলায় শোধনের জন্য পানি আসবে পদ্মা নদী থেকে আর খিলক্ষেতে আসবে মেঘনা থেকে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে বর্তমান বাজারমূল্যেই খরচ পড়বে কমপক্ষে ৭৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসার বিবেচনায় রয়েছে সায়েদাবাদ ফেজ-৩ প্রকল্প, যার উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার। এ প্রকল্প বাস্তবায়নেও খরচ পড়বে আরও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে ঢাকাবাসীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে প্রয়োজন হবে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। প্রশ্ন হলো_ এ বিশাল বিনিয়োগের অর্থ আসবে কোথা থেকে? ঢাকা ওয়াসার বর্তমান আর্থিক অবস্থায় নিজের পক্ষে কোনো বিনিয়োগই সম্ভব নয়। সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয় এ বিশাল অঙ্কের অর্থ ঢাকা ওয়াসাকে ঋণ বা অনুদান হিসেবে দেওয়া। শেষ উপায় থাকে দাতা সংস্থার কাছে ধরনা দেওয়া। সরকার ও ঢাকা ওয়াসা বর্তমানে সে কাজটিই করছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে কথা চলছে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অর্থ জোগানের।
তবে ঢাকা ওয়াসাকে অবশ্যই বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। আর তা হলো নিজস্ব সম্পদ আহরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিদেশি দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমানো। আর তা করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন বাণিজ্যিকভাবে লাভবান সংস্থা হিসেবে ঢাকা ওয়াসাকে দাঁড় করানো। এ কাজটি করতে গেলে প্রয়োজন একদিকে যেমন দুর্নীতি, অপচয়, অব্যবস্থাপনা রোধ করে সিস্টেম লস সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা, অন্যদিকে পানির উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করা। ঢাকা ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরবরাহকৃত প্রতি হাজার লিটার পানির গড় উৎপাদন খরচ প্রায় ৯.৭৫ টাকা, আর এই পানিই ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের কাছে পেঁৗছে দেয় ৬.৩৪ (ভ্যাট ছাড়া) টাকা, তাহলে বাকি ৩.৪১ টাকা আসে কোথা থেকে? আসলে এ টাকাও আসে সরকার থেকে অর্থাৎ দেশের মানুষের প্রদত্ত ট্যাক্স থেকে। তাহলে ঢাকা ওয়াসাকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে এ টাকা সরাসরি ঢাকার পানির গ্রাহকদের কাছ থেকে নিতে দোষ কোথায়? সত্য বলতে কি, আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এটাই নিয়ম। তাই ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মূল্য বাড়ানো দরকার। তবে তা একবারে নয়, ধাপে ধাপে। ওয়াসা এখন এই কাজটিই করার উদ্যোগ নিয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি হাজার লিটার পানির মূল্য একবারে ৯.৭৫ টাকা করলেও ৬ সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খরচ বাড়ে ১১৩ টাকা (ভ্যাটসহ)। অর্ধেক অর্ধেক করে দু'বারে মূল্য বৃদ্ধি করলে প্রতিবারে মাসে খরচ বাড়বে মাত্র ৫৬.৫০ টাকা। একটি পরিবারের জন্য এ বৃদ্ধি বড় কিছু নয়। অথচ বাসায় একদিন পানি না থাকাটা অনেক বেশি কষ্টদায়ক। একটি পরিবার যদি প্রতি মাসে পানি বাবদ ১১৩ টাকার বেশি খরচ করে তাহলে যা ঘটবে তা হলো_
সরকার বা দাতা সংস্থার দিকে ওয়াসাকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে না। অর্থাৎ ঢাকাবাসীর চাহিদা পূরণে ওয়াসা নিজেই নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করবে।
ঢাকা ওয়াসা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
ঢাকাবাসীর সারা বছরের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা ঢাকা ওয়াসা পূরণ করতে পারবে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে যে ময়লা বা দুর্গন্ধযুক্ত পানির অভিযোগ পাওয়া যায়, তা থেকে ঢাকাবাসী নিষ্কৃতি পাবে।

ড. প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা : চেয়ারম্যান
ঢাকা ওয়াসা বোর্ড
 

No comments

Powered by Blogger.