কূটনীতি-বিদেশ নীতিতে নতুন ধারা চাই by ইমতিয়াজ আহমেদ
আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা ব্যাপক। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্নে আমরা অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের চেয়ে বরং অনেক এগিয়ে থাকছি। বাঙালি সংস্কৃতিতে হানাফি, সুফি, বক্তি ও বাউল ঐতিহ্য অবদান রেখে চলেছে।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমানসহ অনেকে আমাদের সাহিত্য জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি প্রসারে তাদের অবদান কাজে লাগানো সম্ভব। আর এটা শুধু দেশে নয়, আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরেও এটা করা সম্ভব
চার দশক আগে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরুর পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম পর্বকে আমরা বলতে পারি 'স্বীকৃতির জন্য কূটনীতি'। একাত্তরের ডিসেম্বরেই আমরা ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ছিল প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং তা পরিচালিত হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, এ কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে অনিচ্ছুক ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে ছিল। তাদের এ অবস্থানে পরিবর্তন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে মেনে নিতে রাজি করানো ছিল সে সময়ে প্রধান কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আর এটা মনে রাখতে হবে যে, সময়টি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনায় পূর্ণ। দুই শিবিরের পক্ষ থেকেই বলা হতো, 'যদি তুমি আমার পক্ষে না থাকো, তা হলে অবশ্যই তুমি আমার প্রতিপক্ষের শিবিরে।' বাংলাদেশের জন্য সেটা ছিল প্রকৃতই কঠিন সময়। পশ্চিমা ধনী দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে ছিল, কিন্তু তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
এ সময়েই অভিজাত ব্যবসায়ী মহল, আমলাতন্ত্র ও বুদ্ধিজীবীদের অনেককে আমরা সক্রিয় দেখতে পাই। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের চেনাজানা ছিল এবং তা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি আসে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে। পাকিস্তানের স্বীকৃতির জন্য অবশ্য ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান আরব দেশগুলো এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ে সফল হন। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন, ভারত এ পদক্ষেপ তেমন পছন্দ করেনি এবং এ কারণে দু'দেশের সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেয় এবং তারা কিছু সমস্যার নিষ্পত্তি বিলম্বিত করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ছিটমহল বিনিময়। ১৯৭৪ সালের মে মাসে এ সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের পর প্রায় চার দশক পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এ ঘটনায় শেখ মুজিব মর্মাহত হন এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ বিষয়টি নিয়ে তেমন গবেষণা পরিচালিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের কূটনীতির ইতিহাসে ১৯৭৪ সাল বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
এ বছরেই স্বীকৃতি আদায়ের কূটনীতির পর্ব কার্যত শেষ হয় এবং দেশ প্রবেশ করে অর্থনৈতিক কূটনীতির যুগে। এর কারণও ছিল। সম্পদের অপ্রতুলতা এবং শাসনব্যবস্থার সমস্যার কারণে স্বাধীনতা-উত্তর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজের গতি ছিল মন্থর। তদুপরি ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে পরপর দু'বছর প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়। এর প্রভাবে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বিদেশি সাহায্য চাওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের জন্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবকে বহুলাংশে দায়ী করেছেন। 'আমলাতান্ত্রিক জটকেও' দায়ী করা যায়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পিএল-৪৮০ চুক্তির টাইটেল-১-এর আওতায় খাদ্য সহায়তা পেয়ে আসছিল। এর শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের 'শত্রু' কিউবার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর দেশে ৬০ হাজার বেলের মতো পাট রফতানির জন্য বাংলাদেশকে মূল্য দিতে হয়। বাংলাদেশের খাদ্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যশস্য প্রেরণ বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং তার একটি সূত্র ছিল রাশিয়া। ইতিমধ্যে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের অর্থনৈতিক সংকট থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাংলাদেশ পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া চলতে পারবে না। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সহায়তা পেতে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তনের পর পাশ্চাত্যের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতি গতি লাভ করে।
তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশ্বায়ন নিয়ে আসে নতুন গতি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের বড় বাজার গড়ে ওঠে। আমাদের পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির কাঠামোগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ বাজার আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। পোশাক ছাড়াও ওষুধসহ আরও কয়েক ধরনের পণ্যের বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি দেড় হাজার কোটি ডলার (বাংলাদেশের মুদ্রায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি) ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ হচ্ছে বর্তমানে চীন ও তুরস্কের পর বিশ্বের তৃতীয় তৈরি পোশাক রফতানিকারক।
তবে সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে জ্বালানি খাতে ঘাটতি দূর করায় মনোযোগী হতে হবে। এজন্য চাই জ্বালানি কূটনীতি। বিশ্ব জ্বালানি পরিস্থিতি মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ইরাক, আফগানিস্তান এবং সর্বশেষর্ িলবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের সামরিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বিশ্ব জুড়েই জ্বালানি সংকট রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে যদি না-ও হয়, অন্তত স্বল্পমেয়াদে উন্নত এবং বাংলাদেশসহ সব স্বল্পোন্নত দেশে এর প্রভাব পড়বেই। ১৯৭০ সালে প্রতি ব্যারেল তেলের দর ছিল মাত্র তিন ডলার এবং তা ২০০৮ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি ১৪৭ ডলারে পেঁৗছে যায়। এরপর দর কমে ২০১১ সালের প্রথম দিকে ১০০ ডলারের কাছাকাছি চলে আসে। লিবিয়ায় সামরিক অভিযানের পর তেলের দাম ফের বাড়বে বলেই শঙ্কা। এ অবস্থায় সৃজনশীল নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে সামনের দিনগুলো কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে বছরে ৬ শতাংশের কিছু বেশি। আগামী এক দশকের মধ্যে তা ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। জ্বালানি ইস্যু অগ্রাধিকার না পেলে এ লক্ষ্য অর্জন কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশকে তেল ও কয়লা ছাড়াও পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের চিন্তা করতেই হবে। এজন্য নীতিগত উদ্যোগ বিশেষভাবে কাঙ্ক্ষিত এবং আমরা তার কিছু লক্ষণ দেখছি। ভারতের সঙ্গে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরও আমাদের জ্বালানির উৎস হতে পারে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিশ কোর্টে দাবি উপস্থাপন করেছে। বেসামরিক জ্বালানি রিঅ্যাক্টর নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছে সমঝোতা স্মারক। তবে বিশ্বায়ন আরও কিছু উদ্যোগ দাবি করে।
ভারতের শীর্ষ মহলের একটি অংশে এখন এ উপলব্ধি রয়েছে যে, উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলোর উন্নয়নে বাংলাদেশের সক্রিয় সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দু'দেশের যে চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি ডলার ঋণ সুবিধা প্রদান ছাড়াও বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে শুল্ক ও শুল্কবহির্ভূত বাধা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা রয়েছে।
চীন এখন অর্থনৈতিক পরাশক্তি। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল ও পাকিস্তান শুধু নয়, ভারতও তাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার।
বিশ্বায়নের প্রভাবে অন্য ধরনের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুল মুনাফা করছে। যুদ্ধের পাশাপাশি কিন্তু সেখানে পুনর্গঠনের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। আফগানিস্তানে ব্র্যাক এ সুযোগ গ্রহণ করছে। এটাকে আমরা বলতে পারি বেসরকারি পররাষ্ট্রনীতি উদ্যোগ। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রতি বছর অনেক রাষ্ট্র নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেন এবং তাকে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু তার এ অবস্থানকে উন্নত বিশ্ব কিংবা জাতিসংঘের কাছ থেকে দেশের জন্য বাড়তি সুবিধা আদায়ে কাজে লাগানোর কোনো মেকানিজম গড়ে তোলা যায়নি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে সাফল্য নিঃসন্দেহে একটি রফতানিযোগ্য পণ্য। এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা অনেক। অন্য দেশ থেকে এর বিনিময়ে কিছু অর্জনের জন্য আমরা তা কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে পারি।
আমাদের জন্য পরিবেশ কূটনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এ ভূখণ্ডে পড়তে শুরু করেছে। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য ছিল। সঠিক ও সৃজনশীল উদ্যোগ থেকে আমরা এ ক্ষেত্রে আরও সুবিধা আদায় করতে পারি।
প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছে এক হাজার ৯৯ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা, এর মধ্যে ৭২২ কোটি ডলার এসেছে সৌদি আরব, সংযক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতারসহ কয়েকটি দেশ থেকে। আমাদের কর্মীদের বেশিরভাগ অদক্ষ কিংবা আধাদক্ষ। এ কারণে একটি বিপদের দিক হচ্ছে ওই অঞ্চলে ইসলামের যে অসহিষ্ণু ধারা যথেষ্ট শক্তিশালী তার প্রভাব আমাদের লাখ লাখ কর্মীর ওপর পড়তে পারে এবং তা 'রফতানি' হতে পারে বাংলাদেশে। এ কারণে আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা ব্যাপক। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্নে আমরা অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের চেয়ে বরং অনেক এগিয়ে থাকছি। বাঙালি সংস্কৃতিতে হানাফি, সুফি, বক্তি ও বাউল ঐতিহ্য অবদান রেখে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমানসহ অনেকে আমাদের সাহিত্য জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি প্রসারে তাদের অবদান কাজে লাগানো সম্ভব। আর এটা শুধু দেশে নয়, আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরেও এটা করা সম্ভব। এজন্য বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে সাংস্কৃতিক কূটনীতিকেও মূলধারায় পরিণত করা চাই।
জনগণকে বাইরে রেখে বৈদেশিক নীতি পরিচালনার ঔপনিবেশিক ধারা থেকেও সরে আসতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) মতো প্রতিষ্ঠানকে সরকারের করুণার ওপর নির্ভরতার অবসান ঘটাতে হবে। তাদের নিজস্ব অর্থায়ন সূত্র থাকতে হবে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে পণ্ডিতদের যুক্ত করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিপিডি, বিইআই এবং এ ধরনের স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মন্ত্রণালয়ে তিন বছর পরপর কর্মকর্তাদের বদলির রেওয়াজ রয়েছে। এ কারণে গবেষক ও পণ্ডিতদের একটি স্থায়ী পুলের কাছ থেকে সহায়তা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
সবশেষে বলব, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের মতো একটি ন্যাশনাল সিভিল কলেজ স্থাপন এখন জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবের ওপরে কিংবা মহাপরিচালক হিসেবে কাউকে পদোন্নতি দিতে হলে এ কলেজ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সনদ লাভ বাধ্যতামূলক হওয়া চাই। এ মন্ত্রণালয়কে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলারও প্রয়োজন রয়েছে এবং এর সূচনা করা যায় ন্যাশনাল সিভিল কলেজের মাধ্যমে। কলেজটি সংসদ সদস্য এবং প্রশাসনের অন্যদের জন্যও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানের আর্কাইভ সুবিধাও গড়ে তুলতে হবে। তথ্য অধিকার আইনের সুবিধাও জনসাধারণের জন্য থাকতে হবে। ২০ বছর পর 'গোপনীয় ও সংরক্ষিত' হিসেবে চিহ্নিত দলিলপত্র সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
চার দশক আগে স্বীকৃতির জন্য কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাত্রা শুরু করেছিল। দ্রুতই এর স্থান গ্রহণ করে অর্থনৈতিক কূটনীতি। এখন বিশ্বায়নের যুগ এবং এ প্রেক্ষাপটে জ্বালানি, জলবায়ু ও সাংস্কৃতিক কূটনীতির তাগিদ জোরালো হয়েছে। এ পথে সাফল্যের সঙ্গে চলতে পারলে শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের দেশগুলোও লাভবান হতে পারবে।
ইমতিয়াজ আহমেদ :অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
চার দশক আগে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরুর পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম পর্বকে আমরা বলতে পারি 'স্বীকৃতির জন্য কূটনীতি'। একাত্তরের ডিসেম্বরেই আমরা ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ছিল প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং তা পরিচালিত হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, এ কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে অনিচ্ছুক ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে ছিল। তাদের এ অবস্থানে পরিবর্তন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে মেনে নিতে রাজি করানো ছিল সে সময়ে প্রধান কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আর এটা মনে রাখতে হবে যে, সময়টি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনায় পূর্ণ। দুই শিবিরের পক্ষ থেকেই বলা হতো, 'যদি তুমি আমার পক্ষে না থাকো, তা হলে অবশ্যই তুমি আমার প্রতিপক্ষের শিবিরে।' বাংলাদেশের জন্য সেটা ছিল প্রকৃতই কঠিন সময়। পশ্চিমা ধনী দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে ছিল, কিন্তু তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
এ সময়েই অভিজাত ব্যবসায়ী মহল, আমলাতন্ত্র ও বুদ্ধিজীবীদের অনেককে আমরা সক্রিয় দেখতে পাই। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের চেনাজানা ছিল এবং তা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি আসে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে। পাকিস্তানের স্বীকৃতির জন্য অবশ্য ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান আরব দেশগুলো এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ে সফল হন। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন, ভারত এ পদক্ষেপ তেমন পছন্দ করেনি এবং এ কারণে দু'দেশের সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেয় এবং তারা কিছু সমস্যার নিষ্পত্তি বিলম্বিত করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ছিটমহল বিনিময়। ১৯৭৪ সালের মে মাসে এ সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের পর প্রায় চার দশক পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এ ঘটনায় শেখ মুজিব মর্মাহত হন এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ বিষয়টি নিয়ে তেমন গবেষণা পরিচালিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের কূটনীতির ইতিহাসে ১৯৭৪ সাল বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
এ বছরেই স্বীকৃতি আদায়ের কূটনীতির পর্ব কার্যত শেষ হয় এবং দেশ প্রবেশ করে অর্থনৈতিক কূটনীতির যুগে। এর কারণও ছিল। সম্পদের অপ্রতুলতা এবং শাসনব্যবস্থার সমস্যার কারণে স্বাধীনতা-উত্তর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজের গতি ছিল মন্থর। তদুপরি ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে পরপর দু'বছর প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়। এর প্রভাবে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বিদেশি সাহায্য চাওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের জন্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবকে বহুলাংশে দায়ী করেছেন। 'আমলাতান্ত্রিক জটকেও' দায়ী করা যায়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পিএল-৪৮০ চুক্তির টাইটেল-১-এর আওতায় খাদ্য সহায়তা পেয়ে আসছিল। এর শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের 'শত্রু' কিউবার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর দেশে ৬০ হাজার বেলের মতো পাট রফতানির জন্য বাংলাদেশকে মূল্য দিতে হয়। বাংলাদেশের খাদ্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যশস্য প্রেরণ বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং তার একটি সূত্র ছিল রাশিয়া। ইতিমধ্যে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের অর্থনৈতিক সংকট থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাংলাদেশ পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া চলতে পারবে না। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সহায়তা পেতে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তনের পর পাশ্চাত্যের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতি গতি লাভ করে।
তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশ্বায়ন নিয়ে আসে নতুন গতি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের বড় বাজার গড়ে ওঠে। আমাদের পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির কাঠামোগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ বাজার আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। পোশাক ছাড়াও ওষুধসহ আরও কয়েক ধরনের পণ্যের বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি দেড় হাজার কোটি ডলার (বাংলাদেশের মুদ্রায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি) ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ হচ্ছে বর্তমানে চীন ও তুরস্কের পর বিশ্বের তৃতীয় তৈরি পোশাক রফতানিকারক।
তবে সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে জ্বালানি খাতে ঘাটতি দূর করায় মনোযোগী হতে হবে। এজন্য চাই জ্বালানি কূটনীতি। বিশ্ব জ্বালানি পরিস্থিতি মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ইরাক, আফগানিস্তান এবং সর্বশেষর্ িলবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের সামরিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বিশ্ব জুড়েই জ্বালানি সংকট রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে যদি না-ও হয়, অন্তত স্বল্পমেয়াদে উন্নত এবং বাংলাদেশসহ সব স্বল্পোন্নত দেশে এর প্রভাব পড়বেই। ১৯৭০ সালে প্রতি ব্যারেল তেলের দর ছিল মাত্র তিন ডলার এবং তা ২০০৮ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি ১৪৭ ডলারে পেঁৗছে যায়। এরপর দর কমে ২০১১ সালের প্রথম দিকে ১০০ ডলারের কাছাকাছি চলে আসে। লিবিয়ায় সামরিক অভিযানের পর তেলের দাম ফের বাড়বে বলেই শঙ্কা। এ অবস্থায় সৃজনশীল নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে সামনের দিনগুলো কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে বছরে ৬ শতাংশের কিছু বেশি। আগামী এক দশকের মধ্যে তা ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। জ্বালানি ইস্যু অগ্রাধিকার না পেলে এ লক্ষ্য অর্জন কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশকে তেল ও কয়লা ছাড়াও পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের চিন্তা করতেই হবে। এজন্য নীতিগত উদ্যোগ বিশেষভাবে কাঙ্ক্ষিত এবং আমরা তার কিছু লক্ষণ দেখছি। ভারতের সঙ্গে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরও আমাদের জ্বালানির উৎস হতে পারে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিশ কোর্টে দাবি উপস্থাপন করেছে। বেসামরিক জ্বালানি রিঅ্যাক্টর নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছে সমঝোতা স্মারক। তবে বিশ্বায়ন আরও কিছু উদ্যোগ দাবি করে।
ভারতের শীর্ষ মহলের একটি অংশে এখন এ উপলব্ধি রয়েছে যে, উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলোর উন্নয়নে বাংলাদেশের সক্রিয় সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দু'দেশের যে চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি ডলার ঋণ সুবিধা প্রদান ছাড়াও বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে শুল্ক ও শুল্কবহির্ভূত বাধা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা রয়েছে।
চীন এখন অর্থনৈতিক পরাশক্তি। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল ও পাকিস্তান শুধু নয়, ভারতও তাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার।
বিশ্বায়নের প্রভাবে অন্য ধরনের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুল মুনাফা করছে। যুদ্ধের পাশাপাশি কিন্তু সেখানে পুনর্গঠনের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। আফগানিস্তানে ব্র্যাক এ সুযোগ গ্রহণ করছে। এটাকে আমরা বলতে পারি বেসরকারি পররাষ্ট্রনীতি উদ্যোগ। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রতি বছর অনেক রাষ্ট্র নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেন এবং তাকে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু তার এ অবস্থানকে উন্নত বিশ্ব কিংবা জাতিসংঘের কাছ থেকে দেশের জন্য বাড়তি সুবিধা আদায়ে কাজে লাগানোর কোনো মেকানিজম গড়ে তোলা যায়নি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে সাফল্য নিঃসন্দেহে একটি রফতানিযোগ্য পণ্য। এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা অনেক। অন্য দেশ থেকে এর বিনিময়ে কিছু অর্জনের জন্য আমরা তা কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে পারি।
আমাদের জন্য পরিবেশ কূটনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এ ভূখণ্ডে পড়তে শুরু করেছে। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য ছিল। সঠিক ও সৃজনশীল উদ্যোগ থেকে আমরা এ ক্ষেত্রে আরও সুবিধা আদায় করতে পারি।
প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছে এক হাজার ৯৯ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা, এর মধ্যে ৭২২ কোটি ডলার এসেছে সৌদি আরব, সংযক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতারসহ কয়েকটি দেশ থেকে। আমাদের কর্মীদের বেশিরভাগ অদক্ষ কিংবা আধাদক্ষ। এ কারণে একটি বিপদের দিক হচ্ছে ওই অঞ্চলে ইসলামের যে অসহিষ্ণু ধারা যথেষ্ট শক্তিশালী তার প্রভাব আমাদের লাখ লাখ কর্মীর ওপর পড়তে পারে এবং তা 'রফতানি' হতে পারে বাংলাদেশে। এ কারণে আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা ব্যাপক। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্নে আমরা অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের চেয়ে বরং অনেক এগিয়ে থাকছি। বাঙালি সংস্কৃতিতে হানাফি, সুফি, বক্তি ও বাউল ঐতিহ্য অবদান রেখে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমানসহ অনেকে আমাদের সাহিত্য জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি প্রসারে তাদের অবদান কাজে লাগানো সম্ভব। আর এটা শুধু দেশে নয়, আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরেও এটা করা সম্ভব। এজন্য বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে সাংস্কৃতিক কূটনীতিকেও মূলধারায় পরিণত করা চাই।
জনগণকে বাইরে রেখে বৈদেশিক নীতি পরিচালনার ঔপনিবেশিক ধারা থেকেও সরে আসতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) মতো প্রতিষ্ঠানকে সরকারের করুণার ওপর নির্ভরতার অবসান ঘটাতে হবে। তাদের নিজস্ব অর্থায়ন সূত্র থাকতে হবে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে পণ্ডিতদের যুক্ত করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিপিডি, বিইআই এবং এ ধরনের স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মন্ত্রণালয়ে তিন বছর পরপর কর্মকর্তাদের বদলির রেওয়াজ রয়েছে। এ কারণে গবেষক ও পণ্ডিতদের একটি স্থায়ী পুলের কাছ থেকে সহায়তা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
সবশেষে বলব, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের মতো একটি ন্যাশনাল সিভিল কলেজ স্থাপন এখন জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবের ওপরে কিংবা মহাপরিচালক হিসেবে কাউকে পদোন্নতি দিতে হলে এ কলেজ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সনদ লাভ বাধ্যতামূলক হওয়া চাই। এ মন্ত্রণালয়কে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলারও প্রয়োজন রয়েছে এবং এর সূচনা করা যায় ন্যাশনাল সিভিল কলেজের মাধ্যমে। কলেজটি সংসদ সদস্য এবং প্রশাসনের অন্যদের জন্যও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানের আর্কাইভ সুবিধাও গড়ে তুলতে হবে। তথ্য অধিকার আইনের সুবিধাও জনসাধারণের জন্য থাকতে হবে। ২০ বছর পর 'গোপনীয় ও সংরক্ষিত' হিসেবে চিহ্নিত দলিলপত্র সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
চার দশক আগে স্বীকৃতির জন্য কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাত্রা শুরু করেছিল। দ্রুতই এর স্থান গ্রহণ করে অর্থনৈতিক কূটনীতি। এখন বিশ্বায়নের যুগ এবং এ প্রেক্ষাপটে জ্বালানি, জলবায়ু ও সাংস্কৃতিক কূটনীতির তাগিদ জোরালো হয়েছে। এ পথে সাফল্যের সঙ্গে চলতে পারলে শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের দেশগুলোও লাভবান হতে পারবে।
ইমতিয়াজ আহমেদ :অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments