দুঃখময় বাংলাদেশে রিক্ত আমরা by মোস্তফা মামুন

৪০ বছর আগে 'নন্দিত নরকে' নামের চাবিতে তিনি খুলেছিলেন এক আশ্চর্য পৃথিবীর দরজা। হিমুর সেই পৃথিবী, মিসির আলির সেই পৃথিবী, শুভ্র-রূপাদের পৃথিবীতে তাঁর ভ্রমণ শেষ হলো। কাঠের কফিনে শুয়ে, বন্ধুদের কাঁধে চড়ে এবার তিনি চললেন চিরন্তন স্বর্গের পথে। সঙ্গে লাখো ভেজা চোখ, ব্যক্ত-অব্যক্ত হাহাকার, শোকমিছিলের স্তব্ধতা, হৃদয়ছেঁড়া


দীর্ঘশ্বাসের ভারী বাতাস। পেছনে দুঃখময় বাংলাদেশ। আর কীর্তির স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রিক্ত-নিঃস্ব আমরা।
ভিড়কে তাঁর ভীষণ অপছন্দ ছিল। যেখানে ভিড়ের সম্ভাবনা সেখান থেকে দূরেই থাকতেন। অথচ সেই তাঁকে ঘিরে কাল সকাল থেকে শুরু হলো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ভিড়। এমনটা হতে পারে ধরে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া ছিল; পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। এই রাস্তায় যাওয়া যাবে না, ওই রাস্তায় এসো না- হরেক বিধি-নিষেধ। ভিড় সেই বাধাগুলো মানল কিন্তু তাতে আটকাল না। শহীদ মিনারে আসার কথা ছিল ১১টায়, চলে এলেন আধঘণ্টা আগে, কিন্তু তারও অনেক আগে থেকেই লাইনটা দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে সর্পিলাকার নিয়েছে। এসব লাইনে সাধারণত যা হয়, বিখ্যাতরা লাইন ধরতে চান না, নাম ব্যবহার করার চেষ্টা থাকে এবং তাতে কাজও হয়। আশ্চর্য, কাল সেই চেষ্টাটুকু কারো নেই! তাঁর নাটকের অভিনেতা হয়তো, সবাই চেনে বলে লাইনে এগিয়ে দিতে চায় কিন্তু তিনি দাঁড়িয়েই থাকেন। খুব বেশি ব্যানার নেই, শোক জানানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জানানোর বাঙালি সংস্কৃতিও কাল অনুপস্থিত। এখানেও তিনি ঠিক হাজির। ভিড়ের এই ঘরোয়া চরিত্র তো হুমায়ূনী প্রকাশেরই ধরন। নিজেকে না দেখিয়ে শুধুই ভালোবাসা দেখানোর এই অকৃত্রিমতাও তাঁকে ঘিরেই বোধহয় শুধু সম্ভব। মুখ দেখা যাবে না, কাছেও হয়তো যাওয়া হবে না ঠিকঠাক, পুলিশ ঠেলছে, আবার একটু এদিক-ওদিক হলে আয়োজকদের রক্তচক্ষু, তবু তারা লাইনে। নীরব ভালোবাসার প্রকাশে শুধু জানিয়ে যেতে চায়, আমিও এসেছিলাম। চার্লস ডিকেন্স সম্পর্কে বলা হতো, তিনি যত চরিত্র তৈরি করেছেন সেটা দিয়ে পুরো লন্ডন শহরটা ভরে ফেলা সম্ভব। সেখান থেকে ধার করে একজন বলছিলেন, হুমায়ূন যত চরিত্র তৈরি করেছেন সেটা দিয়ে বাংলাদেশ ভরে ফেলা সম্ভব। তা সম্ভব কি না জানি না কিন্তু শেষ দিনে হুমায়ূনের টানে বাংলাদেশ যেমন কান্নায় একীভূত তাতে মনে হলো, তাঁর চরিত্রদের, তাঁর মানুষদের শক্তি পৃথিবীর কারো চেয়ে একটুও কম নয়। কিন্তু এসব ফেলে তাঁকে থাকতে হবে একা। একা নাকি কোথাও যেতে চাইতেন না। লজ্জা লাগে। ভয়ও পান। যাওয়ার পথে তো সঙ্গী নিজের স্বপ্নেরও বেশি মানুষের দল। আমরা একেবারে শেষ পর্যন্ত হয়তো যেতে পারছি না কিন্তু আমাদের ভালোবাসায় ভরতি নৌকাটা তো যাচ্ছে। তার পরও একা বোধ করলে গাছ আছে, প্রকৃতি আছে। গাছদের সঙ্গে তাঁর দারুণ সম্পর্ক ছিল। কুশল বিনিময়ও হতো প্রায়ই।
জানতে চাইতেন, কিরে ব্যাটা, খবর কী? খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে ঠিকঠাক?
ওপাশের উত্তর তিনি শুনতেন। আর কেউ না।
এখন দুপাশকেই আমরা শুনব না। কিন্তু তাদের সম্পর্ক চালু থাকবে। আড্ডা-রসিকতাও হবে হয়তো।
এই দিনেও তাঁর রসিকতার কথা মনে পড়ল। দুপুর ১২টার দিকে পরিবেশটা ভীষণ ভারী তখন। কান্না। আহাজারি। শোক। কিন্তু মাত্র একটা রসিকতায়, কলমের কয়েকটা আঁচড়ে এই পুরো স্রোতের চরিত্রটা বদলে দিতে পারতেন। সবাই হেসে উঠত, মৃত্যু ব্যাপারটা তো ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। কিন্তু হায়! মৃত্যু নামের অপশক্তির কাছে যে আজ তিনি শক্তিহীন। জীবন গাড়ি আজ শেষ স্টেশনে। প্রাণের ঘুড়িটার সুতা কেটে গেল বড় অবেলায়।
বাঙালি আর কোনো লেখক মৃত্যু নিয়ে এত রোমান্টিকতা করেননি। আর কারো কলমে মৃত্যু এমন রঙিন রূপ পায়নি। কেমন মৃত্যু চান, কী রকম দিনে- এসব গানে-গল্পে বলে গেছেন কতবার। তা থেকেই জানি, একটা স্বপ্ন ছিল, চাঁদনি পসর রাতে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। হয়নি। বৃষ্টি তাঁর খুব পছন্দের ছিল। এই শ্রাবণের দিনে কাল বৃষ্টি হতেই পারত। অথচ একবার মাত্র একটু সম্ভাবনা জাগিয়েই তার দায়িত্ব শেষ। কী আর করা যাবে! জগৎস্রষ্টা তো শেষবেলাতে তাঁর প্রতি একটু বেশিই নির্মম। এ ক্ষেত্রে তো আমরাও কিছু করতে পারি না। কিন্তু আমরা যা যা করতে পারতাম তার কিছুই বোধহয় বাকি রাখিনি। আমাদের বাংলাদেশের সমাজ নৈতিক ক্ষয়ের চূড়ান্ত বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে বলেই সবার ধারণা। এখন পুঁজি আর বাণিজ্যের যুগ, সম্পর্ক সব লেনদেনভিত্তিক জায়গায় অথচ সেখানে একজন লেখক, একজন জ্ঞানভিত্তিক মানুষ এমন রাজার মর্যাদায় যাচ্ছেন, এটা তো পুরো সমাজের জন্যই গর্বের কথা। আত্ম-অহংকারের জায়গাও। একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, 'আমার মৃত্যুর পর কী হবে না হবে তা নিয়ে খুব ভাবছি না। কারণ আমি তো আর ওসব দেখতে পাব না।' দেখতে পাননি। পাওয়া যায় না। কিন্তু দেখলে বোধহয় কথাটা ফিরিয়ে নিতেন। আবার এই মৃত্যুরও কিছু শক্তি দেখছি। নিন্দুকদের জীবিত হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে মৃত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বেশি চিন্তা ছিল। তাঁদের বক্তব্য, হুমায়ূন কালজয়ী কিছু লিখছেন না। কাজেই মারা যাওয়ার পরই শেষ। কিন্তু মারা যাওয়ার পর একটুও শেষ নয় বলেই পাঁচ দিন ধরে পুরো দেশে মাতম। আরেকটা কাজ, যেটা জীবনে পারেননি, সেটাও কাল হলো। নানা মান-অভিমানে পরিবার-সন্তানদের কেউ কেউ দূরে সরে ছিলেন, বিভক্তিও ছিল যথেষ্ট, কাল তাঁরা একসঙ্গে। জীবনে যা পারেননি, মৃত্যুতে এক নিমিষে তা-ই হয়ে গেল। হয়তো সাময়িক, তবু হয়েছে তো! সেই তাঁদেরই মধ্যে শেষশয্যা নিয়ে কিছু মতভেদ। শুরুতে জানা গিয়েছিল, নুহাশপল্লীতেই স্থায়ীভাবে শায়িত হবেন। পরশু সিদ্ধান্ত বদলে ঢাকার কথাই শোনা গেল বেশি। কাল আবার ঢাকা না নুহাশপল্লী- এই নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা। খালিচোখে হয়তো টানাহেঁচড়ার মতো দেখায় কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের গল্পের ক্লাইম্যাক্সও তো আছে তাতে! বারবার বাঁকবদল। নাটকীয়তায় ভরা। শেষ জানতে শেষ পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। তাঁর দৃষ্টিতে দেখলে জীবন এমনই সহজ। এতটাই আনন্দমুখর।
মানবিকতার-সম্পর্কের-আবেগের হৃদয়ছেঁড়া কত দৃশ্য কাল সারা দিনে রচিত হলো! বাবার কফিনের কাছে দাঁড়িয়ে কান্নায় ব্যাকুল ছেলে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত স্ত্রী শেষ ইচ্ছার কথা বলতে গিয়ে নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলেন। বৃদ্ধা মা অসুস্থ শরীরে এই ভিড় ঠেলে চলে আসেন কিন্তু ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না। এমন গভীর আবেগের দৃশ্য যে বর্ণনা দিতে গেলে বাক্য তৈরি হয় না। ভাষা অচল হয়ে থাকে। শব্দ ডুবে যায় নৈঃশব্দে। দেখতে দেখতে মনে হলো, এমন কত কল্পনার দৃশ্য তিনি জীবনের চেয়েও জীবন্ত করেছেন। এই মুহূর্তগুলোর বর্ণনাও শুধু তিনিই দিতে পারতেন। কিন্তু হায়! তিনি তখন শুয়ে। জীবন গাড়িটা দাঁড়িয়ে শেষ স্টেশনে। চলছে অচীনপুরে যাত্রার শেষ প্রস্তুতি।
সেখানে সঙ্গী ভেজা চোখ, ব্যক্ত-অব্যক্ত হাহাকার, শোকমিছিলের স্তব্ধতা, রক্তাক্ত সব হৃদয়। পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদে দুঃখময় বাংলাদেশ। আর কীর্তির স্মৃতি নিয়ে রিক্ত-নিঃস্ব এই আমরা।

No comments

Powered by Blogger.