হাহাকারের গল্প by শিখা ইসলাম
চলে গেলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু সত্যিই কি তিনি চলে গেলেন! রয়ে গেলেন, রয়ে যাবেন আমাদের মতো অযুত নিযুত ভক্ত পাঠকের হৃদয়ে। তার হৃদয়েও ছিল হাহাকার। এ হাহাকার কার জন্য কিসের জন্য, তা তিনি ভেঙে বলেননি। আমরাও তা ভেঙে বলতে পারছি না, খানিকটা বা ধরে নিচ্ছি তাও সঠিক কিনা কে জানে।
যুদ্ধ শেষে বছর দুয়েকের স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সনে গুলতেকিনের সাথে তার বিয়ে হয়। পরপর তিন কন্যা আর এক পুত্রকে নিয়ে শুদ্ধ সুখে-দুঃখের সংসার তাদের। কোনো কোনো রাতে ঘুমের আয়োজন করে উঠে গিয়ে কন্যাদের (হুমায়ূন আহমেদ তার মেয়েদের কন্যা বলে এ্যাড্রেস করতেন)দেখতেন, কন্যারা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে, কারণ আজ তারা ভূতের বই পড়েছে বা ছবি দেখেছে। এ দৃশ্য দেখে বিরল আনন্দ পেতেন তিনি। পিতৃস্নেহে আপ্লুত হতেন। আবার কখনওবা এক মেয়ে তার গায়ের গন্ধ ঘষে ঘষে শিশিতে ভরো দিতো বাবার উদ্দেশে, এসব তার লেখা পড়ে জেনেছি। আর একদিন তার এলিফ্যান্ট রোডের ফ্ল্যাটে গিয়েছেন আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, মেয়েরা তো তাকে কোথায় বসতে দেবে, কী খাওয়াবে এই নিয়ে মহাব্যস্ত। হুমায়ূন আহমেদ দ্রুতপায়ে স্যান্ডেল পরে নিচে নামছিলেন পাকা পেঁপে কিনে আনতে। ঘাতকব্যাধি ক্যান্সারে জাহানারা ইমামও ছিলেন তখন আক্রান্ত। খাবার মধ্যে একটু পেঁপে খেতেন। তাই বাবা আর মেয়েদের এই ব্যস্ততা। লিফ্টে নামবার সময় হুমায়ূন আহমেদকে লক্ষ্য করে এক ব্যক্তি উত্তেজনা ভরা কণ্ঠে শুধালেন-‘জানেন ভাই, আমাদের এই ভবনে নাকি আজ কোন এক ফ্ল্যাটে জাহানারা ইমাম এসেছেন?’ হুমায়ূন আহমেদ মাথা নেড়ে হেসেছিলেন। পরে এই গল্প মেয়েদের সাথে বলতে বলতে সবাই মিলে খুব হেসেছিলেন সেদিন। গুলোতেকিনও হেসেছিলেন খুব।
স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখার জন্য গুলতেকিন তাকে একটি খাতা দিয়েছিলেন-সেটা মনে রেখে পরবর্তীতে তিনি ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ নামের বইটি লেখেন। অবশ্য ততদিনে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তাইতো বইটির শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আজ এই বইটি তার হাতে পড়লে সে খুশি হবে।’ এই কথাটাও একটা হাহাকার থেকেই আসে। একজন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক তিনি, অসামান্য লেখক। কিন্তু তিনি কি একদিনে অসামান্য হয়েছেন? দিনে দিনে তিলে তিলে অসামান্য হয়েছেন। পাশে পাশে বত্রিশ বৎসর ধরে ছিলেন গুলতেকিন।
স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত না করলে বলতে পারি যে, হুমায়ূন আহমেদের বিবাহ পূর্ববর্তী কোনো উজ্জ্বল লেখা নেই (১৯৭৩ পূর্ববর্তী)। নাটক সিনেমা তো নয়ই। এসব যখন তৈরি করে খ্যাতির মধ্যগগণে উঠে গেলেন, সেই যাবার বা উঠার সময়গুলোতে চার চারটি ছেলেমেয়েকে লালন-পালন করা, দেখভাল করা, স্বামীর লেখায় যাতে ব্যাঘাত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা, এটাতো স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদই বেশি জানতেন। গুলতেকিনতো সেলিব্রেটি ছিলেন না, তাই তার ব্যাপারে আমাদের নয়, হাহাকারটা ছিল হুমায়ূন আহমেদরই। কিন্তু এই এক হাহাকার কথাটা দিয়েই কি সব ঢেকে রাখা যায়? যায় না। ২০০৫ এর পরে তার লেখা অনেক বইয়ের মলাটের আত্মকথনে শুধুই হাহাকারের কথা বলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। গুলতেকিন কোনোদিন মিডিয়ার সামনেও আসেননি, পাছে হুমায়ূন আহমেদের হাহাকারটা বেড়ে যায়। তিনি সেপারেশনের সময় মিডিয়াকে বলেছেন, আমি তো সেলিব্রেটি নই, যারা সেলিব্রেটি তাদের কাছে যান, তাদের সাক্ষাৎকার নিন।
হায়! পোড় খাওয়া নারী, আজ তার জন্য কষ্ট হয়। একবার নুহাশকে ক্যারি (গর্ভে থাকার সময়) করার সময় স্বামীকে বলেছিলেন-এখন তুমি টিভির নতুন নাটকে হাত দিও না কারণ, আমি বেবি ক্যারি করছি। হয়তো প্রেগন্যান্সি টাইমে স্বামীর এ্যাটেনশন চাচ্ছিলেন, হয়তো জেনেছিলেন এবার শিশুটি ছেলেই হবে। হুমায়ূন আহমেদ নাটকটি হাতে নিয়েছিলেন কিনা মনে পড়ে না।
বিচ্ছেদেও দেখা যায় কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেননি গুলতেকিন। তিনি বড়মাপের মানুষদের মতো নিরবেই সরে গেছেন। যেমনটি করেছিলেন আমেরিকার হিলারি ক্লিনটন। ক্লিনটনের দোষকে মাফ করে দিয়ে নিজে হয়েছিলেন মহীয়সী, আর ক্লিনটনকে করেছিলেন বিশ্ববাসী এবং কন্যা চেলসির কাছে অপমানমুক্ত।
তবে আর একটা কথা দিয়ে এ হাহাকারের লেখা শেষ করবো, আর তা হলো মহানায়ক উত্তম কুমার যেদিন মারা যান সেদিন এক সংবেদনশীল সাংবাদিক লিখেছিলেন, উত্তমের মৃত্যু হলে সেই রাতে তিন রমনীর কি করে কেটেছিল? এক, উত্তমের জীবনের প্রথম প্রেমের বিয়ের গৌরী দেবীর কোলকাতার ভবানীপুরের বাড়িতে কাটানো রাত। দুই, উত্তমের সারা জনমের রোমান্টিক নায়িকা সুচিত্রা সেনের বালীগঞ্জের বাড়ির সেদিনের সেই রাত, আর সর্বশেষ ১০ নং ময়রাস্ট্রিটে উত্তমের জীবন শেষ দিন পর্যন্ত যে নারীর সান্নিধ্যে কেটেছে, সেই সুপ্রিয়া দেবীর রাত। এক উত্তমের ভাবনায় কী করে কেটেছে তাদের?
তেমনি ১৯ জুলাই কী করে কাটলো একজন গুলতেকিনের রাত, যার সাথে কিনা ৩২টি বৎসর সুখে-দুঃখে সন্তান দেবর আর ননদ শাশুড়িকে নিয়ে কাটিয়েছেন তিনি। হায়! হাহাকারের নিয়তি! কোথায় ৩২ বছর আর ২০০৫ থেকে ২০১২ মাত্র ৭ বছর। এই সাত বছরে কে কাকে কতটা দখল করেছিল? - ব্লগ থেকে।
স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখার জন্য গুলতেকিন তাকে একটি খাতা দিয়েছিলেন-সেটা মনে রেখে পরবর্তীতে তিনি ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ নামের বইটি লেখেন। অবশ্য ততদিনে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তাইতো বইটির শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আজ এই বইটি তার হাতে পড়লে সে খুশি হবে।’ এই কথাটাও একটা হাহাকার থেকেই আসে। একজন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক তিনি, অসামান্য লেখক। কিন্তু তিনি কি একদিনে অসামান্য হয়েছেন? দিনে দিনে তিলে তিলে অসামান্য হয়েছেন। পাশে পাশে বত্রিশ বৎসর ধরে ছিলেন গুলতেকিন।
স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত না করলে বলতে পারি যে, হুমায়ূন আহমেদের বিবাহ পূর্ববর্তী কোনো উজ্জ্বল লেখা নেই (১৯৭৩ পূর্ববর্তী)। নাটক সিনেমা তো নয়ই। এসব যখন তৈরি করে খ্যাতির মধ্যগগণে উঠে গেলেন, সেই যাবার বা উঠার সময়গুলোতে চার চারটি ছেলেমেয়েকে লালন-পালন করা, দেখভাল করা, স্বামীর লেখায় যাতে ব্যাঘাত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা, এটাতো স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদই বেশি জানতেন। গুলতেকিনতো সেলিব্রেটি ছিলেন না, তাই তার ব্যাপারে আমাদের নয়, হাহাকারটা ছিল হুমায়ূন আহমেদরই। কিন্তু এই এক হাহাকার কথাটা দিয়েই কি সব ঢেকে রাখা যায়? যায় না। ২০০৫ এর পরে তার লেখা অনেক বইয়ের মলাটের আত্মকথনে শুধুই হাহাকারের কথা বলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। গুলতেকিন কোনোদিন মিডিয়ার সামনেও আসেননি, পাছে হুমায়ূন আহমেদের হাহাকারটা বেড়ে যায়। তিনি সেপারেশনের সময় মিডিয়াকে বলেছেন, আমি তো সেলিব্রেটি নই, যারা সেলিব্রেটি তাদের কাছে যান, তাদের সাক্ষাৎকার নিন।
হায়! পোড় খাওয়া নারী, আজ তার জন্য কষ্ট হয়। একবার নুহাশকে ক্যারি (গর্ভে থাকার সময়) করার সময় স্বামীকে বলেছিলেন-এখন তুমি টিভির নতুন নাটকে হাত দিও না কারণ, আমি বেবি ক্যারি করছি। হয়তো প্রেগন্যান্সি টাইমে স্বামীর এ্যাটেনশন চাচ্ছিলেন, হয়তো জেনেছিলেন এবার শিশুটি ছেলেই হবে। হুমায়ূন আহমেদ নাটকটি হাতে নিয়েছিলেন কিনা মনে পড়ে না।
বিচ্ছেদেও দেখা যায় কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেননি গুলতেকিন। তিনি বড়মাপের মানুষদের মতো নিরবেই সরে গেছেন। যেমনটি করেছিলেন আমেরিকার হিলারি ক্লিনটন। ক্লিনটনের দোষকে মাফ করে দিয়ে নিজে হয়েছিলেন মহীয়সী, আর ক্লিনটনকে করেছিলেন বিশ্ববাসী এবং কন্যা চেলসির কাছে অপমানমুক্ত।
তবে আর একটা কথা দিয়ে এ হাহাকারের লেখা শেষ করবো, আর তা হলো মহানায়ক উত্তম কুমার যেদিন মারা যান সেদিন এক সংবেদনশীল সাংবাদিক লিখেছিলেন, উত্তমের মৃত্যু হলে সেই রাতে তিন রমনীর কি করে কেটেছিল? এক, উত্তমের জীবনের প্রথম প্রেমের বিয়ের গৌরী দেবীর কোলকাতার ভবানীপুরের বাড়িতে কাটানো রাত। দুই, উত্তমের সারা জনমের রোমান্টিক নায়িকা সুচিত্রা সেনের বালীগঞ্জের বাড়ির সেদিনের সেই রাত, আর সর্বশেষ ১০ নং ময়রাস্ট্রিটে উত্তমের জীবন শেষ দিন পর্যন্ত যে নারীর সান্নিধ্যে কেটেছে, সেই সুপ্রিয়া দেবীর রাত। এক উত্তমের ভাবনায় কী করে কেটেছে তাদের?
তেমনি ১৯ জুলাই কী করে কাটলো একজন গুলতেকিনের রাত, যার সাথে কিনা ৩২টি বৎসর সুখে-দুঃখে সন্তান দেবর আর ননদ শাশুড়িকে নিয়ে কাটিয়েছেন তিনি। হায়! হাহাকারের নিয়তি! কোথায় ৩২ বছর আর ২০০৫ থেকে ২০১২ মাত্র ৭ বছর। এই সাত বছরে কে কাকে কতটা দখল করেছিল? - ব্লগ থেকে।
No comments