আকাশ ভরা তারা by সুভাষ সাহা
মারী ও মন্বন্তরের বাংলা কবে ইতিহাসের কোলে ঠাঁই নিয়েছে, কবে সেখানে জেগে উঠতে শুরু করেছে আকাশ ভরা তারা শোভিত আশা জাগানিয়া এক নতুন বাংলা, তার হিসাব আমরা অনেকেই কষি না। বরং নানা রঙের বিচিত্র ঢঙের সং সেজে এই রূপসী বাংলাকে কুৎসিত-কদাকাররূপে অপরের কাছে উপস্থাপনেই যেন কারও কারও আনন্দ।
তা না হলে কারণে-অকারণে যখন অন্যরা আমাদের দুর্নীতিপরায়ণ, প্রতিহিংসাপরায়ণ,কাজিয়াপ্রবণ, রক্ষণশীল ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করেন, তখন একদল আলোকপ্রাপ্তির দাবিদার লোক তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে পারেন কী করে? বিশেষত বিদেশিরা যখন কোনো মন্দ বিশেষণের ব্র্যাকেটে আমাদের বন্দি করে ফেলতে উদ্ধত হন, তখন এসব মানুষ বগল বাজাতে পারেন কী করে? অথচ দেখুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পশ্চিমাদের বহুল প্রচারিত টাইম ম্যাগাজিন 'আন্ডারঅ্যাচিভার' বলে কভার স্টোরি ফাঁদার পর ভারতের পত্রপত্রিকায় এমনকি রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। আউটলুক সাময়িকী তো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে একই অভিধায় অভিহিত করে মনের ঝাল মিটিয়েছে। অথচ আমরা বিদেশিদের একটা চারিত্রিক সার্টিফিকেট জোগাড় করার জন্য কী ব্যস্তস্নই না হয়ে পড়ি! হা হতোস্মি! একেই কি ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলে? অথচ দেখুন, নয়াদিলি্লতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন মহাশয় বাংলাদেশকে নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য কী ভূয়সী প্রশংসাই না করেছেন। শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, বিশ্বে দ্রুত নারী শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ যে প্রথম অবস্থান অর্জন করেছে তা কিন্তু অনেক বাদানুবাদের মধ্যে আমরা আমলেই নিচ্ছি না। অমর্ত্য সেন একজন বিদগ্ধ মানুষ। নারী শিক্ষা প্রসারের অর্থ যে সমাজের-দেশের অগ্রসরমানতা তা তিনি ধরতে পারেন অতি সহজেই। অথচ আমাদের আলোকপ্রাপ্ত মানুষরা এই বিরাট যুগান্তকারী উন্নতিযোগের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন না। নারী শিক্ষা মানেই ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সেতু নির্মাণ, নারীকে পুরুষের সমানতালে চলার সামর্থ্য জোগানো, দেশের বাকি অর্ধেক মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করা, সমাজের পুরনো অচলায়তন ভেঙে ফেলার হাতিয়ারে শান দেওয়া, এক কথায় প্রগতি, উন্নতি, আরও উন্নতির পথে একটির পর একটি সোপান ঝটপট অতিক্রম করে যাওয়া। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় গত তিন বছরে প্রায় ২০ লাখ ছাত্রীর পাস করা আমাদের নিশ্চল গ্রামীণ সমাজকে কীভাবে আলোড়িত করছে তা কি আমরা অনুভব করতে পারছি না। আর এবার তো প্রায় পরীক্ষাতেই ছাত্রীরা ছাত্রদের ডিঙিয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে গোটা দেশ এক সময় দক্ষ শ্রমশক্তি সরবরাহের উন্নত বাজারে পরিণত হবে। আর আমাদের সমাজ নিজস্ব সংস্কৃতিকে পরিশীলিতরূপে অঙ্গে ধারণ করে বিশ্বের বুকে সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। তখনও হয়তো আমরা অস্ত্র শক্তিতে অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকব ঠিকই; কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতিমনস্কতায় অনেক জাতিকেই টেক্কা দিতে পারব। শিক্ষার আলোয় বাংলাদেশের মানুষ তাদের আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই আমরা এক সময় অজেয় হয়ে উঠব। নারী শিক্ষা, দারিদ্র্য হ্রাস, মানবিক মূল্যবোধের প্রসার, এসব তারই এক একটি উল্লম্ফন প্যাড। হ্যাঁ, আমাদের এখানে দুর্নীতি আছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। তবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভও আছে। বড় কথা, মানুষের অধিকারের সপক্ষে ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো একটি দ্রুত প্রসারমাণ ভাইবরেন্ট মিডিয়া রয়েছে। আমাদের নিজেদেরই নিজেদের ঘর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য অপরের সার্টিফিকেট নেওয়ার দরকার নেই। বড় কথা, বাঙালি গণতন্ত্রকে নিজেদের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ একটি সুন্দর ও উন্নত ভবিষ্যতের পানে আমরা এগিয়ে চলেছি_ এই পরম সত্য সবাইকে মানসলোকে ধারণ করতে হবে। তবেই না আমাদের এগিয়ে যাওয়ার বেগ আরও তীব্র হবে। আমরা মানশ্চক্ষু মেলে তাকালেই দেখতে পাব বাংলার আকাশ সত্যিই তারায় তারায় ভরা।
No comments