হুমায়ূন আহমেদ-আমরা তোমাকে ভুলব না
হুমায়ূন আহমেদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একটি কফিনকে ঘিরে অভূতপূর্ব লোকারণ্য! একজন সাহিত্যিক যে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে এমন গভীরভাবে স্থান করে নিতে পারেন, তা কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জানল বাংলাদেশ।
জীবদ্দশায় বিপুলসংখ্যক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছিলেন তিনি। তার একেকটি বই লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। দু'শতাধিক উপন্যাসের স্রষ্টা এ অতুলনীয় জনপ্রিয় সাহিত্যিকের জীবন যেমন ছিল বর্ণাঢ্য আর উজ্জ্বলতায় দেদীপ্যমান, মৃত্যুও তেমনি শোকের প্লাবনে ভাসিয়ে গেল সারাদেশ। গত ১৯ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত প্রায় সাড়ে ১১টায় নিউইয়র্কের হাসপাতালে তার মৃত্যুর খবর ঢাকায় পেঁৗছার পর থেকে এখনও শোকে বিহ্বল বাংলাদেশ। সে রাতেই প্রতিটি সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল আর বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রধান খবরে পরিণত হন হুমায়ূন আহমেদ। গত পাঁচদিন ধরে সব গণমাধ্যমে প্রধান খবরই রয়ে গেছেন তিনি। প্রতীক্ষায় ছিল সারাদেশ কখন আসবেন প্রিয় লেখক। এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে গতকাল সোমবার সকালে প্রিয় লেখক ফিরলেন তার জননী জন্মভূমিতে। এলেন নিথর স্পন্দনহীন দেহে। সাদা কাফনে আবৃত হয়ে কফিনবন্দি কথাশিল্পী যখন বিমানবন্দর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পেঁৗছলেন ফুলে ফুলে ছাওয়া সাদা গাড়িতে, তখনও ঝাঁকে ঝাঁকে গণমাধ্যম কর্মী অনুসরণ করেছেন সেই গাড়ি। শহীদ মিনার পরিণত হয়েছিল লোকারণ্যে। শহীদ মিনারে কোনো কফিন ঘিরে এমন লোকারণ্য দেখেনি কেউ কখনও আর। প্রিয় লেখককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা অশ্রুসিক্ত লাখো মানুষের জোয়ারে প্লাবিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে বন্ধ করে দিতে হয়েছে বেশ কয়েকটি সড়কে যান চলাচল। শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকায় নিতে হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু কেবল তার লেখার পাঠক শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে নয়, ছুঁয়ে গেছে তৃণমূল পর্যায়ের অতি সাধারণ মানুষকেও। শিশু থেকে বৃদ্ধ, মন্ত্রী থেকে কেরানি, শ্রমিক-দিনমজুর, রাজধানীবাসী থেকে সুদূর মফস্বলের মানুষ_ সবাই ছুটে এসেছিলেন প্রিয় লেখক, প্রিয় নাট্যকার, প্রিয় চলচ্চিত্রকারকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে। ফুলের দোকানগুলো ফুলশূন্য হয়ে গিয়েছিল সকাল ১১টার মধ্যেই। শহীদ মিনারের আশপাশেও টোকাইরা প্রয়াত লেখকের প্রিয় কদমফুল বিক্রি করেছে। অনেক তরুণ ভক্ত সেই ফুল নিয়েই কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, এমপি, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ থেকে সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের অগণিত ছাত্রছাত্রী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রিয় লেখকের কফিনে। চ্যানেল আইসহ অনেক টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সোয়া ২টা পর্যন্ত এ শ্রদ্ধা নিবেদনেও অনেকে দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সুযোগ পাননি কফিনের কাছে আসতে। আড়াইটায় জাতীয় ঈদগাহে জানাজায়ও একই জনস্রোত, একই ঢল। সেখানেও বঞ্চিত হয়েছেন অনেকে। কারণ দীর্ঘ ভিড় ঠেলে আসতে আসতে জানাজা শেষ। হুমায়ূন আহমেদ জীবনে যেমন, মরণেও তেমনি প্রমাণ করলেন, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষ সেই ভালোবাসার প্রতিদান দেয়। দেশকে হৃদয়ে ধারণ করলে দেশও বুকে তুলে নেয়। লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত চোখ হুমায়ূনের কফিন ঘিরে যেন একটি বাক্যই ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত করেছে_ আমরা তোমাকে ভুলব না।
No comments