নয়ন সমুখে তুমি নাই... by ড. হারুন রশীদ
মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে ব্রেকিং নিউজে সংবাদটি দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হলো, আহ্! এমন বেদনাহত কখনও হইনি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে হারিয়েছি শৈশবে।
এর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সেলিম আল দীনকে পেয়েছিলাম শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে। তাঁর চলে যাওয়াটাও খুব কষ্ট দিয়েছিল। আগামী ১৮ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। দিনটিকে সামনে রেখে তাঁর কথা মনে হচ্ছিল বার বার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর আসছিল। কিন্তু সেই খবরটা যে এতটা মর্মন্তুদ হয়ে আসবে, বিষাদের এমন করুণ রাগিণী হয়ে বাজবে; ভাবতে পারিনি। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে চলছে তাঁর চিকিৎসা। সেখানে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে সামান্য অবহেলা যে হচ্ছে না সেটা পত্র-পত্রিকা পড়েই বোঝা যাচ্ছিল। চিকিৎসার বিরতিতে কিছুদিন আগে হুমায়ূন যখন দেশে আসেন তখনও তিনি ছিলেন প্রচ- আত্মবিশ্বাসী। ‘এই ক’দিন থেকে ফিরে আসছি’ এমনই ছিল তাঁর মনোভাব। সেই মানুষটি আর ফিরবেন না, এটা চিন্তার মধ্যেই ছিল না। কিন্তু হলো তাই। হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখকের চলে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কোন ভুল সংবাদ দেবে এটা তো হতে পারে না। কিন্তু সংবাদটি যেন মিথ্যা হয় এমন চাওয়া কাজ করছিল প্রচ-ভাবে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই চ্যানেল সেই চ্যানেল ঘোরাতে থাকি। কিন্তু সব চ্যানেলেই একই খবর। সবাই ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেখাচ্ছে। এবং সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে ততই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে তিনি আর নেই। একটি চ্যানেল থেকে তো হাসপাতালের সামনে থেকেই সরাসরি তাদের রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলছিল। সেখানে হুমায়ূনের স্বজনরাও উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলছিলেন, আমাদের সামনেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা কেউ তাঁর হাত, পা, শরীর স্পর্শ করেছিলাম। আস্তে আস্তে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
অসাধারণ মেধা, সৃজনশীল ক্ষমতা আর প্রাণশক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আত্মশক্তিতে বলীয়ান ছিলেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চিত চাকরি জীবন ছেড়ে লেখকের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। নিজের ওপর কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তা কেবল তিনিই বলতে পারবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনকে। বদলে দিয়েছিল এদেশের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসকে। বদলে দিয়েছিল এদেশের হাজারও পাঠকের পাঠাভ্যাসকে।
এর পরের ইতিহাস কেবলই সাফল্যের। কেবলই এগিয়ে যাওয়ার। ছাত্রজীবনে ‘নন্দিত নরকে’ লিখে সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। সেই নন্দিত নরকের ‘নন্দিত’ শব্দটি তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে লেগে যায়। গল্প, নাটক, উপন্যাস, সিনেমা এমনকি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চিত্রকলা যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন। যশ, খ্যাতি, অর্থবিত্ত সবই এসেছে লেখালেখির হাত ধরেই। বিপুল সংখ্যক পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে তাঁকে কেন্দ্র করেই। বাংলা একাডেমীতে চিত্তরঞ্জন সাহা যে বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন, ’৮০’র দশকে এসে সেই বইমেলার প্রধান লেখক হয়ে উঠলেন হুমায়ূন আহমেদ। নিজেই হয়ে উঠলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁকে ঘিরেই মৃতপ্রায় প্রকাশনা শিল্পের পুনর্জাগরণ ঘটলো। হুমায়ূনের বই ছাপতে পারা মানেই ওই প্রকাশকের ভাগ্য খুলে যাওয়া। একটি বই পেলেই নাকি ওই প্রকাশকের বাড়ি-গাড়ি সবই হয়ে যেত। এমন মন্তব্য আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের। প্রকাশকরা টাকার বস্তা নিয়ে যেতেন হুমায়ূনের বাড়িতে এমন কথাও শোনা যায়। টাকা উঠে আসার গ্যারান্টি না থাকলে কোন ব্যবসায়ী সে পুস্তক ব্যবসায়ী হোক আর যাই হোক এত টাকা যে বিনিয়োগ করেন না তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় চার দশক ধরে দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে গেছেন বইয়ের জগতে। কোন লেখকের এক নম্বর স্থানে থেকে এতদিন ধরে নিজের পাঠক ধরে রাখার ঘটনা প্রায় বিরল।
হুমায়ূন আহমেদের বই বের হওয়া মানেই এক মেলায় তাঁর পাঁচ-সাতটি কিংবা কোন কোন বইয়ের আরও বেশি সংস্করণ বের হওয়া। আর এত সংস্করণ বের হওয়ার মানে হচ্ছে বইয়ের কাটতি। পেশাগত কারণে বইমেলার রিপোর্ট করতে হতো এক সময়। দেখতাম হুমায়ূন আহমেদের বই যে সমস্ত প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে সেগুলোতে সব সময় ভিড় লেগেই আছে। খবর সংগ্রহের জন্য ভিড় ঠেলে সেসব স্টলে ঢোকা ছিল দায়। অথচ হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রচ্ছদ ছাড়া বইমেলার নিউজ যেন সম্পূর্ণ হতো না।
তার বইয়ের প্রতি তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে একাডেমী কর্তৃপক্ষকে ভিড় সামলানোর জন্য পুলিশের সাহায্য পর্যন্ত নিতে হতো। আর একাডেমী কর্তৃপক্ষ একই কারণে অর্থাৎ ভিড় সামলানোর ভয়ে হুমায়ূন আহমেদকে অনুরোধ করতেন তিনি যেন মেলায় না আসেন। এমন পাঠকভাগ্য খুব কম লেখকেরই হয়। তাঁর লেখার এমনই জাদুকরী ক্ষমতা ছিল যে আবালবৃদ্ধবনিতা সকল শ্রেণীর মানুষ তাঁর বইয়ের পাঠক ছিলেন। সহজ-সাবলীল কথায় তিনি বাঙালী পাঠকের চিত্ত জয় করেছিলেন। উঁচুদরের পাঠক থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠকেরও মন জয় করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে’Ñএই কঠিন কাজটিই তিনি করে গেছেন অনায়াসে। তাই বিদগ্ধ পাঠক/দর্শক থেকে শুরু করে গৃহপরিচারিকা পর্যন্ত সকলেরই মন জয় করেছিল তাঁর নাটক, সিনেমা।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রচ- আমোদপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর রসবোধ ছিল সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর সাহিত্যের অন্যতম উপাদান এই রসবোধ। এমনভাবে এমন সব জটিল বিষয়কে উপস্থাপন করতেন যা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করত। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে পাঠক কখনো আনন্দে উদ্বেল হতেন, কখনো গড়িয়ে পড়তো অশ্রুজল। তাঁর হিমু সিরিজের ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ বইটি যে বছর বইমেলায় বের হলো তখন র্যাবের ক্রসফায়ার তুমুল আলোচনার বিষয়। এই বই নিয়ে রিপোর্ট করলাম ‘র্যাবকেই ক্রসফায়ারে দিলেন হুমায়ূন’। প্রথম পাতায় বক্স করে ছাপা হলো। পরেরদিন মেলায় গিয়ে দেখি মেলায় দায়িত্বরত র্যাব সদস্যরা বইটি হাতে নিয়ে বসে আছে। যখনই সময় পাচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে পড়ে নিচ্ছে। এই হলো হুমায়ূনের লেখার শৈলী। অন্য কোন লেখক বইটি লেখলে তা নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু উপস্থাপন ভঙ্গির কারণে তা উতরে গেছে।
উপন্যাসের পর নাটক লেখায় হাত দেন হুমায়ূন। ’৮০’র দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান তিনি। এরপর বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাতের মতো জনপ্রিয় নাটকও লেখেন তিনি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে রাজপথে মিছিল হয়; যা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। একটি নাটকের চরিত্র দর্শকদের কাছে এতটা মন জয় করতে পারে এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। তখন ছিল এরশাদ জমানা। নাটকটির শেষপর্ব যেদিন প্রচারিত হয় নিরাপত্তার কারণে হুমায়ূন আহমেদকে আর্মি দিয়ে তার বাড়ি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। খ্যাতির বিড়ম্বনা আর কাকে বলে!
নাটক লেখার এক পর্যায়ে নির্দেশনায়ও নামেন হুমায়ূন। ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে শুরু করে শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামলছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। লেখালেখির মতো চলচ্চিত্রেও সফলতার পরিচয় দেন তিনি। দর্শকের ভালবাসা ছাড়াও জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি। তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। স্বাভাবিকভাবেই তার লেখার একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে বাঙালীর আবেগমথিত সেই হিরন্ময় সময়ের কথা। তাঁর বই পড়ে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আজ যে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে তরুণ প্রজন্মই এই বিচারের জন্য জোর দাবি তুলেছে। হুমায়ূন আহমেদের বই এক্ষেত্রে অনেকটাই নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। যখন ‘রাজাকার’ শব্দটি গণমাধ্যমে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, তখন নাটকে পাখির মুখ দিয়ে তিনি কৌশলে ‘তুই রাজাকার’ বলিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে আমাদের প্রকাশনা শিল্প এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছিল। বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার সন্ধান দিয়েছিলেন তিনি। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন তিনি। আজ তিনি নেই । এই শূন্যতা কি দিয়ে পূরণ হবে সেটাই ভাবনার বিষয়। যে বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তিনি গড়ে তুলেছিলেন তারা আর হুমায়ূনের নতুন কোন বই পড়তে পারবে না। প্রকাশকরা অনেকেই হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরেই তাদের প্রকাশনার জগতকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। ব্যবসায়িক দিক থেকে তারাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন নিশ্চয়।
বর্তমান মহাজোট সরকার জাতিসংঘ মিশনে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিল তাঁকে। চিকিৎসাধীন থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেই সময় তাকে কলম উপহার দেন। আবেগাপ্লুত হুমায়ূন খুবই খুশি হয়েছিলেন এই ঘটনায়। বলেছিলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী যখন আসেন তখন তিনি বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের ভালবাসা সঙ্গে নিয়ে আসেন। কাজেই এই ভালবাসাকে উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। সত্যি, হুমায়ূন আহমেদ, এদেশের মানুষ আপনাকে অনেক অনেক ভালবাসে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একসাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য ভালবাসা দেখাবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই আপনাকে ভুলবার কোন অবকাশ নেই। আপনার সৃষ্টির কিরণচ্ছটার মধ্যেই আপনি বেঁচে থাকবেন। আপনার প্রিয় নুহাশ পল্লীতে গিয়ে আপনার প্রকৃতিপ্রেম দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে ঔষধি গাছের সংগ্রহ সত্যি প্রশংসনীয়। প্রতিটি বৃক্ষের জন্ম-পরিচয়ও লেখা আছে। সেদিন আপনি নুহাশ পল্লীতেই ছিলেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। আপনি নিতৃভচারী ছিলেন। একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনার নিভৃতচারিতা ভাঙতে চাইনি। আজ মনে হচ্ছেÑইস্, কেন যে গেলাম না! জিজ্ঞেস করলাম না, কি করে লেখেন এমন সব জাদুকরী লেখা?
রবীন্দ্রনাথকে আপনি বড় বেশি ভালবাসতেন। অনেক সৃষ্টিকর্মের নাম রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের কোন না কোন চরণ থেকেই। সেই রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়েই চোখের জলের নোনা গাঙের পাড়ে দাঁড়িয়ে বলতে চাইÑনয়ন সমুখে তুমি নাই/ নয়নেরও মাঝখানে নিয়েছ ঠাঁই...
harun_press@yahoo.com
অসাধারণ মেধা, সৃজনশীল ক্ষমতা আর প্রাণশক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আত্মশক্তিতে বলীয়ান ছিলেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চিত চাকরি জীবন ছেড়ে লেখকের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। নিজের ওপর কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তা কেবল তিনিই বলতে পারবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনকে। বদলে দিয়েছিল এদেশের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসকে। বদলে দিয়েছিল এদেশের হাজারও পাঠকের পাঠাভ্যাসকে।
এর পরের ইতিহাস কেবলই সাফল্যের। কেবলই এগিয়ে যাওয়ার। ছাত্রজীবনে ‘নন্দিত নরকে’ লিখে সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। সেই নন্দিত নরকের ‘নন্দিত’ শব্দটি তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে লেগে যায়। গল্প, নাটক, উপন্যাস, সিনেমা এমনকি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চিত্রকলা যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন। যশ, খ্যাতি, অর্থবিত্ত সবই এসেছে লেখালেখির হাত ধরেই। বিপুল সংখ্যক পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে তাঁকে কেন্দ্র করেই। বাংলা একাডেমীতে চিত্তরঞ্জন সাহা যে বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন, ’৮০’র দশকে এসে সেই বইমেলার প্রধান লেখক হয়ে উঠলেন হুমায়ূন আহমেদ। নিজেই হয়ে উঠলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁকে ঘিরেই মৃতপ্রায় প্রকাশনা শিল্পের পুনর্জাগরণ ঘটলো। হুমায়ূনের বই ছাপতে পারা মানেই ওই প্রকাশকের ভাগ্য খুলে যাওয়া। একটি বই পেলেই নাকি ওই প্রকাশকের বাড়ি-গাড়ি সবই হয়ে যেত। এমন মন্তব্য আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের। প্রকাশকরা টাকার বস্তা নিয়ে যেতেন হুমায়ূনের বাড়িতে এমন কথাও শোনা যায়। টাকা উঠে আসার গ্যারান্টি না থাকলে কোন ব্যবসায়ী সে পুস্তক ব্যবসায়ী হোক আর যাই হোক এত টাকা যে বিনিয়োগ করেন না তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় চার দশক ধরে দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে গেছেন বইয়ের জগতে। কোন লেখকের এক নম্বর স্থানে থেকে এতদিন ধরে নিজের পাঠক ধরে রাখার ঘটনা প্রায় বিরল।
হুমায়ূন আহমেদের বই বের হওয়া মানেই এক মেলায় তাঁর পাঁচ-সাতটি কিংবা কোন কোন বইয়ের আরও বেশি সংস্করণ বের হওয়া। আর এত সংস্করণ বের হওয়ার মানে হচ্ছে বইয়ের কাটতি। পেশাগত কারণে বইমেলার রিপোর্ট করতে হতো এক সময়। দেখতাম হুমায়ূন আহমেদের বই যে সমস্ত প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে সেগুলোতে সব সময় ভিড় লেগেই আছে। খবর সংগ্রহের জন্য ভিড় ঠেলে সেসব স্টলে ঢোকা ছিল দায়। অথচ হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রচ্ছদ ছাড়া বইমেলার নিউজ যেন সম্পূর্ণ হতো না।
তার বইয়ের প্রতি তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে একাডেমী কর্তৃপক্ষকে ভিড় সামলানোর জন্য পুলিশের সাহায্য পর্যন্ত নিতে হতো। আর একাডেমী কর্তৃপক্ষ একই কারণে অর্থাৎ ভিড় সামলানোর ভয়ে হুমায়ূন আহমেদকে অনুরোধ করতেন তিনি যেন মেলায় না আসেন। এমন পাঠকভাগ্য খুব কম লেখকেরই হয়। তাঁর লেখার এমনই জাদুকরী ক্ষমতা ছিল যে আবালবৃদ্ধবনিতা সকল শ্রেণীর মানুষ তাঁর বইয়ের পাঠক ছিলেন। সহজ-সাবলীল কথায় তিনি বাঙালী পাঠকের চিত্ত জয় করেছিলেন। উঁচুদরের পাঠক থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠকেরও মন জয় করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে’Ñএই কঠিন কাজটিই তিনি করে গেছেন অনায়াসে। তাই বিদগ্ধ পাঠক/দর্শক থেকে শুরু করে গৃহপরিচারিকা পর্যন্ত সকলেরই মন জয় করেছিল তাঁর নাটক, সিনেমা।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রচ- আমোদপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর রসবোধ ছিল সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর সাহিত্যের অন্যতম উপাদান এই রসবোধ। এমনভাবে এমন সব জটিল বিষয়কে উপস্থাপন করতেন যা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করত। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে পাঠক কখনো আনন্দে উদ্বেল হতেন, কখনো গড়িয়ে পড়তো অশ্রুজল। তাঁর হিমু সিরিজের ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ বইটি যে বছর বইমেলায় বের হলো তখন র্যাবের ক্রসফায়ার তুমুল আলোচনার বিষয়। এই বই নিয়ে রিপোর্ট করলাম ‘র্যাবকেই ক্রসফায়ারে দিলেন হুমায়ূন’। প্রথম পাতায় বক্স করে ছাপা হলো। পরেরদিন মেলায় গিয়ে দেখি মেলায় দায়িত্বরত র্যাব সদস্যরা বইটি হাতে নিয়ে বসে আছে। যখনই সময় পাচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে পড়ে নিচ্ছে। এই হলো হুমায়ূনের লেখার শৈলী। অন্য কোন লেখক বইটি লেখলে তা নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু উপস্থাপন ভঙ্গির কারণে তা উতরে গেছে।
উপন্যাসের পর নাটক লেখায় হাত দেন হুমায়ূন। ’৮০’র দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান তিনি। এরপর বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাতের মতো জনপ্রিয় নাটকও লেখেন তিনি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে রাজপথে মিছিল হয়; যা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। একটি নাটকের চরিত্র দর্শকদের কাছে এতটা মন জয় করতে পারে এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। তখন ছিল এরশাদ জমানা। নাটকটির শেষপর্ব যেদিন প্রচারিত হয় নিরাপত্তার কারণে হুমায়ূন আহমেদকে আর্মি দিয়ে তার বাড়ি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। খ্যাতির বিড়ম্বনা আর কাকে বলে!
নাটক লেখার এক পর্যায়ে নির্দেশনায়ও নামেন হুমায়ূন। ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে শুরু করে শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামলছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। লেখালেখির মতো চলচ্চিত্রেও সফলতার পরিচয় দেন তিনি। দর্শকের ভালবাসা ছাড়াও জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি। তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। স্বাভাবিকভাবেই তার লেখার একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে বাঙালীর আবেগমথিত সেই হিরন্ময় সময়ের কথা। তাঁর বই পড়ে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আজ যে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে তরুণ প্রজন্মই এই বিচারের জন্য জোর দাবি তুলেছে। হুমায়ূন আহমেদের বই এক্ষেত্রে অনেকটাই নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। যখন ‘রাজাকার’ শব্দটি গণমাধ্যমে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, তখন নাটকে পাখির মুখ দিয়ে তিনি কৌশলে ‘তুই রাজাকার’ বলিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে আমাদের প্রকাশনা শিল্প এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছিল। বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার সন্ধান দিয়েছিলেন তিনি। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন তিনি। আজ তিনি নেই । এই শূন্যতা কি দিয়ে পূরণ হবে সেটাই ভাবনার বিষয়। যে বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তিনি গড়ে তুলেছিলেন তারা আর হুমায়ূনের নতুন কোন বই পড়তে পারবে না। প্রকাশকরা অনেকেই হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরেই তাদের প্রকাশনার জগতকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। ব্যবসায়িক দিক থেকে তারাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন নিশ্চয়।
বর্তমান মহাজোট সরকার জাতিসংঘ মিশনে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিল তাঁকে। চিকিৎসাধীন থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেই সময় তাকে কলম উপহার দেন। আবেগাপ্লুত হুমায়ূন খুবই খুশি হয়েছিলেন এই ঘটনায়। বলেছিলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী যখন আসেন তখন তিনি বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের ভালবাসা সঙ্গে নিয়ে আসেন। কাজেই এই ভালবাসাকে উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। সত্যি, হুমায়ূন আহমেদ, এদেশের মানুষ আপনাকে অনেক অনেক ভালবাসে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একসাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য ভালবাসা দেখাবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই আপনাকে ভুলবার কোন অবকাশ নেই। আপনার সৃষ্টির কিরণচ্ছটার মধ্যেই আপনি বেঁচে থাকবেন। আপনার প্রিয় নুহাশ পল্লীতে গিয়ে আপনার প্রকৃতিপ্রেম দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে ঔষধি গাছের সংগ্রহ সত্যি প্রশংসনীয়। প্রতিটি বৃক্ষের জন্ম-পরিচয়ও লেখা আছে। সেদিন আপনি নুহাশ পল্লীতেই ছিলেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। আপনি নিতৃভচারী ছিলেন। একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনার নিভৃতচারিতা ভাঙতে চাইনি। আজ মনে হচ্ছেÑইস্, কেন যে গেলাম না! জিজ্ঞেস করলাম না, কি করে লেখেন এমন সব জাদুকরী লেখা?
রবীন্দ্রনাথকে আপনি বড় বেশি ভালবাসতেন। অনেক সৃষ্টিকর্মের নাম রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের কোন না কোন চরণ থেকেই। সেই রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়েই চোখের জলের নোনা গাঙের পাড়ে দাঁড়িয়ে বলতে চাইÑনয়ন সমুখে তুমি নাই/ নয়নেরও মাঝখানে নিয়েছ ঠাঁই...
harun_press@yahoo.com
No comments