রমজানুল মুবারকের ফজিলত ও মরতবা by মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

হজরত রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি শুধু সওয়াবের নিয়তে রোজা রাখবে তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। হজরত রাসুলে পাক (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, 'রোজাদার ব্যক্তির মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়ে উত্তম। রোজাদাররা কেয়ামতের দিন অসীম সওয়াবের অধিকারী হবে।'


রোজাদারদের জন্য কেয়ামতের দিন আরশের নিচে দস্তরখানা বিছানো হবে। সেখানে তারা খানাপিনা করতে থাকবে। অন্য লোকরা তখনো হিসাব-নিকাশের মধ্যে জড়িত থাকবে। তারা এটা দেখে বলবে, একি! এরা দেখছি খানাপিনা করছে, অথচ আমাদের তো এখনো হিসাবই শেষ হয়নি। তাদের বলা হবে, তারা দুনিয়ায় রোজা রাখত। আর তোমরা দুনিয়ায় রোজা ছেড়ে দিয়েছিলে।
রোজা ইসলামের একটি প্রধান রুকন বা স্তম্ভ। রমজান মাসে যে রোজা তরক করবে, সে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে বড় গুনাহগার হবে। হাদিস শরিফে আছে, রোজাদারের ঘুম ইবাদত এবং তার চুপ থাকা তাসবিহ পাঠের সমান। অর্থাৎ রোজার কারণে দুনিয়াবি বাজে কথাবার্তা না বলে যে চুপ থাকে সে সোবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ প্রভৃতি তাসবিহ পাঠের সওয়াব পাবে এবং তাকে তার সওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তার দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হবে এবং তার সগিরা গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। হজরত রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, রোজা গুনাহের জন্য ঢাল ও দুর্গস্বরূপ। অর্থাৎ রোজা এমনই একটি ইবাদত, এর কারণে বহু গুনাহ থেকে বাঁচা যায়। রোজার বরকতে মানুষের মধ্যে আল্লাহর রহমত নেমে আসে, গুনাহের কাজের প্রতি আপনা থেকে ঘৃণার উদ্রেক হয়। রোজার কারণে প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নেকির আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
হজরত (সা.) বলেছেন, ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়। অন্য হাদিসে আছে, হজরত (সা.) বলেছেন, 'কেয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির খাবারের হিসাব গ্রহণ করা হবে না- ১. রোজাদার ব্যক্তির হালাল খাবার, ২. রোজার জন্য সেহরি খাওয়া, ৩. ইসলামী রাজ্য রক্ষার কাজে নিয়োজিত মুজাহিদদের খাবার।'
দেখুন! রোজা আল্লাহর কাছে কত প্রিয়। কেয়ামতে আল্লাহ রোজার কোনো হিসাব গ্রহণ করবেন না। তবে আল্লাহ এ অবকাশ দিয়েছেন বলে খানাপিনায় খুব বেশি বিলাসিতা করা উচিত নয়, কেননা অধিক সুস্বাদু খাবার খেলে আল্লাহর জিকির ও ইবাদতে গাফিলতি আসার শঙ্কা আছে এবং গুনাহের প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়।
হাদিস শরিফে আছে, রোজাদার ব্যক্তিকে যে ইফতার করায় সে রোজাদার ব্যক্তির সমান সওয়াব লাভ করে। এতে রোজাদারের সওয়াব দুই রকম হবে না। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, বনি আদমের নেককার মুমিনদের জন্য প্রতিটি নেকির পরিবর্তে ১০ থেকে ৭০০ গুণ সওয়াব প্রদানের কথা বর্ণিত হয়েছে। তবে রোজার জন্য সওয়াবের কোনো সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। আল্লাহ পাক বলেছেন, 'রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর পুরস্কার দেব।' অর্থাৎ আল্লাহ এর জন্য কী পরিমাণ সওয়াব দান করবেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। তিনি নিজেই রোজাদারদের সওয়াব ও পুরস্কার দানের ব্যবস্থা ফেরেশতাদের মাধ্যমে সম্পন্ন না করে নিজের হাতেই করবেন। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, রোজার এই সওয়াব ও ফজিলত লাভের জন্য রোজার হক পূর্ণভাবে আদায় করতে হবে। অর্থাৎ মিথ্যা কথা না বলা, গিবত না করা এবং রোজার মধ্যে সব নিষিদ্ধ ও মাকরুহ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকে শেষ রাতে বেশি পরিমাণ সেহরি খেয়ে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, ফজরের নামাজ কাজা করে ফেলে। এতে রোজার সওয়াব লাঘব হয়। শুধু তা-ই নয়, এতে গুনাহের ভাগীদার হতে হয়।
হাদিস শরিফে আছে, রোজাদার ব্যক্তি দুটি খুশি অর্জন করবে। একটি রোজার ইফতারের সময়, আরেকটি কেয়ামতে আল্লাহর সঙ্গে দিদারের সময়।
হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, রমজানের প্রথম রাতে আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং শেষ রাতেও তা বন্ধ হয় না। রমজানের রাতে যে নফল নামাজ পড়ে তার আমলনামায় আড়াই হাজার নেকি লিপিবদ্ধ হয়। তার জন্য বেহেশতে লাল ইয়াকুত পাথরের একটি মহল তৈরি করা হবে, এর ৬০টি দরজা হবে, প্রতিটি দরজার জন্য একটি সোনার মহল হবে। রোজাদার ব্যক্তি যেদিন প্রথম রোজা রাখে, সেদিনই তার সব সগিরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তার জন্য প্রত্যহ ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা আল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইতে থাকে। যে রোজাদার ব্যক্তি রোজার দিনে অথবা রাতে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে, তার বিনিময়ে বেহেশতে জন্ম নেবে একটি গাছ। ৫০০ বছর পর্যন্ত চললেও যার ছায়া ফুরাবে না। দেখুন, ইমানদার ভাইয়েরা! আল্লাহ রোজাদারদের জন্য কী পরিমাণ সওয়াব রেখেছেন। সুতরাং এই রোজাকে যে অবজ্ঞা, অবহেলা কিংবা অমান্য করে, তার মতো বদনসিব আর কার আছে?
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রমজান মাসের জন্য বেহেশত বছরের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাজানো হতে থাকে এবং রমজানের রোজা পালনকারী মুমিনদের জন্য ডাগরনয়না হুররা সাজসজ্জা করতে থাকে। বেহেশত বলতে থাকে- 'হে আল্লাহ! তোমার রোজাদার বান্দাদের আমার মধ্যে স্থান দান করো' এবং ডাগরনয়না হুররা বলতে থাকে, 'হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য তাদের স্বামী নির্ধারণ করো।' সুতরাং যারা খাঁটিভাবে রোজা আদায় করবে, কারো গিবত-শিকায়াত করবে না, কোনো নেশাদ্রব্য পান করবে না, তাদের সব গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি এই রোজার মাসে অন্যের গিবত-শিকায়াত করবে এবং নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করবে, আল্লাহ তার সব নেকি মিটিয়ে দেবেন। এই পবিত্র মাসে যেমন নেকি বেশি তেমনি গুনাহ করলে তার আজাবও বেশি হবে। কেননা রমজান মাস আল্লাহর বিশেষ মাস। এর অর্থ এই যে, বান্দা এ মাসে প্রতিদিন কিছু খানাপিনা ত্যাগ করে আল্লাহর স্বভাব এখতিয়ার করে থাকে, কেননা আল্লাহ খানাপিনা থেকে সব সময় পবিত্র। এ জন্য এ মাসকে আল্লাহর খাস বা বিশেষ মাস বলা হয়। নতুবা সব মাসই তো আল্লাহর।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ সীরাত মিশন

No comments

Powered by Blogger.