হামলার ভয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের পুরুষরা পালিয়ে বেড়ায়- ২০০১-এর নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা by মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

(পূর্ব প্রকাশের পর) সম্পত্তি ধ্বংস/সম্পত্তি লুট/জমিজমা দখল ইত্যাদি : তদন্তকালে জানা গেছে নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতা-কর্মী সমর্থকদের সম্পত্তি যেমন লুট করা হয়েছে তেমনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, দোকান, শিল্প, কৃষিজমি, গবাদিপশু, বাগান ও মাছের ঘের-পুকুর থেকেও সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি লুট হয়েছে।


লুটপাট করার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে বাড়িঘর, দোকান-পাট, জমিজমা ও লিজ নেওয়া জলাশয় ইত্যাদিও দখল করা হয়। লুটপাট ঘটনা বেশি ঘটেছে খুলনা বিভাগে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল, বরিশাল বিভাগের প্রায় পুরোটায় এবং চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণ অঞ্চলে।
লুটতরাজের ঘটনার মতই আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সম্পত্তি ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। তাদের বাড়িতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, শিল্প, কৃষি জমিতে এসব ঘটনা ঘটেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পুরো প্রতিষ্ঠান এবং এর ভেতরের জিনিসপত্র আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে।
দৈহিক/শারীরিক নির্যাতন : দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা শুরু হয় প্রধানত নির্বাচনের পর। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুরু হয়ে যায়। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের আতঙ্ক নির্বাচনের পূর্বেই শুরু হয়। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়া শুরু হলেই বিভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। জোট সরকারের সন্ত্রাসীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারের বিশেষ সদস্য/সদস্যাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে থাকে। রাস্তায় তাদের অনুসরণ করা হয়। অথবা ঘোষণা দেয়া হয়, আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য তাদেরকে আক্রমণ করা হবে। সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা হিসেবে অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক আত্মগোপন করে। কোন কোন পরিবার তাদের অবিবাহিত মেয়েদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেয়। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ভয়ে মূলত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়েছে। কোন কোন পুরুষ হামলার ভয়ে দিনে বা রাত্রে বাড়ির বাইরে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই হামলা পরিকল্পিত ছিল বলে তদন্ত কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঘটনাক্রমে হামলাকারী তার শিকার পেয়ে হামলা করেছে। হামলাকারীরা লোহার রড, রামদা, চাকু, বল্লম, লাঠি, হাতুড়ি ইত্যাদি বেশি ব্যবহার করে। শার্টের কলার ধরে; ঠেলা-ধাক্কা মেরে, চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, লাথি মেরেও অনেককে নির্যাতন করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের ফলে অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছেন এমনকি পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
সন্ত্রাসীরা অনেক ক্ষেত্রে শিশু থেকে শুরু করে বিবাহিত মহিলাদের পর্যন্ত ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। যদিও সামাজিক অবস্থা ও লোক লজ্জার ভয়ে অনেকেই এই নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেনি বা আইনের আশ্রয় নেয়নি।

বাসস্থান ত্যাগ করা :
যে সব ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বাসস্থান ত্যাগ করেছে, প্রায় সবগুলো ঘটনায় তারা নিজেরাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয় এবং অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানো হয়। চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভিন্ন প্রবণতা দেখা যায় (ছক-১)।
বলা হয়, চলে না গেলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদেরকে হত্যা করা হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাও জানতে পারেননি তাদের প্রিয়জন কোথায় গেছেন। দেশের ভেতর নিকটবর্তী গ্রাম অথবা শহর/নগরে যাওয়ার পাশাপাশি কেউ কেউ ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চলে যান। (চলবে)
লেখক : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ

No comments

Powered by Blogger.