সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চাঁদাবাজি by বদরুদ্দীন উমর
শুধু বিশ্বব্যাংকই নয়, এডিবি ও জাপান সরকারও এই একই দাবি করায় বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল সরকার এখন ঋণদাতাদের মেজাজ নরম করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে। অবস্থা দেখে মনে হয় শুধু এই একটি শর্তই নয়, অন্যান্য শর্তও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েই সরকারকে আবার বিশ্বব্যাংক, এডিবি
ইত্যাদির দ্বারস্থ হয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হবে। কিন্তু এ স্বপ্ন জলাঞ্জলি এবং অপরিপকস্ফ কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও একে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির যে নতুন হিড়িক শুরু হয়েছে তা যে সাধারণভাবে চাঁদাবাজির ব্যাপকতা দেশে আরও বাড়িয়ে তুলবে এতে সন্দেহ নেই
দুর্নীতির একটা রূপ হচ্ছে ঘুষ। ঘুষ খাওয়া সম্ভব হয় তখনই যখন কেউ কোনো দায়িত্বশীল কাজে নিযুক্ত থাকে। এ কাজে নিযুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন চাকরির যে শর্ত অনুযায়ী করা দরকার সেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না করে তার জন্য অর্থ দাবি এবং আদায় করার নাম ঘুষ। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর চুরির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'কাহারও দ্রব্য না বলিয়া লওয়াকে চুরি বলে।' অন্যের দ্রব্য অপহরণের অন্য এক পরিচিত রূপ হলো ডাকাতি। ডাকাতির জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় না। দ্রব্য মালিকের উপস্থিতিতে অথবা অনুপস্থিতিতে সশস্ত্র হামলা করে তার দ্রব্য অপহরণ করাকে ডাকাতি বলে। পথের মধ্যে কারও দ্রব্যের ওপর এভাবে হামলা করে কেড়ে নেওয়াকে বলে রাহাজানি।
দুর্নীতির শত রূপ। এর একটি সাম্প্রতিক রূপ হচ্ছে চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির জন্য কোনো পদে নিযুক্ত থাকার প্রয়োজন হয় না। কাজেই এটা ঘুষ নয়। চাঁদাবাজিকে ডাকাতি বা রাহাজানিও বলা চলে না। এ হলো ঘুষ ও ডাকাতির মধ্যবর্তী। চাঁদাবাজিতে ডাকাতের মতো জোট বাঁধার দরকার হয়। কিন্তু ডাকাতের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক থাকে না। চাঁদাবাজির জন্য প্রয়োজন হয় কোনো না কোনো ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কের। সাধারণত ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিতরাই কোনো না কোনোভাবে জোটবদ্ধ হয়ে চাঁদাবাজি করে।
এই চাঁদাবাজিরও অনেক ধরন। রাস্তায় ট্রাক-বাস থামিয়ে চাঁদাবাজি বাংলাদেশে এখন ব্যাপক আকারে হচ্ছে। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এ কারণে ব্যবসায়ীরা রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজির কথা বলে থাকেন। রাহাজানি না হলেও এই ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে রাহাজানির একটা মিল আছে। ধর্মের কথা বলে চাঁদাবাজি বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের এক পরিচিত ব্যাপার। এ ধরনের চাঁদাবাজি পশ্চিমবঙ্গে পুজোর সময় ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মিলাদের নাম করেও চাঁদাবাজি হয়। ধর্মের নামে চাঁদা তুলে তার কিছুটা পুজো বা মিলাদে খরচ হলেও বাকিটা চাঁদাবাজদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। অনেক সময় টাকা ভাগাভাগি হয় কিছু না করেও।
চাঁদাবাজি বাংলাদেশে খুব ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের দ্বারা। অনেক সময় চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে লোকেরা সরকারের সমর্থক হয়। এভাবেই বাংলাদেশে এখন চাঁদাবাজি এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যার কোনো তুলনা আগে কোনোদিন দেখা যায়নি। পাকিস্তানি আমলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের লোকেরা চাঁদাবাজি করেছেন এমন কোনো উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নেই। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে চাঁদাবাজি এমনভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, যাকে দুর্নীতির একটি বিপজ্জনক প্রকার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্বাচিত সরকারগুলোর আমলে চাঁদাবাজি নতুনভাবে শুরু হয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যা ক্ষমতাসীন দলটির জন্যও পরিণত হয়েছে এক বড় সমস্যার। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আজ আওয়ামী লীগেরও ক্ষমতা নেই তাদের ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করার। ঢাকা এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেন্ডারবাজি হলো চাঁদাবাজির একটা ধরন। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এটা হলো তারই এক অতি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। পাকিস্তানি আমলে ছাত্ররা রাজনীতি করত কিন্তু কারও পকেটের দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল না। এখন শুধু টেন্ডারবাজিই নয়, শিক্ষা প্রশাসনে নানাভাবে হস্তক্ষেপও হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্র দুর্নীতির একটা ধরন। আগেকার দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ব্যাপারে ছাত্রদের হস্তক্ষেপ ছিল তাদের চিন্তার বাইরে।
কাজের অভাবকে চাঁদাবাজি এবং অন্য ধরনের দুর্নীতির একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ছাত্রদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। ছাত্ররা ছাত্রজীবনে কোনো সময়েই কাজ করে না। তবে যারা গরিব তারা কেউ কেউ ছাত্র অবস্থায় বরাবরই টিউশনি করে নিজেদের খরচ চালিয়েছে এবং এখনও তারা কেউ কেউ সেটা করে থাকে। কিন্তু চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি অন্য জিনিস। এটা এক ধরনের দুষ্কৃতি যা লোভ-লালসার সঙ্গেই সম্পর্কিত। সারা সমাজজুড়ে এখন লুটতরাজের যে হুলস্থূল চলছে এ হলো সেই লুটতরাজেরই ছাত্র সংস্করণ।
কোনো সমাজেই ব্যাপক লুটতরাজ চলতে পারে না যদি শাসক শ্রেণী ও তাদের সরকারের মধ্যে লুটতরাজের প্রক্রিয়া না থাকে। প্রথম থেকেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও শাসক দলের মধ্যে লুটতরাজ শুরু হওয়া এবং চলতে থাকার কারণে ক্রমশ এই প্রক্রিয়া সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃত্বের লুটতরাজ নিম্ন পর্যায়ে পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন আজ যেভাবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে লুটতরাজ করছে এটা সম্ভব হতো না যদি নেতৃত্বের লুটতরাজের প্রভাব তাদের আচ্ছন্ন না করত। কাজেই আওয়ামী লীগ আজ তাদের ছাত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তার জন্য সন্ত্রাস বন্ধ করতে অপারগ হলেও এসবের মূল কারণ হলো, তাদের নেতৃত্বের লুটতরাজ। তারা যদি সাধু-সন্ত হতো তাহলে তাদের নিচের স্তরের নেতাকর্মীরা, বিশেষত তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা এভাবে বেপরোয়া চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করত না।
পদ্মা সেতু প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি এখন নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংক ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থ সংস্থা এডিবি ইত্যাদি দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সকলের কাছে এর জন্য গঠিত তহবিলে অর্থ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই আহ্বান যে চাঁদাবাজিকে উৎসাহিত করবে ও বাড়িয়ে তুলবে এটা জানা কথা। এটাই স্বাভাবিক। কাজেই সেটাই এখন ঘটছে। আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর ব্যাপার যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বয়ং উপাচার্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এক সমাবেশে পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তোলা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন! এর সচিত্র রিপোর্টও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চাঁদার বাক্স হাতে বেরিয়ে পড়ে। চাঁদা তোলার পর পদ্মা সেতুর তহবিলে সেটা জমা দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির সময় তাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে সরকারের যে পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল তা নেওয়া হয়নি। যদিও এ ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর জন্য সরকার গঠিত তহবিলে চাঁদা দেওয়ার আহ্বান জানানোর পর এ ধরনের ঘটনা যে বন্ধ হয়নি তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ঢাকার মনিপুর স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ছাত্রদের থেকে জোরপূর্বক পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা আদায়। এই মর্মে আজ একটি রিপোর্ট সংবাদপত্রে বড় আকারে প্রকাশিত হয়েছে (ডেইলি স্টার, ২৩.৭.২০১২)। এতে দেখা যায়, স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের ৫০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে বাধ্য করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের কোনো নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও এটা হচ্ছে। এভাবে এটা ঘটা যে চরম দুর্নীতির ব্যাপার এতে সন্দেহ নেই। সরকার এই ঘটনার পর স্কুল কর্তৃপক্ষকে তিনদিনের মধ্যে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু এর ফলে এই বিশেষ স্কুলটিতে চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও দেশজুড়ে চাঁদাবাজির যে আবহাওয়া তৈরি হয়েছে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নকে কেন্দ্র করে, সেটা সরকারেরই তৈরি। তাদের তৈরি করা এই আবহাওয়া পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। কাজেই অঘোষিতভাবে এবং অপ্রকাশিতভাবে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য চাঁদাবাজি দেশজুড়েই চলছে।
এদিকে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরিকরণেওয়ালারা এই কর্মসূচির অসম্ভাব্যতা বাস্তবে উপলব্ধি করে আবার বিশ্বব্যাংক এবং অন্য সাম্রাজ্যবাদী অর্থ সংস্থাগুলোর কাছে ধর্ণা দিতে শুরু করেছে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর বহুমুখী কথাবার্তা দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের সরকার আসলে কী করতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকের ঋণ বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নের কথা বলছেন। কিন্তু তাদের অর্থমন্ত্রী এখন বলছেন, বিশ্বব্যাংকের চার শর্তের অন্যতম কয়েকজন সরকারি আমলা এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে তার বর্তমান মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ছুটি দেওয়ার কথা। শুধু বিশ্বব্যাংকই নয়, এডিবি ও জাপান সরকারও এই একই দাবি করায় বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল সরকার এখন ঋণদাতাদের মেজাজ নরম করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। অবস্থা দেখে মনে হয় শুধু এই একটি শর্তই নয়, অন্যান্য শর্তও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েই সরকারকে আবার বিশ্বব্যাংক, এডিবি ইত্যাদির দ্বারস্থ হয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হবে। কিন্তু এ স্বপ্ন জলাঞ্জলি এবং অপরিপকস্ফ কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও একে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির যে নতুন হিড়িক শুরু হয়েছে তা যে সাধারণভাবে চাঁদাবাজির ব্যাপকতা দেশে আরও বাড়িয়ে তুলবে এতে সন্দেহ নেই।
২৩.৭.২০১২
দুর্নীতির একটা রূপ হচ্ছে ঘুষ। ঘুষ খাওয়া সম্ভব হয় তখনই যখন কেউ কোনো দায়িত্বশীল কাজে নিযুক্ত থাকে। এ কাজে নিযুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন চাকরির যে শর্ত অনুযায়ী করা দরকার সেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না করে তার জন্য অর্থ দাবি এবং আদায় করার নাম ঘুষ। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর চুরির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'কাহারও দ্রব্য না বলিয়া লওয়াকে চুরি বলে।' অন্যের দ্রব্য অপহরণের অন্য এক পরিচিত রূপ হলো ডাকাতি। ডাকাতির জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় না। দ্রব্য মালিকের উপস্থিতিতে অথবা অনুপস্থিতিতে সশস্ত্র হামলা করে তার দ্রব্য অপহরণ করাকে ডাকাতি বলে। পথের মধ্যে কারও দ্রব্যের ওপর এভাবে হামলা করে কেড়ে নেওয়াকে বলে রাহাজানি।
দুর্নীতির শত রূপ। এর একটি সাম্প্রতিক রূপ হচ্ছে চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির জন্য কোনো পদে নিযুক্ত থাকার প্রয়োজন হয় না। কাজেই এটা ঘুষ নয়। চাঁদাবাজিকে ডাকাতি বা রাহাজানিও বলা চলে না। এ হলো ঘুষ ও ডাকাতির মধ্যবর্তী। চাঁদাবাজিতে ডাকাতের মতো জোট বাঁধার দরকার হয়। কিন্তু ডাকাতের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক থাকে না। চাঁদাবাজির জন্য প্রয়োজন হয় কোনো না কোনো ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কের। সাধারণত ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিতরাই কোনো না কোনোভাবে জোটবদ্ধ হয়ে চাঁদাবাজি করে।
এই চাঁদাবাজিরও অনেক ধরন। রাস্তায় ট্রাক-বাস থামিয়ে চাঁদাবাজি বাংলাদেশে এখন ব্যাপক আকারে হচ্ছে। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এ কারণে ব্যবসায়ীরা রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজির কথা বলে থাকেন। রাহাজানি না হলেও এই ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে রাহাজানির একটা মিল আছে। ধর্মের কথা বলে চাঁদাবাজি বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের এক পরিচিত ব্যাপার। এ ধরনের চাঁদাবাজি পশ্চিমবঙ্গে পুজোর সময় ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মিলাদের নাম করেও চাঁদাবাজি হয়। ধর্মের নামে চাঁদা তুলে তার কিছুটা পুজো বা মিলাদে খরচ হলেও বাকিটা চাঁদাবাজদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। অনেক সময় টাকা ভাগাভাগি হয় কিছু না করেও।
চাঁদাবাজি বাংলাদেশে খুব ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের দ্বারা। অনেক সময় চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে লোকেরা সরকারের সমর্থক হয়। এভাবেই বাংলাদেশে এখন চাঁদাবাজি এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যার কোনো তুলনা আগে কোনোদিন দেখা যায়নি। পাকিস্তানি আমলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের লোকেরা চাঁদাবাজি করেছেন এমন কোনো উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নেই। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে চাঁদাবাজি এমনভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, যাকে দুর্নীতির একটি বিপজ্জনক প্রকার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্বাচিত সরকারগুলোর আমলে চাঁদাবাজি নতুনভাবে শুরু হয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যা ক্ষমতাসীন দলটির জন্যও পরিণত হয়েছে এক বড় সমস্যার। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আজ আওয়ামী লীগেরও ক্ষমতা নেই তাদের ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করার। ঢাকা এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেন্ডারবাজি হলো চাঁদাবাজির একটা ধরন। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এটা হলো তারই এক অতি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। পাকিস্তানি আমলে ছাত্ররা রাজনীতি করত কিন্তু কারও পকেটের দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল না। এখন শুধু টেন্ডারবাজিই নয়, শিক্ষা প্রশাসনে নানাভাবে হস্তক্ষেপও হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্র দুর্নীতির একটা ধরন। আগেকার দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ব্যাপারে ছাত্রদের হস্তক্ষেপ ছিল তাদের চিন্তার বাইরে।
কাজের অভাবকে চাঁদাবাজি এবং অন্য ধরনের দুর্নীতির একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ছাত্রদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। ছাত্ররা ছাত্রজীবনে কোনো সময়েই কাজ করে না। তবে যারা গরিব তারা কেউ কেউ ছাত্র অবস্থায় বরাবরই টিউশনি করে নিজেদের খরচ চালিয়েছে এবং এখনও তারা কেউ কেউ সেটা করে থাকে। কিন্তু চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি অন্য জিনিস। এটা এক ধরনের দুষ্কৃতি যা লোভ-লালসার সঙ্গেই সম্পর্কিত। সারা সমাজজুড়ে এখন লুটতরাজের যে হুলস্থূল চলছে এ হলো সেই লুটতরাজেরই ছাত্র সংস্করণ।
কোনো সমাজেই ব্যাপক লুটতরাজ চলতে পারে না যদি শাসক শ্রেণী ও তাদের সরকারের মধ্যে লুটতরাজের প্রক্রিয়া না থাকে। প্রথম থেকেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও শাসক দলের মধ্যে লুটতরাজ শুরু হওয়া এবং চলতে থাকার কারণে ক্রমশ এই প্রক্রিয়া সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃত্বের লুটতরাজ নিম্ন পর্যায়ে পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন আজ যেভাবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে লুটতরাজ করছে এটা সম্ভব হতো না যদি নেতৃত্বের লুটতরাজের প্রভাব তাদের আচ্ছন্ন না করত। কাজেই আওয়ামী লীগ আজ তাদের ছাত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তার জন্য সন্ত্রাস বন্ধ করতে অপারগ হলেও এসবের মূল কারণ হলো, তাদের নেতৃত্বের লুটতরাজ। তারা যদি সাধু-সন্ত হতো তাহলে তাদের নিচের স্তরের নেতাকর্মীরা, বিশেষত তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা এভাবে বেপরোয়া চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করত না।
পদ্মা সেতু প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি এখন নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংক ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থ সংস্থা এডিবি ইত্যাদি দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সকলের কাছে এর জন্য গঠিত তহবিলে অর্থ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই আহ্বান যে চাঁদাবাজিকে উৎসাহিত করবে ও বাড়িয়ে তুলবে এটা জানা কথা। এটাই স্বাভাবিক। কাজেই সেটাই এখন ঘটছে। আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর ব্যাপার যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বয়ং উপাচার্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এক সমাবেশে পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তোলা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন! এর সচিত্র রিপোর্টও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চাঁদার বাক্স হাতে বেরিয়ে পড়ে। চাঁদা তোলার পর পদ্মা সেতুর তহবিলে সেটা জমা দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির সময় তাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে সরকারের যে পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল তা নেওয়া হয়নি। যদিও এ ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর জন্য সরকার গঠিত তহবিলে চাঁদা দেওয়ার আহ্বান জানানোর পর এ ধরনের ঘটনা যে বন্ধ হয়নি তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ঢাকার মনিপুর স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ছাত্রদের থেকে জোরপূর্বক পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা আদায়। এই মর্মে আজ একটি রিপোর্ট সংবাদপত্রে বড় আকারে প্রকাশিত হয়েছে (ডেইলি স্টার, ২৩.৭.২০১২)। এতে দেখা যায়, স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের ৫০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে বাধ্য করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের কোনো নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও এটা হচ্ছে। এভাবে এটা ঘটা যে চরম দুর্নীতির ব্যাপার এতে সন্দেহ নেই। সরকার এই ঘটনার পর স্কুল কর্তৃপক্ষকে তিনদিনের মধ্যে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু এর ফলে এই বিশেষ স্কুলটিতে চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও দেশজুড়ে চাঁদাবাজির যে আবহাওয়া তৈরি হয়েছে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নকে কেন্দ্র করে, সেটা সরকারেরই তৈরি। তাদের তৈরি করা এই আবহাওয়া পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। কাজেই অঘোষিতভাবে এবং অপ্রকাশিতভাবে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য চাঁদাবাজি দেশজুড়েই চলছে।
এদিকে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরিকরণেওয়ালারা এই কর্মসূচির অসম্ভাব্যতা বাস্তবে উপলব্ধি করে আবার বিশ্বব্যাংক এবং অন্য সাম্রাজ্যবাদী অর্থ সংস্থাগুলোর কাছে ধর্ণা দিতে শুরু করেছে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর বহুমুখী কথাবার্তা দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের সরকার আসলে কী করতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকের ঋণ বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নের কথা বলছেন। কিন্তু তাদের অর্থমন্ত্রী এখন বলছেন, বিশ্বব্যাংকের চার শর্তের অন্যতম কয়েকজন সরকারি আমলা এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে তার বর্তমান মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ছুটি দেওয়ার কথা। শুধু বিশ্বব্যাংকই নয়, এডিবি ও জাপান সরকারও এই একই দাবি করায় বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল সরকার এখন ঋণদাতাদের মেজাজ নরম করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। অবস্থা দেখে মনে হয় শুধু এই একটি শর্তই নয়, অন্যান্য শর্তও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েই সরকারকে আবার বিশ্বব্যাংক, এডিবি ইত্যাদির দ্বারস্থ হয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হবে। কিন্তু এ স্বপ্ন জলাঞ্জলি এবং অপরিপকস্ফ কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও একে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির যে নতুন হিড়িক শুরু হয়েছে তা যে সাধারণভাবে চাঁদাবাজির ব্যাপকতা দেশে আরও বাড়িয়ে তুলবে এতে সন্দেহ নেই।
২৩.৭.২০১২
No comments