পলাশী যুদ্ধের ২৫৫ বছর by আদিত্য আরাফাত
বাঙালি জীবনের ইতিহাসে যেমন আছে আলো ঝলমল অধ্যায় তেমনি আছে অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। আলো আর অন্ধকারেই বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস। ২৩ জুন পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস। বাঙ্গালীর ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার দিন।
এ দিনটিতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল মীর জাফর আর ঘষেটি বেগমের প্রেতত্নাদের ষড়যন্ত্রে। ২৩ জুন ১৭৫৭। সুবা-বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশী নামক গ্রামের প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের সেনাবাহিনী ও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজদৌল্লার বাহিনী একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থান নেয়। সকাল নয়টায় যুদ্ধ শুরু, বিকেল চারটার মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়। এ যুদ্ধের আপাতত ফলাফল ক্লাইভের জয়, সিরাজদ্দৌলার পরাজয়। পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত।
বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেন।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, দু`শ পঞ্চান্ন বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল ভাগীরথী নদী তীরে পলাশীর আমবাগানে।
পলাশী যুদ্ধের ওপর বিভিন্ন গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ষোল শতকের শেষের দিকে ওলন্দাজ, পর্তুগীজ ও ইংরেজদের প্রাচ্যে ব্যাপক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এক পর্যায়ে ইংরেজরা হয়ে যায় অগ্রগামী। এদিকে বাংলার সুবাদার-দিওয়ানরাও ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৭১৯ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মৃত্যুর পর ওই বছরই সুজাউদ্দিন খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন লাভ করেন। এই ধারাবাহিকতায় আলীবর্দী খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। এছাড়া রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মীর জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ স্থাপন ও কার্যকর করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে।
দিন যতই গড়াচ্ছিল এ ভূখণ্ডের আকাশে ততই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মিরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মিরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মিরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মিরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষ্মবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানের উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন। বেলা নয়টায় হঠাৎ করেই মিরমদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মিরমদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মিরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মিরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজদ্দৌলার গোলা বারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মিরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মিরমদন মৃত্যুবরণ করেন।
গোলান্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজদ্দৌলা মীরজাফর ও রায় দুর্লভকে তাঁদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তাঁর নির্দেশ অমান্য করলেন। তাঁদের যুক্তি হলো গোলন্দাজ বাহিনীর আশ্রয় ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েক শ’ গজ। বিকেল পাঁচটায় সিরাজদ্দৌলা বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করেন। সেদিন তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। এ পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য পৌনে দু`শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।
তথ্যসূত্র: ১. পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত রায়; ২. পলাশীর যুদ্ধ, তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়; ৩. বিশ্ব ইতিহাস অভিধান, সুভাষ ভট্টাচার্য; ৪. উইকিপিডিয়া।
বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেন।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, দু`শ পঞ্চান্ন বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল ভাগীরথী নদী তীরে পলাশীর আমবাগানে।
পলাশী যুদ্ধের ওপর বিভিন্ন গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ষোল শতকের শেষের দিকে ওলন্দাজ, পর্তুগীজ ও ইংরেজদের প্রাচ্যে ব্যাপক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এক পর্যায়ে ইংরেজরা হয়ে যায় অগ্রগামী। এদিকে বাংলার সুবাদার-দিওয়ানরাও ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৭১৯ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মৃত্যুর পর ওই বছরই সুজাউদ্দিন খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন লাভ করেন। এই ধারাবাহিকতায় আলীবর্দী খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। এছাড়া রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মীর জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ স্থাপন ও কার্যকর করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে।
দিন যতই গড়াচ্ছিল এ ভূখণ্ডের আকাশে ততই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মিরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মিরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মিরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মিরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষ্মবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানের উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন। বেলা নয়টায় হঠাৎ করেই মিরমদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মিরমদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মিরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মিরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজদ্দৌলার গোলা বারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মিরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মিরমদন মৃত্যুবরণ করেন।
গোলান্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজদ্দৌলা মীরজাফর ও রায় দুর্লভকে তাঁদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তাঁর নির্দেশ অমান্য করলেন। তাঁদের যুক্তি হলো গোলন্দাজ বাহিনীর আশ্রয় ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েক শ’ গজ। বিকেল পাঁচটায় সিরাজদ্দৌলা বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করেন। সেদিন তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। এ পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য পৌনে দু`শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।
তথ্যসূত্র: ১. পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত রায়; ২. পলাশীর যুদ্ধ, তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়; ৩. বিশ্ব ইতিহাস অভিধান, সুভাষ ভট্টাচার্য; ৪. উইকিপিডিয়া।
No comments