বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ-সাবধান থেকো তাদের থেকে... by বদিউল আলম মজুমদার
দেশপ্রেম ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন এবং পাঠকদের মধ্যে তা জাগ্রত করার ব্রত নিয়ে ৪ নভেম্বর প্রথম আলো তার দ্বাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করল। এ উপলক্ষে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ছিল: ‘এই দেশকে (মাকে) দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’
এই ধাক্কা দেওয়া শিরোনামের উদ্দেশ্য ছিল পাঠকদের মধ্যে দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসার তাগিদ সৃষ্টি করা। নিঃসন্দেহে শিরোনামটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একই সঙ্গে এটি তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে জন্মলগ্নেই বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সেই কুখ্যাত উক্তি।
রূপকার্থে এ উপমা ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করা। হতাশা ব্যক্ত করা এর স্থায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু ৩৯ বছর ধরে বাংলাদেশ টিকে আছে। বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনও আছে। তবুু দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো অনেকের আশঙ্কার অন্ত নেই। বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই—অনেকে এখনো এ কথা বিশ্বাস করেন এবং জোর গলায় তা বলতেও ভালোবাসেন।
যাঁরা বাংলাদেশের ভবিষৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন, তাঁরা যেন এক ধরনের মালিকানা-সংকটে ভোগেন। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনই সম্ভবত এমন মানসিকতার উৎস—দেশ স্বাধীন হলেও নাগরিক তথা দেশের মালিকের মানসিকতা যেন তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পরের সন্তান সম্পর্কে যেমন সহজেই উদাসীন হওয়া যায়, পরের দেশ নিয়েও তেমনি হতাশা ব্যক্ত করা যায়। নিজের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানকে শোধরানোর দায়িত্ব যেমন বাবা-মা গ্রহণ করেন, তেমনি দুরবস্থার কবলে নিপতিত দেশমাতৃকাকে ভালো করার দায়িত্বও একজন নাগরিক তথা দেশের মালিক নিজ কাঁধে তুলে নেন। কারণ, দেশের ভবিষ্যতের ওপরই তাঁর নিজের এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই কোনোভাবেই দেশ সম্পর্কে নাগরিকের হতাশ-নিরাশ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই, বরং তাঁরা অবস্থা পাল্টানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে অনেকে প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতার কথা বলেন। হ্যাঁ, অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা রাশিয়ার মতো আমাদের অঢেল পরিমাণে তেল-সম্পদ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো আমাদের স্বর্ণখনিও নেই। তবে বর্তমানের অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অনেক বেশি অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। যেমন মিষ্টি পানির দিক থেকে কানাডার পর আমরা পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহৎ সম্পদশালী দেশ। যদিও মিষ্টি পানিকে আমরা এখনো সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করি না, তবে অনেক দেশেই শোধিত মিষ্টি পানি তেলের চেয়ে বেশি দামে বাজারজাত হয়ে থাকে। আমাদের উর্বর ভূমি অনেকের জন্য ঈর্ষার কারণ। আমাদের মাটির নিচে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাসসম্পদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা—গ্যাস যেখানে থাকে, সাধারণত পেট্রোলিয়ামও সেখানে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আমাদের কয়লাসম্পদও রয়েছে। আমাদের আরও রয়েছে উঠতি বয়সের ব্যাপক জনসংখ্যা, যাকে উন্নতমানের শিক্ষা ও যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব, যে সুযোগ খুব কম দেশেরই আছে।
এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশই প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। আমাদের পাশেই সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত। প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব এসব দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। কারণ মেধা, সৃজনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম ও মানবসম্পদের উন্নয়নই ছিল এদের সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। যথাযথ ও গণমুখী নীতি-নির্ধারণই তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করেছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি দেশ উন্নত হতে পারে। তাই মিষ্টি পানি, উর্বর মাটি, গ্যাস ইত্যাদি সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উন্নয়নের সম্ভাবনার দিক থেকে বেশ ভালো অবস্থানেই রয়েছে।
মেধা ও সৃজনশীলতার দিক থেকে বাংলাদেশিরা কোনোভাবেই কারও থেকে পেছনে নেই। যথাযথ সুযোগ পেলে আমরাও যে পৃথিবীর যেকোনো বর্ণ বা ভৌগোলিক অবস্থানের ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারি, এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের চারপাশেই রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই বিদেশের মাটির সহায়ক পরিবেশে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছেন। আমেরিকা-ইউরোপে আমাদের সন্তানেরা তাদের বিদেশি সতীর্থদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করছে। তাই এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে মেধার ঘাটতি নেই।
জাতি হিসেবে আমাদের বেশ কিছু অনন্য অর্জনও রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন আমাদের এসব অর্জনের শীর্ষে। মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানিদের মতো একটি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং প্রশিক্ষিত লক্ষাধিক সেনাকে এক অসম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাভূত করে আমরা বীরের জাতি বলে আখ্যায়িত হয়েছি। একটি সমবেত প্রত্যাশার ভিত্তিতে জনগণকে জাগ্রত ও সংগঠিত করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এই অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে অগণিত বিদ্রোহ-বিপ্লবে এবং শেষাবধি পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করে প্রমাণ করেছি যে আমরা কখনো স্থায়ীভাবে অন্যের গোলামি মেনে নিইনি। বিবিধ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় পরাধীনতার শেকল অনেক দিন বইতে হলেও, নিঃসন্দেহে আমরা এক স্বাধীনচেতা, মুক্তিকামী জাতি।
এ ছাড়া শিল্পবিপ্লবের আগে অর্থনৈতিক দিক থেকে সারা পৃথিবী প্রায় একই অবস্থানে ছিল। তবে যে কটি এলাকা অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ছিল, তার মধ্যে ছিলাম আমরাও। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতিসহ অনেক সভ্যতার আমরা পাদপীঠ। এককালে অসংখ্য বিদেশি জাহাজ আমাদের বন্দরে নোঙর ফেলেছিল এসব সম্পদের আকর্ষণে। রবার্ট ক্লাইভ ১৭৭২ সালে হাউস অব কমন্সে দেওয়া তাঁর ভাষণে বেঙ্গলকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে এখানকার বহুবিধ শিল্পপণ্য শুধু নিজেদেরই নয়, সারা বিশ্বের চাহিদা মেটাতে পারে। তাই নিঃসন্দেহে আমরা একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীতেরও অধিকারী।
সাম্প্রতিক কালে ভাষার অধিকারের জন্য লড়াই করে আমরা আমাদের উন্নত সাংস্কৃতিক মানের পরিচয় দিয়েছি। পৃথিবীর কম জাতিই মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হওয়ার মাধ্যমে আমরা অনেকের ভাষা ও জাতিসত্তার সর্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছি। অনেকের জন্য আমরা অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছি। তাই, মনোযোগী হলে জাতি হিসেবে অসাধারণ অর্জন আমাদের জন্য যেন সাধারণ ব্যাপার!
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অগ্রসর এক জনগোষ্ঠী নিয়ে সৃষ্ট একটি জাতির ভবিষ্যৎ ছিল নিঃসন্দেহে অমিত সম্ভাবনাময়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই সম্ভাবনা বাস্তবে পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত হয়নি। একটি উদাহরণ থেকেই তা সুস্পষ্ট হবে। জন্মলগ্নে বাংলাদেশ আর দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিকভাবে প্রায় একই অবস্থানে ছিল। উভয়েরই মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার। জিডিপিতে শিল্প খাত ও রপ্তানি খাতের শেয়ারও ছিল প্রায় সমপর্যায়ের। কিন্তু বিগত ৩৯ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় সাত গুণ আর কোরিয়ানদের বেড়েছে শতাধিক গুণেরও বেশি। অথচ যাত্রালগ্নে বাংলাদেশের সম্ভাবনাই ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের চেতনায় যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তাতে আমাদের জন্য কোনো বাধাই অনতিক্রম্য এবং কোনো অর্জনই অসম্ভব ছিল না।
কিন্তু একটি সমৃদ্ধ অবস্থানের পরিবর্তে ‘৩৯ বছর’ সময়কালে আমরা একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যে জর্জরিত জাতিতে পরিণত হয়েছি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের এক অভয়ারণ্যে। বস্তুত, দুর্নীতি আজ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে ক্রমাগতভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য, দখলদারি, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া, আইনের শাসনকে পদদলিত করা আর অনিয়ম যেন এখন আমাদের দেশে নিয়মে দাঁড়িয়েছে! সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য আর বঞ্চনাই বহুলাংশে আজ আমাদের পেছনে টেনে রাখছে।
দেশের এই দুরবস্থার প্রধান কারণ আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অতীতে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তি নির্বাচিত করতে ব্যর্থ হয়েছি; যার বিষফল আজ আমরা ভোগ করছি। অসততা ও অযোগ্যতার কারণে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় হয় ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়েছেন অথবা ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে তাঁরা আমাদের যুবসমাজকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করছেন। প্রজ্ঞা প্রদর্শন ও বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে তাঁরা বিফল হয়েছেন। তাঁরা আজ এক ধরনের অমীমাংসিত দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আর এসব ব্যক্তি এবং তাদের অপকর্মই রাজনীতিতে চরম দুর্বৃত্তায়ন, শাসনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অপশাসন এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক অনুন্নয়ন অন্যতম কারণ। ফলে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ বহুলাশে এক দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় আমরাই আমাদের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। আমরা ‘ভালো’ নাগরিকেরাই আমাদের নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে ‘খারাপ’ ব্যক্তিদের বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছি। তাই আমাদের নিজেদেরই আজ দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হতে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের যুবসমাজকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আর্থ-সামাজিক অনুন্নয়নের একটি বড় কারণ হলো, আমাদের প্রচলিত উন্নয়ন ধারণা। প্রচলিত উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় ক্ষুধার্ত-দরিদ্র জনগণকে ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখা হয়, ‘সমাধান’ নয়। তারা ‘উপকারভোগী’, নিজ ভাগ্য গড়ার কারিগর নয়। তাদের দেখা হয় মূলত অনেকগুলো ‘চাহিদা’র সমষ্টি হিসেবে, সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে নয়। এই পদ্ধতিতে দরিদ্রদের সমস্যা সমাধানের জন্য একদল বাইরের লোককে—সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন ধরনের দান-খয়রাত ও সেবা প্রদান করেন। এই প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তারা হয়ে পড়েন দাতা আর দরিদ্র জনগণ গ্রহীতা—তথাকথিত ‘ভেড়ার পাল’। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে কর্মকর্তাভিত্তিক দারিদ্র্য দূরীকরণ উদ্যোগ অসফল হতে বাধ্য। সত্যিকারার্থে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণে সমস্যাকবলিতদেরই তাদের জীবনের হাল ধরতে হবে। তাদেরই নিজ ভাগ্য গড়ার মূল কারিগরে পরিণত করতে হবে। উন্নয়নকে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহকে নিতে হবে সহায়কের ভূমিকা। দিতে হবে বঞ্চিতদের ন্যায্য প্রাপ্য। সময়ের প্রেক্ষাপটে এমনই এক গণমুখী উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’, যার ফলে সমাজের দরিদ্র-বঞ্চিতরা জাতীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা পাবে। কারণ দারিদ্র্যই আমাদের মূল সমস্যা নয়; সমস্যা হলো মূলত বৈষম্য ও সুযোগের অভাব এবং হতাশা-নিরাশার মানসিকতা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে আমাদের হতাশা, হালছাড়া আর নির্লিপ্ত মানসিকতার রূপান্তর। যত দূর মনে পড়ে, একটি রুশ কবিতায় পড়েছিলাম: তোমার বন্ধুকে ভয় করার কিছু নেই, সে বড়জোর তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তোমার শত্রুকে ভয় করার কিছু নেই, সে বড়জোর তোমাকে হত্যা করবে। কিন্তু সতর্ক থেকো সেই সব ব্যক্তি থেকে; যারা হতাশ, নিরাশ এবং সর্বোপরি নির্লিপ্ত। তারা তোমাকে হত্যাও করবে না, তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করবে না। কিন্তু যুগে যুগে তাদের জন্যেই হত্যা ও বিশ্বাসঘাতকতা টিকে রয়েছে।
তাই মনে করি, প্রথম আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনের থিমটি ছিল যথাযথ ও সময়োপযোগী। আন্তরিক অভিনন্দন, প্রথম আলো।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
রূপকার্থে এ উপমা ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করা। হতাশা ব্যক্ত করা এর স্থায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু ৩৯ বছর ধরে বাংলাদেশ টিকে আছে। বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনও আছে। তবুু দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো অনেকের আশঙ্কার অন্ত নেই। বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই—অনেকে এখনো এ কথা বিশ্বাস করেন এবং জোর গলায় তা বলতেও ভালোবাসেন।
যাঁরা বাংলাদেশের ভবিষৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন, তাঁরা যেন এক ধরনের মালিকানা-সংকটে ভোগেন। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনই সম্ভবত এমন মানসিকতার উৎস—দেশ স্বাধীন হলেও নাগরিক তথা দেশের মালিকের মানসিকতা যেন তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পরের সন্তান সম্পর্কে যেমন সহজেই উদাসীন হওয়া যায়, পরের দেশ নিয়েও তেমনি হতাশা ব্যক্ত করা যায়। নিজের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানকে শোধরানোর দায়িত্ব যেমন বাবা-মা গ্রহণ করেন, তেমনি দুরবস্থার কবলে নিপতিত দেশমাতৃকাকে ভালো করার দায়িত্বও একজন নাগরিক তথা দেশের মালিক নিজ কাঁধে তুলে নেন। কারণ, দেশের ভবিষ্যতের ওপরই তাঁর নিজের এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই কোনোভাবেই দেশ সম্পর্কে নাগরিকের হতাশ-নিরাশ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই, বরং তাঁরা অবস্থা পাল্টানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে অনেকে প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতার কথা বলেন। হ্যাঁ, অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা রাশিয়ার মতো আমাদের অঢেল পরিমাণে তেল-সম্পদ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো আমাদের স্বর্ণখনিও নেই। তবে বর্তমানের অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অনেক বেশি অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। যেমন মিষ্টি পানির দিক থেকে কানাডার পর আমরা পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহৎ সম্পদশালী দেশ। যদিও মিষ্টি পানিকে আমরা এখনো সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করি না, তবে অনেক দেশেই শোধিত মিষ্টি পানি তেলের চেয়ে বেশি দামে বাজারজাত হয়ে থাকে। আমাদের উর্বর ভূমি অনেকের জন্য ঈর্ষার কারণ। আমাদের মাটির নিচে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাসসম্পদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা—গ্যাস যেখানে থাকে, সাধারণত পেট্রোলিয়ামও সেখানে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আমাদের কয়লাসম্পদও রয়েছে। আমাদের আরও রয়েছে উঠতি বয়সের ব্যাপক জনসংখ্যা, যাকে উন্নতমানের শিক্ষা ও যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব, যে সুযোগ খুব কম দেশেরই আছে।
এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশই প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। আমাদের পাশেই সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত। প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব এসব দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। কারণ মেধা, সৃজনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম ও মানবসম্পদের উন্নয়নই ছিল এদের সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। যথাযথ ও গণমুখী নীতি-নির্ধারণই তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করেছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি দেশ উন্নত হতে পারে। তাই মিষ্টি পানি, উর্বর মাটি, গ্যাস ইত্যাদি সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উন্নয়নের সম্ভাবনার দিক থেকে বেশ ভালো অবস্থানেই রয়েছে।
মেধা ও সৃজনশীলতার দিক থেকে বাংলাদেশিরা কোনোভাবেই কারও থেকে পেছনে নেই। যথাযথ সুযোগ পেলে আমরাও যে পৃথিবীর যেকোনো বর্ণ বা ভৌগোলিক অবস্থানের ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারি, এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের চারপাশেই রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই বিদেশের মাটির সহায়ক পরিবেশে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছেন। আমেরিকা-ইউরোপে আমাদের সন্তানেরা তাদের বিদেশি সতীর্থদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করছে। তাই এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে মেধার ঘাটতি নেই।
জাতি হিসেবে আমাদের বেশ কিছু অনন্য অর্জনও রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন আমাদের এসব অর্জনের শীর্ষে। মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানিদের মতো একটি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং প্রশিক্ষিত লক্ষাধিক সেনাকে এক অসম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাভূত করে আমরা বীরের জাতি বলে আখ্যায়িত হয়েছি। একটি সমবেত প্রত্যাশার ভিত্তিতে জনগণকে জাগ্রত ও সংগঠিত করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এই অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে অগণিত বিদ্রোহ-বিপ্লবে এবং শেষাবধি পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করে প্রমাণ করেছি যে আমরা কখনো স্থায়ীভাবে অন্যের গোলামি মেনে নিইনি। বিবিধ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় পরাধীনতার শেকল অনেক দিন বইতে হলেও, নিঃসন্দেহে আমরা এক স্বাধীনচেতা, মুক্তিকামী জাতি।
এ ছাড়া শিল্পবিপ্লবের আগে অর্থনৈতিক দিক থেকে সারা পৃথিবী প্রায় একই অবস্থানে ছিল। তবে যে কটি এলাকা অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ছিল, তার মধ্যে ছিলাম আমরাও। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতিসহ অনেক সভ্যতার আমরা পাদপীঠ। এককালে অসংখ্য বিদেশি জাহাজ আমাদের বন্দরে নোঙর ফেলেছিল এসব সম্পদের আকর্ষণে। রবার্ট ক্লাইভ ১৭৭২ সালে হাউস অব কমন্সে দেওয়া তাঁর ভাষণে বেঙ্গলকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে এখানকার বহুবিধ শিল্পপণ্য শুধু নিজেদেরই নয়, সারা বিশ্বের চাহিদা মেটাতে পারে। তাই নিঃসন্দেহে আমরা একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীতেরও অধিকারী।
সাম্প্রতিক কালে ভাষার অধিকারের জন্য লড়াই করে আমরা আমাদের উন্নত সাংস্কৃতিক মানের পরিচয় দিয়েছি। পৃথিবীর কম জাতিই মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হওয়ার মাধ্যমে আমরা অনেকের ভাষা ও জাতিসত্তার সর্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছি। অনেকের জন্য আমরা অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছি। তাই, মনোযোগী হলে জাতি হিসেবে অসাধারণ অর্জন আমাদের জন্য যেন সাধারণ ব্যাপার!
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অগ্রসর এক জনগোষ্ঠী নিয়ে সৃষ্ট একটি জাতির ভবিষ্যৎ ছিল নিঃসন্দেহে অমিত সম্ভাবনাময়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই সম্ভাবনা বাস্তবে পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত হয়নি। একটি উদাহরণ থেকেই তা সুস্পষ্ট হবে। জন্মলগ্নে বাংলাদেশ আর দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিকভাবে প্রায় একই অবস্থানে ছিল। উভয়েরই মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার। জিডিপিতে শিল্প খাত ও রপ্তানি খাতের শেয়ারও ছিল প্রায় সমপর্যায়ের। কিন্তু বিগত ৩৯ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় সাত গুণ আর কোরিয়ানদের বেড়েছে শতাধিক গুণেরও বেশি। অথচ যাত্রালগ্নে বাংলাদেশের সম্ভাবনাই ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের চেতনায় যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তাতে আমাদের জন্য কোনো বাধাই অনতিক্রম্য এবং কোনো অর্জনই অসম্ভব ছিল না।
কিন্তু একটি সমৃদ্ধ অবস্থানের পরিবর্তে ‘৩৯ বছর’ সময়কালে আমরা একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যে জর্জরিত জাতিতে পরিণত হয়েছি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের এক অভয়ারণ্যে। বস্তুত, দুর্নীতি আজ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে ক্রমাগতভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য, দখলদারি, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া, আইনের শাসনকে পদদলিত করা আর অনিয়ম যেন এখন আমাদের দেশে নিয়মে দাঁড়িয়েছে! সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য আর বঞ্চনাই বহুলাংশে আজ আমাদের পেছনে টেনে রাখছে।
দেশের এই দুরবস্থার প্রধান কারণ আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অতীতে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তি নির্বাচিত করতে ব্যর্থ হয়েছি; যার বিষফল আজ আমরা ভোগ করছি। অসততা ও অযোগ্যতার কারণে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় হয় ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়েছেন অথবা ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে তাঁরা আমাদের যুবসমাজকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করছেন। প্রজ্ঞা প্রদর্শন ও বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে তাঁরা বিফল হয়েছেন। তাঁরা আজ এক ধরনের অমীমাংসিত দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আর এসব ব্যক্তি এবং তাদের অপকর্মই রাজনীতিতে চরম দুর্বৃত্তায়ন, শাসনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অপশাসন এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক অনুন্নয়ন অন্যতম কারণ। ফলে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ বহুলাশে এক দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় আমরাই আমাদের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। আমরা ‘ভালো’ নাগরিকেরাই আমাদের নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে ‘খারাপ’ ব্যক্তিদের বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছি। তাই আমাদের নিজেদেরই আজ দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হতে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের যুবসমাজকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আর্থ-সামাজিক অনুন্নয়নের একটি বড় কারণ হলো, আমাদের প্রচলিত উন্নয়ন ধারণা। প্রচলিত উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় ক্ষুধার্ত-দরিদ্র জনগণকে ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখা হয়, ‘সমাধান’ নয়। তারা ‘উপকারভোগী’, নিজ ভাগ্য গড়ার কারিগর নয়। তাদের দেখা হয় মূলত অনেকগুলো ‘চাহিদা’র সমষ্টি হিসেবে, সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে নয়। এই পদ্ধতিতে দরিদ্রদের সমস্যা সমাধানের জন্য একদল বাইরের লোককে—সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন ধরনের দান-খয়রাত ও সেবা প্রদান করেন। এই প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তারা হয়ে পড়েন দাতা আর দরিদ্র জনগণ গ্রহীতা—তথাকথিত ‘ভেড়ার পাল’। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে কর্মকর্তাভিত্তিক দারিদ্র্য দূরীকরণ উদ্যোগ অসফল হতে বাধ্য। সত্যিকারার্থে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণে সমস্যাকবলিতদেরই তাদের জীবনের হাল ধরতে হবে। তাদেরই নিজ ভাগ্য গড়ার মূল কারিগরে পরিণত করতে হবে। উন্নয়নকে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহকে নিতে হবে সহায়কের ভূমিকা। দিতে হবে বঞ্চিতদের ন্যায্য প্রাপ্য। সময়ের প্রেক্ষাপটে এমনই এক গণমুখী উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’, যার ফলে সমাজের দরিদ্র-বঞ্চিতরা জাতীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা পাবে। কারণ দারিদ্র্যই আমাদের মূল সমস্যা নয়; সমস্যা হলো মূলত বৈষম্য ও সুযোগের অভাব এবং হতাশা-নিরাশার মানসিকতা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে আমাদের হতাশা, হালছাড়া আর নির্লিপ্ত মানসিকতার রূপান্তর। যত দূর মনে পড়ে, একটি রুশ কবিতায় পড়েছিলাম: তোমার বন্ধুকে ভয় করার কিছু নেই, সে বড়জোর তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তোমার শত্রুকে ভয় করার কিছু নেই, সে বড়জোর তোমাকে হত্যা করবে। কিন্তু সতর্ক থেকো সেই সব ব্যক্তি থেকে; যারা হতাশ, নিরাশ এবং সর্বোপরি নির্লিপ্ত। তারা তোমাকে হত্যাও করবে না, তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করবে না। কিন্তু যুগে যুগে তাদের জন্যেই হত্যা ও বিশ্বাসঘাতকতা টিকে রয়েছে।
তাই মনে করি, প্রথম আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনের থিমটি ছিল যথাযথ ও সময়োপযোগী। আন্তরিক অভিনন্দন, প্রথম আলো।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments