প্রশাসন-সুশাসন-সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো by এ এম এম শওকত আলী

বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় না। কেন হয় না, তার কারণ কারও জানা নেই। এ ধরনের বৈঠক হয় দাতাগোষ্ঠী ও সরকারের মধ্যে। বৈঠকে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। ৭ নভেম্বরের বৈঠকে দাতাগোষ্ঠী বলেছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তারা অধিকতর অগ্রগতি দেখতে আগ্রহী।


এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য উন্নয়ন সহযোগীরা দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, জনপ্রশাসনসহ গণতন্ত্র সুসংহত করার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারের বাইরে সব ধরনের কমিশন বা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর সহযোগীরা গুরুত্ব আরোপ করেছে।
শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া কী হবে, তার রূপরেখা সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত তথ্য এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে, তা হলো যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শক্তিশালী করা যায় না। বিষয়টি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য কয়েকটি উপাদানের প্রয়োজন। এক. রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা। দুই. যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে জন্মলগ্ন থেকেই প্রয়োজনীয় জনবলসহ অন্যান্য সাহায্য। এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে তা হলো, কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের অহেতুক দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, প্রায় সব কটি কমিশন এখনো প্রয়োজনীয় জনবলের সরকারি অনুমোদন লাভ করেনি। এ ছাড়া যেসব কমিশন স্বীয় আইনের অধীনে খসড়াবিধি প্রণয়ন করে সরকারের কাছে পাঠিয়েছে সেগুলোও কোনো অনুমোদন পায়নি। সাম্প্রতিক কালে মানবাধিকার কমিশন এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়েছে। দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে এ কমিশন এখনো প্রণীত খসড়াবিধির কোনো অনুমোদন পায়নি। জনবল যা চেয়েছিল তার প্রায় অর্ধেকেরও কম অনুমোদিত হয়েছে। এ কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, অনুমোদিত জনবল নিয়েই তাঁরা কাজ শুরু করবেন। চেয়ারম্যান আরও বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ তাঁরা পান, তা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনের জন্য পাঠানো হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য কমিশন নিজেই এ ধরনের অভিযোগ তদন্ত করবে। অথচ তাদের প্রয়োজনীয় জনবল নেই।
এ বিষয়ে অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ও বলা যায়। তদন্তের ফলাফলের পর তারা কী করবে। নিশ্চয়ই অভিযুক্তকে কোনো শাস্তি দিতে পারবে না। এর জন্য যেতে হবে বিচারিক আদালতে। তারপর কী হবে? বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া কি এড়ানো যাবে? এর সঙ্গে যোগ করা যায় আরেকটি প্রসঙ্গ। তা হলো সুশাসনসহায়ক প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি সব ধরনের অনুসন্ধানের কাজ নিজেরাই করতে চায়, তা হলে কত জনবলের প্রয়োজন হবে সে বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়া নিজস্ব জনবল দিয়ে সব কাজ করানোর জন্যও প্রয়োজন হবে স্থায়ী মাঠ প্রশাসনের সহায়তা। এ জন্য প্রয়োজন হবে সঠিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা। বিচ্ছিন্নভাবে করলে তার কোনো সুফল পাওয়া মুশকিল হবে।
নির্বাচন কমিশনের কাঠামো এ বিষয়ে কিছু অনুসরণীয় তথ্য ও পদ্ধতির ইঙ্গিত প্রদান করে। এ কমিশন আইন ও বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সহায়তা নিয়ে থাকে। নির্বাচনী অপরাধ দমন ও শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে তারা কোনো ক্ষমতার অধিকারী নয়। এ সত্ত্বেও গত জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্যও এ কমিশন সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরই ব্যবহার করে থাকে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত কাঠামো পর্যালোচনা করে বলা যায় যে কোন কাজটা কোন কমিশন নিজেই করবে এবং কোনটার জন্য প্রতিষ্ঠিত কোন কাঠামোকে ব্যবহার করবে, সে বিষয়টি প্রথমে চিহ্নিত করা।
উন্নয়ন ফোরামে জনপ্রশাসনের সংস্কার সম্পর্কেও বলা হয়েছে। জানা গেছে, এ বিষয়ে দাতাগোষ্ঠী একটি টাস্কফোর্স গঠন করবে। এ টাস্কফোর্সে যৌথ অংশীদারি থাকবে কি না, তা উল্লেখ করা হয়নি। জনপ্রশাসন যে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ একাধিক। অন্যান্য কারণের মধ্যে প্রশাসনকে রাজনৈতিকীকরণের অব্যাহত প্রক্রিয়া। সব সরকারের আমলেই কম-বেশি এ প্রক্রিয়া চালু ছিল। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, মাঠ প্রশাসনে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মাঠপর্যায়ের ও সচিবালয় প্রশাসনকে শক্তিশালী না করতে পারলে যত কমিশনই করা হোক না কেন সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
দৈনন্দিন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডসহ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ প্রসঙ্গে প্রচুর উদাহরণ দৃশ্যমান। সম্প্রতি পিকেএসএফের সেমিনারে বক্তারা বলেছেন যে রাজনীতিকীকরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অনেক দিন ধরেই অব্যাহত রয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট অতীতের কয়েকটি সমীক্ষায় এ কথাও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করার জন্য কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দলীয় সমর্থকদের টেন্ডারবাজির ঘটনার বিষয়টি কে না জানে। সরকারি নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে বারবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেও এ সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান এখনো হয়নি।
৯ নভেম্বরের একটি প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, এক সাংসদের নির্দেশে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। ঘটনাটি নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগ-সংক্রান্ত। সংশ্লিষ্ট সাংসদ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিষয়টি হয়তো এখানেই থেমে যাবে। তার মূল কারণ সংবিধানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকলেও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত কোনো সংসদীয় অমবুসম্যান নিয়োগ করা হয়নি। যুক্তরাজ্যে এ কর্মকর্তাকে সংসদীয় কমিশনার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সাংসদদের অনভিপ্রেত আচরণ প্রতিরোধের জন্য এ পদে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিলে ভালো হবে। সুশাসন-সম্পর্কিত প্রশাসনিক কাঠামোতে এটি একটি বড় ধরনের শূন্যতা।
নিয়োগ-বাণিজ্যের অব্যাহত ধারার বিষয়টিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। সাম্প্রতিক কালে পাবনার জেলা প্রশাসকের অফিসে কিছু কর্মচারীর নিয়োগের বিষয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা মিডিয়ায় বিশদভাবে প্রচার করা হয়েছে। পাবনা ছাড়াও অন্য কয়েকটি জেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ফরিদপুরের কাশিয়ানী থানায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। পাবনার বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য তদন্ত ছাড়াই জেলা প্রশাসকসহ অন্য একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সদর থানার ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসককে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু জানা গেছে তা হলো, তাঁর পক্ষে ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলা সরকারি নিয়মবহির্ভূত ছিল। আসল ঘটনার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত তা জানা যায়নি।
এ সম্পর্কে অন্য একটি প্রকাশিত সংবাদ প্রাসঙ্গিক। বরিশাল জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঠিকাদারি কাজ নিয়ে তাঁর ব্যস্ততার বিষয়ে বলেছেন, ‘জোট সরকারের আমলে আমরা কোনো কাজ করতে পারিনি। দল ক্ষমতায় আসার কারণে কিছু কাজ করছি।’
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও অনেক অনিয়ম বা দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ করা হয়। মিডিয়াই এ কাজটি করে। সাম্প্রতিক কালে ফরিদপুর গ্রামীণ কাঠামো উন্নয়ন প্রসঙ্গে একটি পত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে নানা ছুঁতোয় প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকার বাড়তি ব্যয়ের ঘটনা। এ সংবাদের সূত্র সরকারি প্রতিবেদন। দায়ী প্রতিষ্ঠানকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে কী হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
দাতাগোষ্ঠী বিভিন্ন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। যে কটি উদাহরণ দেওয়া হলো, সে বিষয়গুলো কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠিত কমিশনগুলোর দায়িত্বের মধ্যে এগুলো নেই। এ ধরনের অনিয়ম বা অন্যায় ও বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড নির্মূল করার জন্যই প্রয়োজন জনপ্রশাসনের শুধু সংস্কারই নয় বরং অধিকতর শক্তিশালী করা। যে টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দৃষ্টি দিলে ভালো হয়।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব।

No comments

Powered by Blogger.