শ্রদ্ধাঞ্জলি-‘সাঁঝের মায়ায়’ পিদিম জ্বালে রোজ by মারুফা রহমান
তিয়া আনসারী তৃতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসব। অনুষ্ঠানটি আনন্দ বিদ্যালয়ের। প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন তিয়ার নানু। তিনি শিশুদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন। বাড়ি ফিরে নানু সবাইকে ডেকে ডেকে বলছেন, ‘আজ তিনুমনু তিউনি আমার হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছে!’
তিয়াকে আদর করে নানু ডাকতেন তিনুমনু তিউনি।
আর একবার খুলনায় নানুকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। তিয়া তখন সাত-আট বছরের। পরনে সাদা ফ্রক। সাদা ফিতায় দুই ঝুঁটি বাঁধা মাথা দুলিয়ে নানুর ‘গোল কোরো না, গোল কোরো না’ আবৃত্তি করল তিউনি। এত মানুষ দেখে তিউনি যাতে ভয় না পায়, সাহস জোগাতে মঞ্চ থেকে নানু হাত নাড়াচ্ছিলেন তাই।
পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন নানু আর নাতির পরিচয়? ‘গোল কোরো না’ ছড়াটি কিংবা ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা’—কবিতার এই লাইনটির সঙ্গে পরিচয় নেই, স্কুল পাস করা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ঠিক ধরেছেন, আমরা কবি সুফিয়া কামালের কথাই বলছি। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।
‘সাঁঝের মায়া’ নামের বাড়িটিতে যেদিন গেলাম, সেদিন তিয়া বলছিলেন অনেক কথা। ওঁর সঙ্গে ছিলেন মা সাঈদা কামাল আর খালা সুলতানা কামাল। সুফিয়া কামালের নাতি তিয়া শুরু করলেন কথা, তারই সূত্র ধরে কবির দুই মেয়ে খুললেন স্মৃতির ঝাঁপি।
তিয়া বললেন, ‘যেকোনো মানুষ মনে করতে পারত কবি সুফিয়া কামাল আমার আপনার লোক। ছোটখাটো মানুষটার মধ্যে ছিল এতখানি শক্তি!’
একবার বলেছিলেন রাশিয়া সফরের কথা। রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা, যাঁদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী, ছুটে এসেছিলেন স্রোতের মতো। যাঁদের কাছে মস্কো পৌঁছানোর জন্য টিকিট সংগ্রহ করার মতো টাকা ছিল না, তাঁদের কেউ কেউ নিজের প্রিয় ক্যামেরা কিংবা দরকারি জিনিসপত্র বিক্রি করে এসেছিলেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিয়াকে কবি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া’।
কবি সুফিয়া কামাল ছয় সন্তানের জননী। আমেনা খাতুন দুলু, শাহেদ কামাল শামীম, আহমদ কামাল শোয়েব (মৃত), সাজেদ কামাল শাব্বির, সুলতানা কামাল লুলু ও সাঈদা কামাল টুলু। দুলুর দুই ছেলে কওসার, মুরাদ ও মেয়ে সিমিন। শাব্বির তনয় অশোক, লুলুর (সুলতানা কামাল) মেয়ে দিয়া ও টুলুর (সাঈদা কামাল) মেয়ে তিয়া। বড় ছেলে শামীম অকৃতদার। জমজমাট পরিবার। দিয়া বড় হয়েছে সিলেটে, অশোক বিদেশে। আর তিয়ার শৈশব, কৈশোরের পরম অবলম্বন নানি। একসঙ্গে বসে খাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে সময় কাটানো—সবকিছু নানিকে ঘিরে।
বিড়াল ভালোবাসতেন কবি। ‘এ বাড়িতে পোষা কুকুর-বিড়ালেরা ঘুরে বেড়াত। একবার তো বিড়ালের সংখ্যা সতেরো হয়ে গেল। একটা বিড়াল প্রায়ই হাওয়া হয়ে যেত, আবার ফিরে আসত। মা ওর নাম দিয়েছিলেন অতিথি,’ বললেন সাঈদা কামাল।
কবি কখনো কাউকে তাঁর ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের প্রথম হওয়ার কথা বলতেন না। বরং গুরুত্ব দিতেন ভালো ফলাফলের। কখনো খারাপ করলে অনুপ্রেরণা দিতেন। খেলতে গিয়ে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে প্রতিশোধপরায়ণ না হতে বলতেন, ‘তুমি আদব শিখবে বেয়াদবের কাছ থেকে।’ কিংবা ‘জবান শিরি তো মুলুক গিরি’। অর্থাৎ, মিষ্টি কথা দিয়ে জয় করাই উত্তম।
তিয়া পাশের বাড়িতে মইনুদ্দীন নাজির স্যারের কাছে গান শিখতে যেতেন। ‘প্রতিটি ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরলে, নানি জানতে চাইতেন কী শিখলাম’। দিয়া রবীন্দ্রসংগীত শিখতেন। ওয়াহিদুল হক সিলেটে গেলে তাঁর কাছ থেকে গান তুলে নিতেন দিয়া। ছোট্ট দিয়ার কাছ থেকে তিয়া শিখেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলি শোনো শোনো পিতা...’ গানটি কবির খুব প্রিয়। নানিকে গান শোনানোর সময়, দুই বোনকে প্রথমেই ওই গানটি করতে হতো।
স্কুলের দিনগুলোতে নানির লেখা কবিতা পাঠ্য। ব্যাখ্যা, প্রশ্ন, ভাবসম্প্রসারণ তিয়া বুঝতে গেলেই নানি খুব উৎসাহ নিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। নোট তৈরি করে স্কুলের বন্ধুদের দেখানো হতো। কখনো কখনো নানু নিজেও অনেক কিছু লিখে দিতেন।
প্রশ্ন করলাম, বন্ধুদের দিতেন?
তিয়া শিশুসুলভ হাসি ছড়িয়ে জবাব দিলেন, ‘না...কাউকে দিতাম না। আমি খুব উপভোগ করতাম।’
শেষের কথাগুলো জানতে চাই কবির মেয়েদের কাছে।
১৯৯৯ সালের ১৮ নভেম্বর অসুস্থ কবিকে পিজি হাসপাতালে নেওয়া হলো। পরদিন সন্ধ্যায় অবস্থার অবনতি হলে কেবিন থেকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হলো কবিকে। দুলু আর টুলু সারা দিন ছিলেন হাসপাতালে। সন্ধ্যা থেকে মায়ের পাশে লুলু আইসিইউতে। আর তিয়ার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। একদিনও নানুকে দেখতে যেতে পারেননি। রাত ১২টার পর থেকে অবস্থার আরও অবনতি হলো। মেয়েকে কাছে ডেকে কবির শেষ কথা, শেষ জিজ্ঞাসা ছিল,
‘তুলসী খেয়েছে?’
তুলসী ছিলেন কবির সার্বক্ষণিক সেবিকা। মৃত্যুর আগেও তাঁর কথা ভোলেননি তিনি।
২০ নভেম্বর সকাল সাতটায় চিরতরে চলে গেলেন কবি সুফিয়া কামাল। পরিবার-পরিজর, আপন-পর সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যিনি নিজেকে সমুন্নত রেখেছিলেন, তুলসীর খাওয়া হলো কি না, তা জানার জন্য সেই মহীয়সীর মন তো আকুল হবেই।
কবির ‘সাঁঝের মায়া’য় সন্ধ্যাতারাটি পিদিম জ্বালে রোজ। সে আলো স্পর্শ করুক সবাইকে।
আর একবার খুলনায় নানুকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। তিয়া তখন সাত-আট বছরের। পরনে সাদা ফ্রক। সাদা ফিতায় দুই ঝুঁটি বাঁধা মাথা দুলিয়ে নানুর ‘গোল কোরো না, গোল কোরো না’ আবৃত্তি করল তিউনি। এত মানুষ দেখে তিউনি যাতে ভয় না পায়, সাহস জোগাতে মঞ্চ থেকে নানু হাত নাড়াচ্ছিলেন তাই।
পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন নানু আর নাতির পরিচয়? ‘গোল কোরো না’ ছড়াটি কিংবা ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা’—কবিতার এই লাইনটির সঙ্গে পরিচয় নেই, স্কুল পাস করা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ঠিক ধরেছেন, আমরা কবি সুফিয়া কামালের কথাই বলছি। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।
‘সাঁঝের মায়া’ নামের বাড়িটিতে যেদিন গেলাম, সেদিন তিয়া বলছিলেন অনেক কথা। ওঁর সঙ্গে ছিলেন মা সাঈদা কামাল আর খালা সুলতানা কামাল। সুফিয়া কামালের নাতি তিয়া শুরু করলেন কথা, তারই সূত্র ধরে কবির দুই মেয়ে খুললেন স্মৃতির ঝাঁপি।
তিয়া বললেন, ‘যেকোনো মানুষ মনে করতে পারত কবি সুফিয়া কামাল আমার আপনার লোক। ছোটখাটো মানুষটার মধ্যে ছিল এতখানি শক্তি!’
একবার বলেছিলেন রাশিয়া সফরের কথা। রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা, যাঁদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী, ছুটে এসেছিলেন স্রোতের মতো। যাঁদের কাছে মস্কো পৌঁছানোর জন্য টিকিট সংগ্রহ করার মতো টাকা ছিল না, তাঁদের কেউ কেউ নিজের প্রিয় ক্যামেরা কিংবা দরকারি জিনিসপত্র বিক্রি করে এসেছিলেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিয়াকে কবি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া’।
কবি সুফিয়া কামাল ছয় সন্তানের জননী। আমেনা খাতুন দুলু, শাহেদ কামাল শামীম, আহমদ কামাল শোয়েব (মৃত), সাজেদ কামাল শাব্বির, সুলতানা কামাল লুলু ও সাঈদা কামাল টুলু। দুলুর দুই ছেলে কওসার, মুরাদ ও মেয়ে সিমিন। শাব্বির তনয় অশোক, লুলুর (সুলতানা কামাল) মেয়ে দিয়া ও টুলুর (সাঈদা কামাল) মেয়ে তিয়া। বড় ছেলে শামীম অকৃতদার। জমজমাট পরিবার। দিয়া বড় হয়েছে সিলেটে, অশোক বিদেশে। আর তিয়ার শৈশব, কৈশোরের পরম অবলম্বন নানি। একসঙ্গে বসে খাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে সময় কাটানো—সবকিছু নানিকে ঘিরে।
বিড়াল ভালোবাসতেন কবি। ‘এ বাড়িতে পোষা কুকুর-বিড়ালেরা ঘুরে বেড়াত। একবার তো বিড়ালের সংখ্যা সতেরো হয়ে গেল। একটা বিড়াল প্রায়ই হাওয়া হয়ে যেত, আবার ফিরে আসত। মা ওর নাম দিয়েছিলেন অতিথি,’ বললেন সাঈদা কামাল।
কবি কখনো কাউকে তাঁর ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের প্রথম হওয়ার কথা বলতেন না। বরং গুরুত্ব দিতেন ভালো ফলাফলের। কখনো খারাপ করলে অনুপ্রেরণা দিতেন। খেলতে গিয়ে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে প্রতিশোধপরায়ণ না হতে বলতেন, ‘তুমি আদব শিখবে বেয়াদবের কাছ থেকে।’ কিংবা ‘জবান শিরি তো মুলুক গিরি’। অর্থাৎ, মিষ্টি কথা দিয়ে জয় করাই উত্তম।
তিয়া পাশের বাড়িতে মইনুদ্দীন নাজির স্যারের কাছে গান শিখতে যেতেন। ‘প্রতিটি ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরলে, নানি জানতে চাইতেন কী শিখলাম’। দিয়া রবীন্দ্রসংগীত শিখতেন। ওয়াহিদুল হক সিলেটে গেলে তাঁর কাছ থেকে গান তুলে নিতেন দিয়া। ছোট্ট দিয়ার কাছ থেকে তিয়া শিখেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলি শোনো শোনো পিতা...’ গানটি কবির খুব প্রিয়। নানিকে গান শোনানোর সময়, দুই বোনকে প্রথমেই ওই গানটি করতে হতো।
স্কুলের দিনগুলোতে নানির লেখা কবিতা পাঠ্য। ব্যাখ্যা, প্রশ্ন, ভাবসম্প্রসারণ তিয়া বুঝতে গেলেই নানি খুব উৎসাহ নিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। নোট তৈরি করে স্কুলের বন্ধুদের দেখানো হতো। কখনো কখনো নানু নিজেও অনেক কিছু লিখে দিতেন।
প্রশ্ন করলাম, বন্ধুদের দিতেন?
তিয়া শিশুসুলভ হাসি ছড়িয়ে জবাব দিলেন, ‘না...কাউকে দিতাম না। আমি খুব উপভোগ করতাম।’
শেষের কথাগুলো জানতে চাই কবির মেয়েদের কাছে।
১৯৯৯ সালের ১৮ নভেম্বর অসুস্থ কবিকে পিজি হাসপাতালে নেওয়া হলো। পরদিন সন্ধ্যায় অবস্থার অবনতি হলে কেবিন থেকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হলো কবিকে। দুলু আর টুলু সারা দিন ছিলেন হাসপাতালে। সন্ধ্যা থেকে মায়ের পাশে লুলু আইসিইউতে। আর তিয়ার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। একদিনও নানুকে দেখতে যেতে পারেননি। রাত ১২টার পর থেকে অবস্থার আরও অবনতি হলো। মেয়েকে কাছে ডেকে কবির শেষ কথা, শেষ জিজ্ঞাসা ছিল,
‘তুলসী খেয়েছে?’
তুলসী ছিলেন কবির সার্বক্ষণিক সেবিকা। মৃত্যুর আগেও তাঁর কথা ভোলেননি তিনি।
২০ নভেম্বর সকাল সাতটায় চিরতরে চলে গেলেন কবি সুফিয়া কামাল। পরিবার-পরিজর, আপন-পর সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যিনি নিজেকে সমুন্নত রেখেছিলেন, তুলসীর খাওয়া হলো কি না, তা জানার জন্য সেই মহীয়সীর মন তো আকুল হবেই।
কবির ‘সাঁঝের মায়া’য় সন্ধ্যাতারাটি পিদিম জ্বালে রোজ। সে আলো স্পর্শ করুক সবাইকে।
No comments