চারদিক-মণিপুরি মহা রাসলীলা উৎসব by মুজিবুর রহমান

রস শব্দ থেকেই রাস শব্দের উৎপত্তি। রস আস্বাদনের জন্য রাধা-কৃষ্ণের লীলানুকরণে নৃত্যগীতের মাধ্যমে যে উৎসব উদ্যাপন করা হয়, তা-ই রাসোৎসব। নৃত্য-সংগীত্রে মণিপুরিদের প্রাচীন জাতীয় লোকনৃত্য ‘লাই হারাওবা’ থেকেই রাসনৃত্যের সৃষ্টি। মণিপুরিদের সম্প্রদায়ের মহারাস বলতে প্রেমরসকে বোঝানো হয়। এ লীলার অনেক তাৎপর্য রয়েছে।


প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলে রাস উৎসবের প্রস্তুতি। মণিপুরি সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী-কিশোরদের রাসলীলায় অংশ নেওয়ার জন্য নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাসলীলার ওস্তাদ এনে শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেছিলেন, তা-ই রাসনৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর ১০০ বছর পর মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে গোটা রাসনৃত্য আচৌকা ভঙ্গি, বৃন্দাবন ভঙ্গি, খুডুম্বা ভঙ্গি, গোষ্ঠ ভঙ্গি, গোষ্ঠ বৃন্দাবন ভঙ্গি, আচৌবা, বৃন্দাবন ভঙ্গি তাণ্ডব পর্যায়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশির ভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তাঁরা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশ নিতেন। ফলে মণিপুরিরা এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কোনো বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদ্যাপন করে আসছে এই রাস উৎসব। ১৯২৬ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরি মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাসনৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্যশিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা।
মণিপুরি সম্প্রদায়ের কুমারীরা রাসলীলায় অংশ নেওয়ার জন্য নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়। ২ নভেম্বর রাতে অনুষ্ঠিত হয় মহা রাসলীলা। শুরুতেই রাধার সাজে সজ্জিত একজন নৃত্যশিল্পী মঞ্চে আসেন। তাঁর নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যের তালে তালে পরিবেশিত হয় মণিপুরি বন্দনাসংগীত। এরপর শ্রীকৃষ্ণ রূপধারী বাঁশি হাতে মাথায় কারুকার্যখচিত ময়ূরপুচ্ছধারী এক কিশোর নৃত্যশিল্পী আসে, তার বাঁশির সুর শুন্রে ব্রজগোপী পরিবেষ্টিত হয়ে রাধা মঞ্চে আসে। শুরু হয় সুবর্ণ কঙ্কন পরিহিতা মণিপুরি কিশোরীদের্রনৃত্য প্রদর্শন। এর আগে বেলা তিনটা থেকে নানা বর্ণের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি পোশাক পরে ছোট ছোট মণিপুরি শিশু রাখালনৃত্য পরিবেশন করে।
গত সোমবার কমলগঞ্জের ঐতিহাসিক মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে বিষ্ণুপ্রিয়া ও আদমপুর সেনা ঠাকুরের প্রধান মণ্ডপে মৈথৈ মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহা রাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। সন্ধ্যা ছয়টায় এই মহা রাসলীলায় মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের উৎসবে এবার অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া উপস্থিত থাকবেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। অপরদিকে কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরে বেলা ১১টা মৈথৈ সম্প্রদায়ের মণিপুরি রাস উৎসব উদ্যাপন করা হবে। সন্ধ্যায় আদমপুরে বসে মূল রাসনৃত্য ও রাখালনৃত্য। আদমপুর ও মাধবপুরের রাস উৎসবে মণিপুরি মেয়েরা গোপী সেজে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাসলীলায় মেতে উঠবে। মণিপুরি মেয়েদের রাসনৃত্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনসহ জাতি-ধর্মনির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসে। মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহা রাসলীলা শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে এবার ১৬৮তম ও আদমপুরে সেনা ঠাকুরের মণ্ডপে ২৫তম মহা রাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.