শেকড়ের ডাক-রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, একটি বিবৃতি ও কিছু কথা by ফরহাদ মাহমুদ
চলতি মাসে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে শত শত রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ কারণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি তাদের অনুপ্রবেশে বাধা দেয়। বাংলাদেশের এই পদক্ষেপে বিরক্ত হয় ইউএনএইচসিআরসহ পশ্চিমা কিছু দেশ।
তারা রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জবাবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের অপারগতার কথা প্রকাশ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পরামর্শ দিয়েছেন। এরই মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন এনজিও ব্যক্তিত্ব ও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের এই অবস্থানের সমালোচনা করে বলেছেন, যে দেশের এক কোটি মানুষ ১৯৭১ সালে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই দেশ রোহিঙ্গা মুসলমানদের শরণার্থী হিসেবে এ দেশে আসার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। ইতিমধ্যে কোনো কোনো কলাম লেখকও একই কথা প্রতিধ্বনিত করেছেন।
এই বিবৃতির ভাষা আমার মতো অনেকের মনেই নানামুখী প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর ট্যাংক-কামান নিয়ে সেনাবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং পরবর্তী ৯ মাসে সারা দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছিল, তার সঙ্গে মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কী কোনো তুলনা চলে? সে সময় এক কোটি মানুষ ভারতে গেলেও তারা সেখানে গিয়ে উঠেছিল আশ্রয়শিবিরে। তারা সে দেশের বন-জঙ্গল বা সরকারি জমি দখল করে বাড়িঘর বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছিল কি? কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা কী করছে? বাংলাদেশে প্রথম বড় ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত বন বিভাগের নিসর্গ প্রজেক্টের প্রকাশনা অনুযায়ী সত্তরের দশকের শেষেও টেকনাফ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে মূল বনভূমি ছিল ১০০ শতাংশ। অথচ ২০০৫ সালে তাদেরই হিসাবে সেখানে মূল বনভূমি রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। বাংলাদেশিদের আশ্রয় প্রদানের জন্য ভারতকে কি এত বড় মূল্য দিতে হয়েছিল?
বর্তমানে সরকারি নথিভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে মাত্র ২৭ হাজার। কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। বাকি পৌনে পাঁচ লাখের কেউ রেজিস্টার্ড বা শিবিরের বাসিন্দা নয় এবং কোথাও তালিকাভুক্ত নয়। এরা কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে এদের ব্যাপক আগমন ঘটলেও ৩০ বছর ধরেই এরা আসছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ৮ জুন। অথচ ১৫ জুনের ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন বছর ধরেই গড়ে প্রতিদিন ১০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এরা কি শরণার্থী, না অনুপ্রবেশকারী? অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা কি আমাদের অজানা? যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে অনুপ্রবেশকারীদের নৌকায় সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী কি গুলি পর্যন্ত চালায়নি?
রোহিঙ্গারা শুধু আসে না, নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। চোরাচালানের মালামাল আনা-নেওয়া করে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের অপকর্ম নিয়ে পত্রপত্রিকায় শত শত খবর বেরিয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি, বিবৃতিদাতারাও সেসব খবর পড়েছেন। সেসব খবরের ভাষ্য হচ্ছে- ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক চোরাচালান, অস্ত্র চোরাচালান, চুরি-ডাকাতি ও নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে আগত রোহিঙ্গারা ব্যাপকভাবে জড়িত। এদের কারণে কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটা অবনতি হয়েছে যে স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষে সেখানে বসবাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিবৃতিদাতারা কি বলতে পারবেন, ১৯৭১ সালে এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়ে এ ধরনের তৎপরতা চালিয়েছিল কি না? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে তাঁরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে ১৯৭১ সালের শরণার্থীদের মেলান কিভাবে?
বাংলাদেশের ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ক্ষতি হচ্ছে। কিছুদিন পর পরই পুলিশ কক্সবাজার উপকূল থেকে নৌকাযোগে সমুদ্রযাত্রার প্রাক্কালে রোহিঙ্গাদের আটক করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আন্দামান উপকূল থেকে এ রকম কয়েক শ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী এসব রোহিঙ্গা নৌকার ওপর বেশ কয়েকবার গুলিও চালিয়েছে। ১৯ জুনের বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি খবরের শিরোনাম ছিল- বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে রোহিঙ্গা পাচারের সঙ্গে জড়িত ১৩টি চক্র। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের এসব অপতৎপরতার মাসুল বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি যুবকদেরও দিতে হয়েছে। এদেরই কারণে মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বারবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বিবৃতিদাতারা এর পরও কিভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানান?
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ দেশের ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আফগান যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশি তালেবানদের সঙ্গে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা তালেবানও বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। সে সময় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) এবং আরো কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতা সে কথা স্বীকারও করেছেন। বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে এই জঙ্গিদের একাধিক ঘাঁটিও আবিষ্কৃত হয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি দৈনিক সমকালে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, 'বিভক্ত রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। অস্ত্র কেনার জন্য তারা ৫০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।' একই খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা সম্প্রতি সৌদি আরবের রিয়াদে বৈঠক করেছেন। সেখানে 'আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন' (এআরইউ) নামে একটি একক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। মানবিকতার দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিবৃতিদাতারা কি এ দেশে আবার জঙ্গিবাদ আমদানি করতে চান? এ দেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে ইউএনএইচসিআর, কিছু পশ্চিমা দেশ ও এনজিও। আর অতীতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে প্রশাসনও তাতে সমর্থন জুগিয়ে গেছে। নাফ নদীর পারে 'আহলান ওয়া সাহলান' অর্থাৎ স্বাগতম, সুস্বাগতম লেখা বিশাল বিশাল ব্যানার টানিয়ে তাদের ডেকে আনা হয়েছে। উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে শ-দুয়েক লোককে কানাডা ও কিছু পশ্চিমা দেশে অভিবাসন দেওয়া হয়েছে। আর সেসব খবর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পশ্চিমা দাতা সংস্থাগুলো এখন এ দেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নীরব থাকতে পারে না, থাকা উচিতও নয়। কারণ এটি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
আগেই বলেছি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে কক্সবাজারের বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফা রোহিঙ্গা-বাঙালি সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। অচিরেই এটি বড় ধরনের দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। তাঁরা যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর এবং আগে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন। গত বুধবার স্থানীয় বাসিন্দারা এসব দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁরা নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁদের বক্তব্য একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়। পাঠকদের জন্য দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবরটির অংশবিশেষ তুলে ধরছি- "উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানরত কিছু মৌলবাদী, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরএসওর সক্রিয় সদস্য পরিকল্পিতভাবে রাখাইন প্রদেশে জাতিগত সহিংসতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের নীলনকশা রচনা করে। তারা কক্সবাজারকে মিয়ানমারের একটি 'অঙ্গরাজ্যে' পরিণত করতে চায়। সে জন্য এ দেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবার নামে রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে এমএসএফ (হল্যান্ড), আরটিএম, ভার্ক, মুসলিম এইড, টাইসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা।"
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না, অথচ কয়েক শ বছর ধরে বংশপরম্পরায় তারা সে দেশে বসবাস করছে। রয়টার্সসহ ইউরোপীয় বেশ কিছু বার্তা সংস্থার খবরেও তাদের 'রাষ্ট্রহীন দক্ষিণ এশীয় মুসলমান' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সে দেশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় দেশগুলো কেন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে না- সেটিও আমাদের বোধগম্য নয়। সংগত কারণেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, আমরা তাকে যৌক্তিক ও উপযুক্ত পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করছি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
লেখক : সাংবাদিক
এই বিবৃতির ভাষা আমার মতো অনেকের মনেই নানামুখী প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর ট্যাংক-কামান নিয়ে সেনাবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং পরবর্তী ৯ মাসে সারা দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছিল, তার সঙ্গে মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কী কোনো তুলনা চলে? সে সময় এক কোটি মানুষ ভারতে গেলেও তারা সেখানে গিয়ে উঠেছিল আশ্রয়শিবিরে। তারা সে দেশের বন-জঙ্গল বা সরকারি জমি দখল করে বাড়িঘর বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছিল কি? কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা কী করছে? বাংলাদেশে প্রথম বড় ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত বন বিভাগের নিসর্গ প্রজেক্টের প্রকাশনা অনুযায়ী সত্তরের দশকের শেষেও টেকনাফ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে মূল বনভূমি ছিল ১০০ শতাংশ। অথচ ২০০৫ সালে তাদেরই হিসাবে সেখানে মূল বনভূমি রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। বাংলাদেশিদের আশ্রয় প্রদানের জন্য ভারতকে কি এত বড় মূল্য দিতে হয়েছিল?
বর্তমানে সরকারি নথিভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে মাত্র ২৭ হাজার। কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। বাকি পৌনে পাঁচ লাখের কেউ রেজিস্টার্ড বা শিবিরের বাসিন্দা নয় এবং কোথাও তালিকাভুক্ত নয়। এরা কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে এদের ব্যাপক আগমন ঘটলেও ৩০ বছর ধরেই এরা আসছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ৮ জুন। অথচ ১৫ জুনের ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন বছর ধরেই গড়ে প্রতিদিন ১০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এরা কি শরণার্থী, না অনুপ্রবেশকারী? অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা কি আমাদের অজানা? যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে অনুপ্রবেশকারীদের নৌকায় সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী কি গুলি পর্যন্ত চালায়নি?
রোহিঙ্গারা শুধু আসে না, নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। চোরাচালানের মালামাল আনা-নেওয়া করে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের অপকর্ম নিয়ে পত্রপত্রিকায় শত শত খবর বেরিয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি, বিবৃতিদাতারাও সেসব খবর পড়েছেন। সেসব খবরের ভাষ্য হচ্ছে- ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক চোরাচালান, অস্ত্র চোরাচালান, চুরি-ডাকাতি ও নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে আগত রোহিঙ্গারা ব্যাপকভাবে জড়িত। এদের কারণে কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটা অবনতি হয়েছে যে স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষে সেখানে বসবাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিবৃতিদাতারা কি বলতে পারবেন, ১৯৭১ সালে এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়ে এ ধরনের তৎপরতা চালিয়েছিল কি না? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে তাঁরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে ১৯৭১ সালের শরণার্থীদের মেলান কিভাবে?
বাংলাদেশের ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ক্ষতি হচ্ছে। কিছুদিন পর পরই পুলিশ কক্সবাজার উপকূল থেকে নৌকাযোগে সমুদ্রযাত্রার প্রাক্কালে রোহিঙ্গাদের আটক করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আন্দামান উপকূল থেকে এ রকম কয়েক শ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী এসব রোহিঙ্গা নৌকার ওপর বেশ কয়েকবার গুলিও চালিয়েছে। ১৯ জুনের বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি খবরের শিরোনাম ছিল- বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে রোহিঙ্গা পাচারের সঙ্গে জড়িত ১৩টি চক্র। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের এসব অপতৎপরতার মাসুল বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি যুবকদেরও দিতে হয়েছে। এদেরই কারণে মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বারবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বিবৃতিদাতারা এর পরও কিভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানান?
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ দেশের ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আফগান যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশি তালেবানদের সঙ্গে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা তালেবানও বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। সে সময় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) এবং আরো কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতা সে কথা স্বীকারও করেছেন। বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে এই জঙ্গিদের একাধিক ঘাঁটিও আবিষ্কৃত হয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি দৈনিক সমকালে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, 'বিভক্ত রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। অস্ত্র কেনার জন্য তারা ৫০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।' একই খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা সম্প্রতি সৌদি আরবের রিয়াদে বৈঠক করেছেন। সেখানে 'আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন' (এআরইউ) নামে একটি একক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। মানবিকতার দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিবৃতিদাতারা কি এ দেশে আবার জঙ্গিবাদ আমদানি করতে চান? এ দেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে ইউএনএইচসিআর, কিছু পশ্চিমা দেশ ও এনজিও। আর অতীতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে প্রশাসনও তাতে সমর্থন জুগিয়ে গেছে। নাফ নদীর পারে 'আহলান ওয়া সাহলান' অর্থাৎ স্বাগতম, সুস্বাগতম লেখা বিশাল বিশাল ব্যানার টানিয়ে তাদের ডেকে আনা হয়েছে। উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে শ-দুয়েক লোককে কানাডা ও কিছু পশ্চিমা দেশে অভিবাসন দেওয়া হয়েছে। আর সেসব খবর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পশ্চিমা দাতা সংস্থাগুলো এখন এ দেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নীরব থাকতে পারে না, থাকা উচিতও নয়। কারণ এটি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
আগেই বলেছি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে কক্সবাজারের বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফা রোহিঙ্গা-বাঙালি সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। অচিরেই এটি বড় ধরনের দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। তাঁরা যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর এবং আগে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন। গত বুধবার স্থানীয় বাসিন্দারা এসব দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁরা নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁদের বক্তব্য একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়। পাঠকদের জন্য দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবরটির অংশবিশেষ তুলে ধরছি- "উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানরত কিছু মৌলবাদী, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরএসওর সক্রিয় সদস্য পরিকল্পিতভাবে রাখাইন প্রদেশে জাতিগত সহিংসতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের নীলনকশা রচনা করে। তারা কক্সবাজারকে মিয়ানমারের একটি 'অঙ্গরাজ্যে' পরিণত করতে চায়। সে জন্য এ দেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবার নামে রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে এমএসএফ (হল্যান্ড), আরটিএম, ভার্ক, মুসলিম এইড, টাইসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা।"
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না, অথচ কয়েক শ বছর ধরে বংশপরম্পরায় তারা সে দেশে বসবাস করছে। রয়টার্সসহ ইউরোপীয় বেশ কিছু বার্তা সংস্থার খবরেও তাদের 'রাষ্ট্রহীন দক্ষিণ এশীয় মুসলমান' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সে দেশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় দেশগুলো কেন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে না- সেটিও আমাদের বোধগম্য নয়। সংগত কারণেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, আমরা তাকে যৌক্তিক ও উপযুক্ত পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করছি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments