রোহিঙ্গা শরণার্থী-তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যথা by মুহাম্মদ ইব্রাহীম

এবারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে নির্দয় আচরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বসমাজের কাছে আমাদের মানবতাবোধ সম্পর্কে ভুল বার্তা দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এটি এ দেশের মানুষকে নিজ নিজ বিবেকের কাছে অপরাধবোধে জর্জরিত করেছে।


অসহায়ের প্রতি যে সহমর্মিতা ও প্রাণখোলা আতিথ্যদানের জন্য আমরা গর্ব করি, সেই গর্ব এতে আহত হয়েছে। বিশেষ করে প্রাণভয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভীত মানুষের প্রতি অপ্রয়োজনীয় কঠিন আচরণ ও নিষ্ঠুর বাক্যের মাধ্যমে আমরা যা করেছি, তার ব্যথা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
এ কাজের জন্য এ বিষয়ে দেশের অতীত ভোগান্তির দোহাই দেওয়া হয়েছে, আমাদের অর্থনৈতিক অপারগতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আধমরা, ভীত, সর্বস্বান্ত মানুষ আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাকে আগে আশ্রয় দিয়ে, রক্ষা করে, প্রয়োজনে পরে হিসাব-নিকাশে বসাই তো বিশ্বজনীন মানবতার নিয়ম। এতে ঝুঁকি আছে, অপরিণামদর্শিতার বিপদ আছে, তা কে না জানে। কিন্তু সেই ঝুঁকি ও বিপদ অগ্রাহ্য করে মানুষকে বাঁচানোই তো মানবতার ধর্ম। এ ধর্ম পালনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
এ প্রাথমিক কর্তব্যটি পালন করার পর আমরা সাবধান হতে পারতাম। অপ্রয়োজনীয়ভাবে, ভিন্ন কারণে আরও কেউ আসছে কি না, সে ব্যাপারে সতর্ক হতে পারতাম। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে মিয়ানমারের সঙ্গে, বিশ্ব সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সুরাহাগুলো করতে পারতাম। অন্তত চেষ্টা করতে পারতাম পরের ধাক্কা সামাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা না করে, বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে আমরা হাঁক দিয়েছি, ‘খবরদার! তুমি বাঁচো কি মরো সে তোমার ব্যাপার, তোমার দেশের ব্যাপার, এখানে তোমার জায়গা নেই।’ এটা কি আমরা ঠিক কাজ করলাম? বিশেষ করে সেই আমাদের, যাদের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হলো এমনই অসহায়ত্বের সময় প্রতিবেশীর দুই হাত বাড়ানো আলিঙ্গনের স্মৃতি। তারা কি সেদিন এ জন্য নিজেদের কী হবে সে-কথা বিবেচনায় এনেছিল?
আরেকটি কারণে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য আমাকে যাতনা দিচ্ছে, সেটি বলার জন্যই বেশ কিছু লেখা হয়ে যাওয়ার পরও নিজে লেখার তাগিদ অনুভব করছি। শৈশব থেকে এই মানুষগুলো আমার খুব পরিচিত। ছোটবেলায় নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেককেই দেখেছি আকিয়াবে প্রায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে—যে শহরটি আজও শিৎওয়ে নাম নিয়ে রাখাইন (আরাকান) প্রদেশের রাজধানী। সেই প্রবাসীদের মুখে আকিয়াব, মংডু, ভূদিতং প্রভৃতি শহরের গল্প শুনে চমৎকৃত হয়েছি। নাফ নদীর ওপারের ওই মায়াভরা সব জায়গার গল্প আমার শৈশব স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে। সে সময় আশপাশের সবাইকে একটি বিষয় নিয়ে খুব মজা করতে দেখতাম। রোহাইঙ্গা ভাষার টানটি আমাদের চাটগাঁইয়া ভাষার থেকে খুব সূক্ষ্মভাবে কিছুটা ভিন্ন (যদিও উভয়েরই প্রায় অভিন্ন কথ্য ভাষা)। ব্যাপারটি অবশ্য দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা থেকেই কিছুটা শুরু হয়ে যায়, তাই পরে ওখানকার স্কুলবন্ধুদের আমরা প্রায়ই রোহাইঙ্গা বলে খেপাতাম। স্কুলে ওপরের ক্লাসে একজন ছাত্র ছিলেন, যাঁর আসল নামই ছিল আরাকানি, তাঁর পরিবার আরাকান থেকে এসেছিল। বাংলার চেয়ে চাটগাঁইয়া ভাষাতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন—নেতৃস্থানীয় ছাত্র বলে এখনো তাঁর কথা খুব মনে পড়ে।
স্কুলের নিচের ক্লাসের দিকে বুলবুল চৌধুরীর লেখা প্রাচী উপন্যাসটি পড়েছিলাম। বুলবুল চৌধুরী (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি যাঁর নামে) চট্টগ্রামেরই সন্তান। চমৎকার ওই উপন্যাসটির কাহিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডামাডোলের সময় স্থানীয় জাতিগত দাঙ্গায় বিপর্যস্ত বাঙালি শরণার্থীদের হেঁটে বার্মা ত্যাগ নিয়ে। এই দীর্ঘ পদযাত্রায় অনেক মানুষ, অনেক পরিবার মারা গেছে; পথে পথে দাঙ্গাবাজদের ও অসুখের আক্রমণে।
অনাহারে কলাগাছের শাঁস খেয়ে, বাকিরা আরাকানের ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেছে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে গিয়ে। সেই শিউরে ওঠা কাহিনি এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। ওই রকম পালিয়ে আসা মানুষের অভিজ্ঞতার রেশ থেকেই হয়তো একেবারে শৈশবে আরাকান রোডের কাছের আমাদের গ্রামে দুষ্টু ছেলেদের ভয় লাগানোর জন্য বড়দের বলতে শুনেছি, কিরিচ হাতে ওই মগেরা এল বলে। আজও সেই সামপ্রদায়িক কারণে সেই দেশের লোক হয়েও রোহিঙ্গারা একই পরিণতি ভোগ করছে।
রোহিঙ্গাদের বর্তমান ভাগ্যবিড়ম্বনার সঙ্গে ওই সব শৈশবস্মৃতি আলাদা করা অসম্ভব। ইতিহাস, ভূগোল আর ভাষা যাদের আমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে, তাদের করুণ আর্তিতে সাড়া দেওয়াটা নেহাত নৈর্ব্যক্তিক মানবতার বিষয় মাত্র নয়, আত্মীয়তার টানের বিষয়ও বটে। কয়েক দিন আগে বিবিসি ওয়ার্ল্ড রেডিওতে মালয়েশিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে (শিবিরটি আগে থেকেই সেখানে রয়েছে) ফাতেমা নামের বছর দশেকের একটি মেয়ের সাক্ষাৎকার শুনলাম। ব্রিটিশ সাংবাদিক ইংরেজিতে প্রশ্ন করছেন, মেয়েটি যেভাবে তার জবাব দিল তা শুনে চমকে উঠলাম। সুদূর মালয়েশিয়ায় চিরপরিচিত চাটগাঁইয়া ভাষায় এই যে মেয়েটি তাদের পরিবারের অবর্ণনীয় দুর্দশার বর্ণনা দিচ্ছিল, আমার গ্রামের যেকোনো বালিকার থেকে তাকে আলাদা করে ভাবতে পারছিলাম না। নিজের জীবনটা বাঁচাতে সে কেন আমার দেশে আপাতত আশ্রয়টুকু পাবে না?
একেবারে দূরসম্পর্কের আত্মীয়, এমনকি শুধু ভাষার মিল আছে এরকমের কেউ বিপদে পড়ে দেশে বা বিদেশে আমাদের দোরগোড়ায় যদি হাজির হয়, তার প্রতি উজাড় করা বেহিসাবি আতিথ্যের জন্য বাঙালির সুনাম/দুর্নামের কথা দুনিয়ার অনেকে জানে। একাত্তরে আমরা কোটি মানুষ যখন যশোর রোড ধরে প্রতিবেশীর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলাম, তখন তারা শুধু মানবতার কর্তব্য করেনি, আত্মীয়তার কর্তব্যও করেছিল। এর সবকিছু আজ আমরা বিস্মৃত হলাম কেমন করে? আহত, চরম অসহায় মানুষগুলোকে ওই অবস্থায় দেখেও আমরা কেন এত অস্বাভাবিকভাবে পরিণামদর্শী হয়ে উঠলাম। যাবতীয় বিষয়বুদ্ধি আমাদের এমনভাবে পেয়ে বসল যে ওই ভাষায়, ওই কঠোরতায়, আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলাম। এই দুঃখ রাখি কোথায়?
 ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক।

No comments

Powered by Blogger.