সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-অগ্রসরমান নারীসমাজ ও প্রস্তাবিত নারীনীতি by মাহবুবুল হক শাকিল

এদেশের নারী আজ সরকারের সচিব, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিমানচালক। গৃহশ্রমকে যদি টাকার নিক্তিতে পরিমাপ করা যায় তাহলে আমাদের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ জোগান দেন নারীরা। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলই বলে দেয়, মেধার পরীক্ষায় কীভাবে সামনের সারিতে উঠে আসছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা


বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি লক্ষণীয় বিষয়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম বা মুসলিম লীগের নেতৃত্বে তাদের সাধের পাকিস্তান রক্ষায় শান্তি কমিটি, আলবদর, রাজাকার ও আল-শামস গড়ে উঠলেও সেখানে কোনো নারী আলবদর বা নারী রাজাকারের নাম পাওয়া যায়নি। পক্ষান্তরে শুধু দুই লাখ নারী তাদের সম্ভ্রমই হারাননি, এদেশের নারী সমাজ সেদিন সৃষ্টি করেছিল সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়ার সাহসী উদাহরণ।
ফ্রান্সের জোয়ান অব আর্কের মতো বাংলাদেশ পেয়েছিল বীরপ্রতীক তারামন বিবিকে। সাজেদা চৌধুরী, রাফিয়া আক্তার ডলি, ক্যাপ্টেন সিতারার মতো নারী মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য লড়াই করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণা গ্রেনেড চার্জ করে পাকবাহিনীর গানবোট উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সুলতানা কামাল লুলুরা প্রগাঢ় দেশপ্রেমের তাগিদে ভাইদের পাশে থেকে সাহায্য করেছেন, সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে শাহীন সামাদ, মালা খান, সুমিতা নাহা, কল্যাণী ঘোষ, নমিতা ঘোষ ও রূপা ফরহাদরা জাগিয়ে রাখতেন অবরুদ্ধ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে।
বাঙালির স্বাধীনতার মহত্তম সুপ্তস্বপ্নের উদ্বোধন হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। সেখানেও নারীরা অগ্রপথিক সেনাদলের ভূমিকায়। রওশন আরা বাচ্চু, সোফিয়া করিম, সাফিয়া খাতুন, মমতাজ বেগম, সুফিয়া আহমেদরা একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলের সামনের সারিতে থেকে সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন দীর্ঘ সংগ্রামের নেপথ্য প্রেরণাদায়িনীই শুধু নন, তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সুনিপুণভাবে দলকে পরিচালনা করতেন নিভৃতভাবে, পাদপ্রদীপের আলোয় না এসে।
'৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ঢাকার রাজপথে কালো পতাকা নিয়ে মিছিলরত শেখ হাসিনার ছবি এবং '৭১-এর মার্চের উত্তাল রাজপথে ডামি রাইফেল কাঁধে মতিয়া চৌধুরীর কুচকাওয়াজের সাদাকালো ছবি আজ কোনো ব্যক্তির ছবি নয়, বাঙালির দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামে নারীর সাহসী ভূমিকার প্রতীকী ছবি। কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় উঠে এসেছিল স্বাধীনতার জন্য সখিনা বিবির কপাল ভাঙ্গার দীর্ঘশ্বাস, হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে যাওয়ার বোবা কান্না।
চলিল্গশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের। এই পথচলায় অনেক অপ্রাপ্তি, অনেক ব্যর্থতা অবশ্যই রয়েছে এই জনসংখ্যাপীড়িত, দারিদ্র্যকবলিত দেশের। কিন্তু আমাদের অর্জন কি খুবই কম? আমরা কি কয়েক কদমও অগ্রসর হতে পারিনি? যে পাকিস্তানকে ত্রিশ লাখ শহীদের লাশের নিচে কবর দিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি সেই পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করলে বলতেই হবে, অনেক ভালো আছি আমরা। অন্তত ফতোয়ার বিরুদ্ধে কথা বললে পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরের মতো আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের লাশ হতে হয় না। আমাদের শিশুদের আফিম ক্ষেতে শ্রম বিক্রি করে জীবিকার হাতেখড়ি হয় না। বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানের মতো সামরিক আমলাতন্ত্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর গণতন্ত্রের জন্ম-মৃত্যু নির্ভর করে না।
বিশ্বমন্দার সংকট সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। দারিদ্র্যহার, মাতৃমৃত্যুহার, শিশুমৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশের অর্জন আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। শুধু গত দুই বছরে আমাদের দারিদ্র্য কমেছে ১০ ভাগ, যা আজকের বিশ্বঅর্থনীতির টালমাটাল সময়ে একটি উলেল্গখযোগ্য সাফল্য। ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এদেশের সাক্ষরতার হার। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের সাফল্য থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী অলিম্পিকে আমাদের সন্তানদের সাফল্য, উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ থেকে পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ_ আমাদের জাতীয় অর্জন, বাংলাদেশ সৃষ্টির ফল।
চলিল্গশ বছরের এই অগ্রগতির পথচলায় আমাদের নারীরা পালন করেছেন নিয়ামক ভূমিকা। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস গার্মেন্ট শিল্প দাঁড়িয়ে আছে নারীশ্রমের ওপর। পুরুষ ধান উৎপাদন করে, কেটে নিয়ে আসে ক্ষেত থেকে। সেই ধান থেকে চাল, হোক তা ঢেঁকি দিয়ে বা ধানকলের মাধ্যমে, চাল বানিয়ে দেয় নারী। বাংলাদেশের সেবাখাত বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বুনিয়াদি স্তরে অবস্থান নারীর। রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই প্রবাসী নারী কর্মজীবীরা। এদেশের নারী আজ সরকারের সচিব, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক, সেনাকর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিমানচালক। গৃহশ্রমকে যদি টাকার নিক্তিতে পরিমাপ করা যায় তাহলে আমাদের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ জোগান দেন নারীরা। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলই বলে দেয়, মেধার পরীক্ষায় কীভাবে সামনের সারিতে উঠে আসছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা।
নব্বই-পরবর্তী একুশ বছরের সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই নেত্রী পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা। নারীরা সরাসরি নির্বাচনে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংসদের আসনে অধিষ্ঠিত। মন্ত্রিসভার 'পারফর্ম্যান্স লেভেল' বিবেচনায় দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা এবং সততায় নারীরাই এগিয়ে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে একদার প্রভু ব্রিটেনের পার্লামেন্টে আজ বাংলাদেশের কন্যা রোশনারা আলী এমপি।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক ইউনিয়ন পরিষদে তিনজন নারী সদস্য নির্বাচিত করার বিধান প্রবর্তনের ধারাবাহিকতায় আজ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীরা ক্রমে উঠে আসছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে। উপজেলা পরিষদে সরাসরি ভোটে নারী ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণকে আরও জোরালো করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচকও স্বীকার করবেন যে, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে মতাদর্শগত সমালোচনা থাকলেও প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতি অগ্রসরমান নারীসমাজের জন্য একটি মাইলফলক। এই নীতি বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। নারীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্যের পথ বন্ধের উপায় খুঁজতে চেয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদ বলছে, 'জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।'
সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ১ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।'
একই অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, 'নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।'
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকেই প্রস্তাবিত নারীনীতিতে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে 'বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা' (জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১, দ্বিতীয় ভাগ ১৬.১ অনুচ্ছেদ)।
প্রস্তাবিত নারীনীতির ১৭.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের, কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইনবিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা।'
১৮.৪ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, 'কন্যাশিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ দূরীকরণ এবং পরিবারসহ সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করা।'
প্রস্তাবিত নারীনীতির পাঠ থেকে বেরিয়ে আসে যে, আমাদের সংবিধান নারীকে যে অধিকার ও স্বীকৃতি দিয়েছে এই নীতি সেই সাংবিধানিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রকেই বিস্তৃত করেছে।
নারীনীতির কট্টর কিছু সমালোচক বলছেন, এই নীতি কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী। নিশ্চিতভাবেই তারা পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ ব্যতিরেকেই কথা বলছেন অথবা 'জেনেশুনে সত্য গোপন করছেন।'
তারা বলছেন, নারীনীতিতে সিডও সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এটি সত্য। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, সিডও সনদের যেসব ধারা আমাদের ধর্মীয় বিধান, সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসবিরোধী তাতে সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েই ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল।
সুতরাং প্রস্তাবিত নারীনীতিতে যখন বলা হয়, সিডও বাস্তবায়নের কথা তখন তা আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক বিধানবিরোধী যেসব ধারা সিডওতে সনি্নবেশিত এবং যাতে বাংলাদেশের লিখিত আপত্তি আছে তা বাদ রেখে বাস্তবায়নের কথাই বলা হয়। এক্ষেত্রে সরকার যা করতে পারে তা হলো, সুস্পষ্টভাবে উলেল্গখ করা যে, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথাবিরোধী ধারাগুলো বাদ দিয়ে সিডওর আলোকে এই নীতি বাস্তবায়ন করা হবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, নারী সংগঠনগুলো এই নীতির পক্ষে তেমনভাবে মাঠে নামছে না। একটি শীর্ষ নারী সংগঠনের এক নেত্রী এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, এই নীতিতে নারীদের দাবিদাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটেনি। হয়তো তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি সঠিক। এক্ষেত্রে তিনি যদি তার দাবি নিয়ে রাজপথে আসেন, নারী অধিকারের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি দাবি করেন সেটিও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে। অন্তত নারীনীতির বিরোধিতাকারী মোল্লাতন্ত্র তখন বুঝতে পারবে, সামনের দিনগুলোতে নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আরও ব্যাপকভাবে সামনে এগিয়ে আসবে যা ব্যাকফুটে হটিয়ে দেবে মোল্লাতন্ত্রের কূপমণ্ডূকতা আর নারীকে বন্দি রাখার পুরুষতান্ত্রিক অপচেষ্টাকে।

মাহবুবুল হক শাকিল
প্রধান নির্বাহী, সিআরআই, সাবেক
ছাত্রলীগ নেতা
 

No comments

Powered by Blogger.