সদরে অন্দরে-ঘুণপোকারা কি স্বাধীনতাস্তম্ভেও! by মোস্তফা হোসেইন

স্বাধীনতা মানুষের অস্তিত্বের পরিচয়। সেই স্বাধীনতা লাভের স্মৃতিকে প্রকাশের জন্য মানুষ যুগে যুগে বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যবহার করে। সে ক্ষেত্রে শিল্পকলা, সাহিত্য কিংবা সংগীতের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে আমাদের। সব দেশের মানুষই তেমনটি করে।


আমাদের দেশে শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ কিংবা ম্যুরাল ও ভাস্কর্য তার প্রধান উদাহরণ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিসৌধ কিংবা শহীদ মিনারের সঙ্গে আমাদের প্রাণের সংস্রব যেন সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি সৌধ কিংবা মিনারের পেছনেই একেকটি উপলক্ষ কাজ করেছে। এগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় করা হলেও সাধারণ মানুষের হৃদয়গ্রাহী হয় মূলত সাধারণ মানুষের চিন্তাচেতনা এবং গর্বকে ধারণ করে বলে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সব শহীদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ সে রকমই প্রমাণ বহন করে।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সিঁড়িটি স্থাপিত হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা ভাষার প্রতি বিমাতাসুলভ প্রথম প্রকাশ্য আচরণ করেছিলেন এই স্থানে। আর সেই আচরণকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল বাঙালি এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। এই প্রতিবাদকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে অধিকাংশই মনে করেন। তারপর সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় লাভের পরবর্তীকালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ হয়েছিল ওই মাঠে। সর্বোপরি ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বাঙালি জাতিকে মুক্তির লড়াইয়ে শরিক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল ওই স্থানেই। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ তথা বাঙালির বিজয় অর্জনের মাধ্যমে। সেও হয়েছিল সেই একই জায়গায়। তারপর স্বাধীনতা লাভের পরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে প্রথম যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাও এই একই জায়গায়। এমন একটি বিশাল স্থানকে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, স্বাধীনতা লাভ করার পরবর্তী ৩৯ বছর গত হয়ে গেলেও সে জায়গাটিকে চিহ্নিত করে সেখানে সৌধ নির্মাণের কাজটি শতভাগ সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করে। শুধু তা-ই নয়, এখানে সৌধ নির্মাণ করে আমাদের ইতিহাসকে সমুন্নত করার পরিবর্তে এর গুরুত্ব হ্রাস করার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর।
মানুষ অত্যন্ত আশায় বুক বেঁধেছিল ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখে। মনে হয়েছিল, জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতোই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি স্থাপনা ঐতিহাসিক স্থানটিতে হবে। এর পেছনে তৎকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘোষণার পর স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ আশান্বিত হয়েছিল। আশার মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছিল বিশ্বমানবতার কণ্ঠস্বর বলে কথিত বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এবং তামাম দুনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের মতো মহাপুরুষদের উপস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভের উদ্বোধন হওয়ার পর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সেই স্তম্ভটি শতভাগ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি তৎকালীন সরকারের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং আকাঙ্ক্ষাও মার খেয়ে যায় সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা কিংবা অবহেলার কারণে। সে সময়ও বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সরকারের মধ্যে বিভেদ হতে দেখা গেল স্পষ্টত। বিশেষজ্ঞ কমিটি পরিবর্তন হলো কোন কারণে তা প্রকাশ হলো না আজ অবধি। কিংবা সে সময় কোন কারণেই বা বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যানের পদাবনতি হয়েছিল কিংবা তিনিও কোন কারণে পদত্যাগ করেছিলেন, তা অজানা রয়ে গেছে আজ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কি বিশেষজ্ঞরাই জড়িত ছিলেন, নাকি সেখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এসে ভর করেছিল, তারও বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
কেউ জানতে চাইতে পারেন পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? প্রসঙ্গ পুরনো হলেও তার জের ধরে কিছু হচ্ছে_এমন সন্দেহ থেকেই এ প্রশ্নটি আসে। কারণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আগের সরকার আমলে যেভাবে বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়ে টানাটানি এবং একপর্যায়ে পদত্যাগের মতো ঘটনা ঘটেছিল, এবার কি তার চেয়ে বড় কিছু ঘটেছে? কিংবা দেশের অত্যন্ত গুণীজনদের নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরাই কোন কারণে পদত্যাগ করলেন? তাঁদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর উক্তিকে পদত্যাগের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ কমিটি উপস্থাপন করলেও তার বাইরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এমন নানা প্রশ্নের মুখেও বড় সত্যটি হচ্ছে_সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মূল পরিকল্পনাকে অক্ষুণ্ন রেখে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণকাজ কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত হওয়া এবং জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত হবে কি না। প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর উক্তি এবং পরবর্তীকালে ছয় বিশেষজ্ঞের পদত্যাগের কারণে।
মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, কার নাম আগে যাবে, এমন জেদ নাকি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের মধ্যে আছে। তাঁর কথা সত্যি হলে এটা হবে আমাদের জন্য দুঃখজনক। কারণ বিশেষজ্ঞরা আমাদের জাতির বিবেক বলে পরিচিত। তাঁদের নিয়ে আমরা প্রত্যেকেই গর্ব করি। তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী মহলেরও সামনের কাতারের। সুতরাং তাঁরা এমন কাজ করবেন, বিশ্বাস করতে মন চায় না। আবার এও প্রশ্ন আসে, বিশেষজ্ঞ কমিটি নামে কোনো কমিটি যদি হয়, তাহলে সেখানে আমলাদের অবস্থান কী হবে? তারা বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন, নাকি তাঁরাই নিজেরা সুপারিশ প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করবেন? এই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থা দেখা গেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন পূর্বেকার সরকার আমলে। বিশেষ করে তৎকালীন চেয়ারম্যানকে সরিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়ে গেলেন বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান। ফলে পদাবনতি হওয়া চেয়ারম্যানের সামনে তখন একটাই পথ। তা হচ্ছে নিজে থেকে সরে যাওয়া। তা-ই হয়তো তিনি আগের আমলে করেছিলেন।
কিন্তু ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতাস্তম্ভ প্রকল্পটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ম্যুরালের থিমই পরিবর্তন করে ফেলা হয়, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিকৃত রূপ। এখানে উল্লেখ করতে হবে, যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন পূর্বতন সরকার আমলে শতভাগ কাজ সম্পন্ন করা যেত, তাহলে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার স্বাধীনতাস্তম্ভ প্রকল্পকে এভাবে ক্ষত-বিক্ষত করতে পারত না।
তার পরও আমাদের সৌভাগ্য, বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলকে আবারও ক্ষমতায় বসিয়েছে। সংগত কারণেই প্রত্যাশা বেড়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ২০১১ সালে স্বাধীনতার মাসের প্রাক্কালেও সেই সামান্য বাকি থাকাটা কাজটিই সম্পন্ন হলো না। আর যদি প্রকল্পটি জনগণের জন্য খুলেও দেওয়া হয়, তাহলেও দেখা যাবে যে সেখানে জাদুঘরটি আলোর মুখ দেখছে না। কাজের ধীরগতি দেখে তা-ই মনে হয়। জাদুঘরের জন্য লোক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে প্রায় বছর দুই আগে। আজ অবধি সেখানে কোনো লোকই নিয়োগ করা হয়নি। ম্যুরালের কাজ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাকি কাজগুলোও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ কমিটি পদত্যাগ না করলেই বিতর্কহীনভাবে স্বাধীনতাস্তম্ভটি সাধারণ্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া যেত। এখনো হয়তো উন্মুক্ত হবে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী চক্র কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। তারা জোর গলায়ই বলতে পারবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এক নয়। এমনকি তারা যদি আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রকাশ্যে সাহস না পেলেও তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে পারে_দেখো, স্বাধীনতাস্তম্ভেও ঘুণপোকারা পেঁৗছে গেছে। ওরা কি আর আমাদের বিচার করতে পারবে?
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.