শিক্ষানীতি-প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ও কৌশল by ছিদ্দিকুর রহমান

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ থেকে বাড়িয়ে আট বছর করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যক্তির মৌলিক শিখন-চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা।


প্রয়োগ উপযোগী ও টেকসই সাক্ষরতা, জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জীবনদক্ষতা এবং মানবিক গুণাবলি অর্জন প্রাথমিক শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা উল্লিখিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য অনুপযোগী।
অনেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করে। তাদের জন্য এ শিক্ষা প্রান্তিক। আবার অনেকে এ শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শিক্ষায় যায়, তাদের জন্য এ শিক্ষা প্রস্তুতিমূলক। প্রাথমিক শিক্ষা শুধু শিক্ষার ভিত নয়, জীবনেরও ভিত। তাই একবিংশ শতাব্দীর জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে (শিখন: অভ্যন্তরীণ সম্পদ, ১৯৯৬ ইউনেসকো) প্রাথমিক শিক্ষাকে জীবনের ছাড়পত্র (পাসপোর্ট) হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা না পারছে কর্মজীবনের ভিত তৈরি করতে, না পারছে পরবর্তী স্তরের জন্য প্রস্তুত করতে। তাই একদিকে যেমন প্রয়োজন মেয়াদ বৃদ্ধি করা, অন্যদিকে প্রয়োজন শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও ফলপ্রসূ শিখন-শেখানো পদ্ধতির প্রয়োগ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেয়াদ বৃদ্ধির দুটি বিকল্প কৌশল নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
প্রথম কৌশলটি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন কক্ষ তৈরি, আসবাব সরবরাহ এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগ করে মেয়াদ বাড়ানো। এ প্রস্তাবের সবল দিক হলো একই কেন্দ্রে একই প্রশাসনের অধীনে প্রাথমিক পর্যায়ের সব ক্লাসের কার্যক্রম পরিচালনা। এ কৌশলের চ্যালেঞ্জ বহুবিধ। প্রথমত, বর্তমানে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার নিম্নমাধ্যমিক শাখায় কর্মরত ২ দশমিক ২ লাখ শিক্ষক বেকার হবেন। দ্বিতীয়ত, এ কৌশল অত্যন্ত ব্যয়বহুল—কমপক্ষে ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে চারটি করে নতুন শ্রেণীকক্ষ তৈরি ও আসবাবের জন্য প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছয়জন করে দুই লাখ ৪০ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। উল্লেখ্য, প্রতিটি বিদ্যালয়ে নতুন কক্ষ তৈরি পর্যায়ক্রমে করা বাস্তবসম্মত নয়, যেমন—একটি বিদ্যালয়ে একটি কক্ষ করার দু-তিন বছর পর আরেকটি এবং তার দু-তিন বছর পর আরও একটি কক্ষ তৈরি করা প্রক্রিয়াগত জটিলতা সৃষ্টি করবে এবং খরচ বাড়বে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছয়জন করে নতুন শিক্ষকও এক সঙ্গেই নিয়োগ দিতে হবে। কারণ, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক লাগবে। গণিতের শিক্ষক ইংরেজি বা বাংলা পড়াবেন না বা ধর্মের শিক্ষক শারীরিক শিক্ষা দেবেন না। বলে রাখা প্রয়োজন, বর্তমানে শিক্ষক ও শ্রেণীকক্ষের অভাবে ৯০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় দুই পালায় চলে অর্থাৎ দুটি শ্রেণী শুরু হয় সকালে এবং তিনটি দুপুরে। তৃতীয়ত, বর্তমানে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (প্রায় ৭৫ শতাংশ) গৃহ সম্প্রসারণের সুযোগ নেই। জায়গার অভাবে আনুভূমিক (ভূমিতে নতুন ভবন নির্মাণ) এবং গৃহের দুর্বল ভিতের কারণে উলম্ব সম্প্রসারণ (বহুতল ভবন নির্মাণ) কোনোটাই সম্ভব নয়। চতুর্থত, প্রথম কৌশলটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। কারণ, নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এবং নতুন কক্ষ তৈরি করে কিছুসংখ্যক বিদ্যালয়ে আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা এবং অন্যান্য বিদ্যালয়ে পাঁচ বছরের শিক্ষা চালু রাখা অর্থাৎ দ্বৈত ব্যবস্থা চালানো কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। পঞ্চমত, প্রথম কৌশল অবলম্বনে আট বছর মেয়াদি শিক্ষা চালু করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ২০১৮ সালের আগে সারা দেশে একসঙ্গে চালু করা সম্ভব হবে না।
মেয়াদ বৃদ্ধির বিকল্প কৌশলটি হলো নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে কর্মরত শিক্ষকেরা এবং ভৌতসুবিধাদি ব্যবহার করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে পৃথক উচ্চপ্রাথমিক শাখা চালু করা। এ কৌশলের দু-একটি চ্যালেঞ্জ থাকলেও সুবিধা অনেক। প্রথমত, কোনো শিক্ষক বেকার হবেন না। দ্বিতীয়ত, এখনই নতুন শ্রেণীকক্ষ ও আসবাব লাগবে না। ফলে এ কৌশলে অনেক কম ব্যয় হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত ৫১:১, পক্ষান্তরে এ অনুপাত নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ৩০:১। মাদ্রাসার নিম্নমাধ্যমিক স্তরে এ অনুপাত মাত্র ১৬:১। বর্তমানে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তরণের হার অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তির হার ৯৫ শতাংশ। এখন যারা তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তাদের উত্তরণের হার বৃদ্ধি পেয়ে শতভাগ হলেও আগামী তিন-চার বছরে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৪০ অতিক্রম করবে না। তৃতীয়ত, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে দীর্ঘ সময় লাগবে না। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে বর্তমান সরকারের আমলেই অর্থাৎ ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশব্যাপী আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা সম্ভব।
দ্বিতীয় কৌশল অর্থাৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উচ্চপ্রাথমিক উপস্তর চালু করার ক্ষেত্রে সুবিধা অনেক বেশি হলেও এর দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমটি হলো প্রাথমিক শিক্ষা (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী) এবং উচ্চপ্রাথমিক শিক্ষা (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী) ভিন্ন স্থানে পরিচালনা এবং দ্বিতীয়টি হলো বর্তমানে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসার নিম্নমাধ্যমিক শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের উচ্চপ্রাথমিকের শিক্ষকে পরিণত করা। এ ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এ সমস্যা সমাধানের উত্তম উপায় হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এক ঘোষণায় যা করে গেছেন, বর্তমান সরকার বাকিটুকু করলে শিক্ষকেরা তা সানন্দে মেনে নেবেন। তা করা হলে একদিকে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে, অন্যদিকে চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এর জন্য সরকারের খুব বেশি ব্যয় বাড়বে না। কারণ, বর্তমানে চাকরিরত সবাই এমপিওভুক্ত।
দ্বিতীয় কৌশল অবলম্বনে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশব্যাপী আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হলে অনতিবিলম্বে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো হচ্ছে: ১. আট বছর মেয়াদি বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন; ২. আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন; ৩. সব শিক্ষকের জন্য শিক্ষাক্রম বিতরণসহ শিখন-শেখানো কলাকৌশল সম্পর্কে ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং ৪. শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা পুনর্বিন্যাস করা।
বর্তমানে আলাদাভাবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কাজ চলছে। এ কাজ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধির পরিপন্থী এবং অদূর ভবিষ্যতে মেয়াদ বৃদ্ধি না করার ইঙ্গিতবাহী। কারণ, আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম হতে হবে একই কাঠামোর মধ্যে মৌলিক শিক্ষার চাহিদা পূরণের উপযোগী উদ্দেশ্যমুখী। অচিরে আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার পদক্ষেপ নেওয়া হলে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা ও নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষাক্রম উন্নয়নের আলাদাভাবে যে কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তা হবে নিষ্ফল প্রয়াস এবং বিরাট জাতীয় অপচয়।
শিক্ষার্থীদের জীবনের ভিত মজবুত করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান: অধ্যাপক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
semzs@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.