জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি-অসামান্য ফাদার ম্যারিনো by আরাফাত শাহরিয়ার
ফাদার রিগন এক প্রকাশককে অনেক বলে-কয়ে রাজি করালেন, তিনি ফাদারের অনূদিত গীতাঞ্জলি প্রকাশ করবেন। ইতালির এ প্রকাশক মারা গেলে একরকম বিপাকেই পড়লেন ফাদার। প্রকাশকের স্ত্রী কিছুতেই গীতাঞ্জলি প্রকাশ করতে রাজি নন। তাঁর ধারণা, বইটি বিক্রি হবে না।
ফাদার বললেন, 'আমি যাঁর লেখা অনুবাদ করেছি, তাঁর একটি লেখা শুনেই দেখুন না।' ফাদার পড়তে শুরু করলেন। প্রকাশকের স্ত্রী প্রথমটি শুনে আরেকটি লেখা পড়ে শোনানোর অনুরোধ করলেন। গীতাঞ্জলি শুনতে শুনতে প্রকাশকের স্ত্রীও রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়ে গেলেন।
১৯৬৪ সালে ইতালি ভাষায় ছাপার মুখ দেখে গীতাঞ্জলি। পরে গ্রন্থটির ছয়টি সংস্করণ বের হয়। এরপর একে একে নিজের অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ২৬টি গ্রন্থ প্রকাশ করেন ফাদার। শুধু রবিঠাকুর নয়, জসীমউদ্দীন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ গ্রন্থও প্রকাশ করেন তিনি। অনুবাদ করেন লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান। শুধু ইতালীয় ভাষায় নয়, ফরাসি, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়ও অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই।
১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে আসেন ফাদার ম্যারিনো রিগন। কর্মসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অবশেষে বসতি গাড়েন সুন্দরবনসংলগ্ন মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। আর দশজন মিশনারির মতো তিনি নিজেকে কেবল ধর্মীয় কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারতেন। তিনি তা করেননি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য আর সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে। যেখানে মানবতার প্রশ্ন, সেখানেও ছুটে গেছেন তিনি। তাই তো তিনি কোনো জাতি-ধর্ম-গোত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, সবার কাছে হয়ে উঠেছেন এক অনুকরণীয় আদর্শ।
১৯৯০ সালে ফাদার স্বজনদের সহযোগিতায় ইতালিতে প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র। রবীন্দ্রচর্চা ও প্রচারে এ সংগঠনটির ভূমিকা অনন্য। সংগঠনটির তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের নামে ইতালিতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে রবীন্দ্র সরণি। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে সেখানে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদ্যাপন করা হয় রবীন্দ্র উৎসব। বাংলাদেশের নকশিকাঁথাও ফাদার রিগন পেঁৗছে দিয়েছেন ইতালির বিভিন্ন শহরে। শিক্ষার প্রসারেও নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন রিগন। তাঁর হাত ধরেই ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মংলার স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়। এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্পন্সরশিপের মাধ্যমে দেশের হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশুর পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি, এমনকি অনেক বাংলাদেশিও যখন দেশ ছাড়ছে, সেই ভয়াবহ সময়ের পুরোটাই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন এ দেশে। যুদ্ধপীড়িতদের আশ্রয়ও দিয়েছিলেন তিনি, হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবায়। এ দেশটাকে কতটা ভালোবাসতেন তিনি, তার কিছুটা প্রকাশ পাওয়া যায় এ দেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণের মধ্য দিয়ে। ২০০১ সালে তাঁর হৃদযন্ত্রে অসুস্থতা ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি প্রথমে কিছুতেই সম্মত হননি। স্বজনদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি এই শর্তে রাজি হন, ইতালিতে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তাহলে মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। ফাদার রিগন তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। এ দেশের জন্য তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এ দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যে আসনে বসেছেন তিনি, এটাই হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে জন্মেছিলেন এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। জন্মদিনে এই অসামান্য ব্যক্তিত্বের জন্য একরাশ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আরাফাত শাহরিয়ার
১৯৬৪ সালে ইতালি ভাষায় ছাপার মুখ দেখে গীতাঞ্জলি। পরে গ্রন্থটির ছয়টি সংস্করণ বের হয়। এরপর একে একে নিজের অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ২৬টি গ্রন্থ প্রকাশ করেন ফাদার। শুধু রবিঠাকুর নয়, জসীমউদ্দীন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ গ্রন্থও প্রকাশ করেন তিনি। অনুবাদ করেন লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান। শুধু ইতালীয় ভাষায় নয়, ফরাসি, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়ও অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই।
১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে আসেন ফাদার ম্যারিনো রিগন। কর্মসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অবশেষে বসতি গাড়েন সুন্দরবনসংলগ্ন মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। আর দশজন মিশনারির মতো তিনি নিজেকে কেবল ধর্মীয় কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারতেন। তিনি তা করেননি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য আর সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে। যেখানে মানবতার প্রশ্ন, সেখানেও ছুটে গেছেন তিনি। তাই তো তিনি কোনো জাতি-ধর্ম-গোত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, সবার কাছে হয়ে উঠেছেন এক অনুকরণীয় আদর্শ।
১৯৯০ সালে ফাদার স্বজনদের সহযোগিতায় ইতালিতে প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র। রবীন্দ্রচর্চা ও প্রচারে এ সংগঠনটির ভূমিকা অনন্য। সংগঠনটির তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের নামে ইতালিতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে রবীন্দ্র সরণি। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে সেখানে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদ্যাপন করা হয় রবীন্দ্র উৎসব। বাংলাদেশের নকশিকাঁথাও ফাদার রিগন পেঁৗছে দিয়েছেন ইতালির বিভিন্ন শহরে। শিক্ষার প্রসারেও নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন রিগন। তাঁর হাত ধরেই ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মংলার স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়। এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্পন্সরশিপের মাধ্যমে দেশের হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশুর পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি, এমনকি অনেক বাংলাদেশিও যখন দেশ ছাড়ছে, সেই ভয়াবহ সময়ের পুরোটাই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন এ দেশে। যুদ্ধপীড়িতদের আশ্রয়ও দিয়েছিলেন তিনি, হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবায়। এ দেশটাকে কতটা ভালোবাসতেন তিনি, তার কিছুটা প্রকাশ পাওয়া যায় এ দেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণের মধ্য দিয়ে। ২০০১ সালে তাঁর হৃদযন্ত্রে অসুস্থতা ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি প্রথমে কিছুতেই সম্মত হননি। স্বজনদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি এই শর্তে রাজি হন, ইতালিতে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তাহলে মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। ফাদার রিগন তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। এ দেশের জন্য তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এ দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যে আসনে বসেছেন তিনি, এটাই হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে জন্মেছিলেন এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। জন্মদিনে এই অসামান্য ব্যক্তিত্বের জন্য একরাশ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আরাফাত শাহরিয়ার
No comments