বাড়ি-রাজনীতি-বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প by ফারুক ওয়াসিফ

সেনানিবাসের ছত্রচ্ছায়ার ‘জলপাই’ খালেদা জিয়া আর বেসামরিক পরিবেশের ‘সাধারণ’ খালেদা জিয়ার মধ্যে পার্থক্যটা কেবল বাড়ির নয়, দুটি যুগেরও। মুহূর্তটা মৌলিক, যার আগের ও পরের মধ্যে জলবিভাজিকা নয়, পাথুরে দেয়াল। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে সম্ভবত এমন কান্নাও এই প্রথম।


আগের কান্নাগুলো ছিল স্বামী হারানোর শোকের, সন্তানদের রক্ষা করতে না পারার কষ্টের। কিন্তু অপমান, লাঞ্ছনা আর অক্ষমতার এমন তিক্ত স্বাদ আগে কখনো কি তিনি পেয়েছেন? এই প্রথম তিনি টের পেলেন, জনগণের ঊর্ধ্বে অন্য কারও আশ্রয় তাঁর আর নেই!
কান্নারতা তাঁকে দুঃখিনী রানির মতোই লাগছিল। রানিই ছিলেন, কখনো সুয়ো কখনো দুয়ো। দুয়োরানির বেশেই ‘বনবাস’ নিতেও হলো। রূপকথা বলে, ‘ষড়যন্ত্র’ ঘুচিয়ে জয়ের ধ্বজা ধরে আবার তিনি গদিনশিন হবেন। কিন্তু মঞ্চ বদলে যাচ্ছে, ঘটনা অনেক দ্রুত ঘটছে। নির্বাচনেরও অনেক দেরি। আপাতত উচ্ছেদ, হরতাল আর চরিত্র হননের ঝড়ে রাজনীতি আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল। জনগণ দেখল, এই ঈদে সরকার ও বিরোধী দল নিবেদিত জাতীয় উপহার হলো একটি হরতাল ও একটি অনন্য কান্না। মাঝখানে কোরবানি হয়ে গেল দুয়োরানির ‘প্রিয় বাড়ি’ এবং অনেকের বাড়ি ফেরা। সুয়োরানি কি তাতে সুখী হলেন?

বন্দিত কান্না বনাম নিন্দিত হরতাল
গত হরতাল হয়তো নিন্দিত। কিন্তু আগামীকালই অনেকের মনে ভাসতে থাকবে ঘরছাড়া খালেদার মুখচ্ছবি, তাঁর অশ্রুবিধৌত কান্না। সেই কান্না বাঙালির ‘কোমল’ মনের বন্দনাও পাবে। ভোটাশ্রয়ী আমজনতার মনও হয়তো গলবে। তাঁরা অতীতের দুঃশাসনের স্মৃতির সিন্দুকে ঢাকনা চাপিয়ে এই সরকারের ‘দুঃশাসনের’ গেরো খুলতে চাইবেন। হরতালের নিন্দা গতিমুখ বদলে হয়ে যাবে সরকারের নিন্দা।
তার পরও কান্নারতা খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি রাষ্ট্রনায়কসুলভ নয়। ক্ষমতাবান সাবেক শাসক কিংবা প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর এমন কান্না মানায় না। হয়তো এই কান্না তিনি ঠেকাতে পারেননি। যেমন—যে অপমান তিনি সয়েছেন, তাও ছিল তাঁর কল্পনাতীত। এসবের পর তাঁকে অনেকে দেখবেন এক নির্যাতিত বিধবা হিসেবে। এভাবে আবার তিনি ফিরে গেলেন সেই দুঃখিনী নারীর ভাবমূর্তিতে, যে ভাবমূর্তি ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুর পুঁজি। ‘উচ্ছেদ-পরবর্তী’ ঐতিহাসিক কান্নার ওই মুখচ্ছবি আপসহীন খালেদার ভাবমূর্তিকে ছাপিয়ে যাবে। কিন্তু এই অশ্রু যতই মানবিক হোক, তার ব্যবহারটা পুরোপুরিই রাজনৈতিক। আইন ও রাজনীতি বর্তমানে অনুকূলে নয় বলে কান্না দিয়েই তাঁকে শুরু করতে হলো তাঁর নতুন যাত্রা। সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণায় বোধহয় তারই ইঙ্গিত।
অনেকেই আবার ঘটনার নাটকীয়তা ও অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদে গলবেন না। তাঁদের মনে পড়ে যাবে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাঁর দলের ‘সোনার ছেলেদের’ অনাচারের কথা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথাও মনে পড়বে, কীভাবে কানসাটে অনেক নারীকে বিধবা ও সন্তানহারা করা হয়েছিল, কীভাবে ফুলবাড়ীর কৃষকদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের জন্য তিন মায়ের বুক খালি করা হয়েছিল। মানুষের ভিটেমাটি রক্ষার প্রশ্নে তাঁর সরকারের রেকর্ডও অন্য সব সরকারের মতোই দুর্বল। তাহলে সাধারণ মানুষের কান্না থেকে ‘অসাধারণের’ কান্না কোন বিচারে বেশি করুণ, বেশি মর্মস্পর্শী, বেশি দামি? কারও অশ্রু মিঠা আর কারও অশ্রু কি তিতা?
কিন্তু অন্য এক বিচারে এই কান্না ও এই লাঞ্ছনার অভিযোগ অকাট্য, গুরুত্বও বিপুল। বিরোধীদলীয় নেত্রীই হোন বা তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রীই হোন, তাঁকেও বাংলাদেশের যেকোনো নারীর মতোই কুৎসা ও ‘কলঙ্কের’ পুরুষালি অস্ত্রে ঘায়েল হতে হলো? বাকিদের তাহলে কী অবস্থা?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাক্যবাণ
কথায় ও ইঙ্গিতে যে আক্রমণগুলো কেবল নারীদেরই করা হয়, করা হয় তাদের সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য, বেগম জিয়া তারও শিকার হলেন। গৃহ ছাড়ার সময়ে ‘লাঞ্ছিত’ হওয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি স্বয়ং। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রমুখ অকাতরে হীন রুচির ভাষা ও ভঙ্গি ব্যবহার করে চলেছেন। তাঁরা দুজনই বাড়িছাড়া খালেদা জিয়ার কান্না, পোশাক, সাজ ইত্যাদি নিয়ে যে রকম কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করেছেন, তা ব্যক্তির সম্মানের চরম অবমাননা। এখানেই শেষ হলে লজ্জা কিছুটা কমত। তার পরও বিটিভিসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত কক্ষ, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী বলে অনেক কিছু আপত্তিকরভাবে দেখানো হলো। প্রতিহিংসায় কি এতটাই অন্ধ হতে হয়? খালেদা জিয়া বলে নয়, কোনো নাগরিকের প্রতিই সরকারযন্ত্র এমন আচরণ করতে পারে না। গণমাধ্যমও পারে না ক্যামেরা বা কলমকে চরিত্র হননের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হতে দিতে। যাঁরা বিরোধী দলীয় নেত্রীকে অসম্মানিত করে; তাদের হাতে সাধারণ কোনো নারীর সম্মান কীভাবে নিরাপদ থাকবে? এত পুরুষালিপনা যদি ওপর মহলে থাকে, তাহলে নারী নির্যাতন দমনে অঢেল আইন করে কী লাভ?

কে কী হারালেন?
ক্ষমতাবানেরা কেন জেনেশুনে ভুল করেন? কারণ, বুদ্ধির কাজটা তাঁরা দাপট দিয়ে করতে চান। তাঁদের নীতি হলো ‘পারলে ঠেকাও’। আগের আওয়ামী সরকার শেখ রেহানাকে ধানমন্ডির একটি বাড়ি দিয়েছিল। পরে বিএনপি সরকার সেই বরাদ্দ বাতিল করে। বাড়ি দেওয়া সঠিক ছিল না, ফিরিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায় ছিল আরও বেঠিক। অচিরেই সেই বাড়িতে থানা বসল এবং সেই মামুলি থানা উদ্বোধন করতে এলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বয়ং। প্রতিহিংসার ইতিহাস এভাবে কেবলই ফিরে ফিরে আসে। সুশাসন আসেও না, ছিলও না। তা আমাদের কেবল স্বপ্নেই কামনা করতে হয়। বাস্তব এমনই দুঃস্বপ্নময়।
প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার মর্যাদা ও গুরুত্ব বোধ হয় সরকারদলীয় আগে সাংসদ আসলামুল হকের দখল থেকে ঢাকার একটি খাল উদ্ধার করতে গেলে ম্যাজিস্ট্রেটরা অপদস্থ হন, পুলিশ ফিরে যায়, ওয়াসা-রাজউক পড়িমরি করে পালিয়ে আসে। উচ্ছেদ অভিযান পেছায় অথচ খালেদার অনুরোধে বাড়িবদল পেছানো হয় না। ঢাকার আরেক সাংসদ কামাল মজুমদার অন্যের সম্পত্তি দখলে রেখেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ রকম অজস্র দখলের ঘটনায় সরকার নির্বিকার। অথচ খালেদা জিয়ার ব্যাপারে তারা এত নাছোড়বান্দা কেন? সন্দেহ হয়, অবৈধ দখল উচ্ছেদ হয়তো সরকারের মূল মোটিফ না। সেনানিবাসের বাড়িটিও তাহলে সাধারণ বাড়ি নয়? অন্য বাড়ি তো বিরোধী নেত্রীর রয়েছেই। এই কান্না আর এই হরতাল তাহলে ‘অন্য কোনো কিছু’ হারানোর শোক? খালেদা জিয়া তবে কী হারালেন আর শেখ হাসিনা কী পেলেন, সেটাই এই মুহূর্তের বড় প্রশ্ন।

রানি নন, জনপ্রতিনিধি
মানীর মান রক্ষার দায়িত্ব জনতার নয়, সরকারের, আদালতের এবং ব্যক্তির নিজেরও। তিন-তিনবারের জন্য যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি বিতর্কের প্রথম প্রহরেই ঘোষণা করতে পারতেন, ‘বিতর্কিত সুবিধা আমি নেব না। বাড়ির দখল রাখতে রাজপথের দখলও বিএনপি নেবে না। আমি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আইন মান্য করলাম, এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সব ক্ষেত্রেই আইনের শাসন কায়েম করা। দলীয় দখলদারিরও অবসান ঘটানো।’ এটা না করে তিনি তাঁর এবং তাঁর দলের সমর্থক-ভোটারদেরই অসম্মানিত করলেন। বাড়ির বোঝা কেন তারা বহন করবে? অন্যদিকে অভব্যতা করে সরকারও তাঁর অজস্র সমর্থকদের মনে আঘাত দিল। দুই দলের নেত্রী যদি জনগণের দৈনন্দিন পেরেশানির কথা ভাবতেন, ভাবতেন জিনিসপত্রের দামের কথা, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির অভাবের কথা, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থে একযোগে কাজ করার কথা, তাহলে বাড়ি-বিবাদের হরতালও হতো না, বাড়িছাড়া করার দক্ষযজ্ঞও ঘটত না। বাড়ি নিয়ে উভয় পক্ষের ব্যতিব্যস্ততা আর কিছু নয়, সত্যিকার জাতীয় সমস্যাগুলো চোখের আড়ালে রাখার কৌশল। বাড়িপ্রেম জনপ্রেমের থেকে বেশি হলে রাজনীতি কয়েকটি ভবনের মধ্যেই ঘুরপাক খাবে। সেনা ছত্রচ্ছায়া বড় না জনগণের ভালোবাসা বড়, সেই প্রশ্ন আজ তাই বিএনপির সামনে। একই প্রশ্ন সরকারের প্রতিও। দুই বছর পার হচ্ছে। আগডুম-বাগডুম বহু কিছু হলেও দিন যেমন ছিল তেমনই আছে। দিনবদল তো আর বাড়িবদল করে হওয়ার নয়। রাজনীতিতে সমস্যা থাকলে বাড়ি নয়, বদনা নিয়েও সমস্যা হতে পারে। খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা কেউই রানি নন, জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া অন্য কোনো মহিমা তাঁরা দাবি করতে পারেন না, রক্ষাও করতে পারেন না।

বাড়িহারাদের বাড়ি ফেরা
হরতালের রাত। আগের দিনও ট্রাকে ট্রাকে গরু ঢুকছিল শহরে। ঢাকাবাসীর কোরবানির খোরাক। হরতালের রাতে সেসব গরুর ট্রাক বদলে হয়ে গেল গণপরিবহন। ওজন সেই পাঁচ টন। সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ডানে-বাঁয়ে ফুটপাতজুড়ে অজস্র মানুষ গিজগিজ করছে। গরুর ট্রাক আসে, আর দরদাম করে তাদের তুলে নিয়ে যায়। মানুষগুলোও কি অন্য কোনো হাটে বিক্রি হবে? ভাড়া ঠিক হচ্ছে লাঠির দমাদম বাড়িতে। এই লাঠি মহান। কোরবানির গরু আর বাড়ি-ফেরতা মানুষ উভয়ই তার শাসনের বশ। আবার দিনের বেলায় এই লাঠিই পিকেটারের হাতে ভেলকি দেখিয়েছে, পুলিশের হাতে ক্ষমতাবান হয়েছে। লাঠি তুমি আসলে কার? বাড়ি তুমি আসলে কার? যারা মার খাচ্ছে, তারা এই দুই তরফের লাঠিরই শিকার।
ট্রাকগুলো নিয়ে এসেছিল গরু আর ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। গরুর গোবর আর খড়ের গন্ধে মাখামাখি হয়ে তারা ফিরছে দূর-দূরান্তের পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটে তাদের ফেলে আসা ‘বাড়ির’ দিকে। যাবেই তারা, কোরবানির পশুর মতো দশায় হলেও আপত্তি নেই। তাদের ক্ষমতা তো ভোটের দিন, বাকি সব দিন তারা ‘অক্ষম’ জীবন্ত শ্রম মাত্র। যাদের বাড়ি-গাড়ি-সম্মানের বালাই নেই।
ভূমিহীন এসব মানুষের বাড়িহীন গ্রামে ফেরার আকুলতা আর বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়ি হারানোর ব্যাকুলতার মধ্যে কত যোজন যোজন পার্থক্য! যেসব মানুষের মূল্য কোরবানির গরুর চেয়েও অনেক কম, সরকারপ্রধানের ‘ভালো কথায়’ তাদের দাম বাড়বে না! হরতালের ভোগান্তি সয়েও, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ জয়গান না শুনেও এরা বেঁচে থাকবে। ঈদে-চাঁদে বাড়ি ফেরার জন্য আনচান করবে। রানির অশ্রু আর রাজকন্যাদের হুংকারের বাইরেও যে বাংলাদেশ বিরাজ করে, সেই বাংলাদেশে এদের বসবাস। সেই বাংলাদেশ রাজনীতির রাজকীয় রঙ্গকাহিনি থেকে অনেক দূরে বিরাজ করে। সেখানেও মানুষ বাড়িছাড়া হয় এবং কাঁদে; কিন্তু তাদের বিপর্যয়ে কোনো হরতাল কেউ ডাকে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.