চিন্তা ও তৎপরতায় আমাদের ভরসা by ম. ইনামুল হক
আমি যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের গুণমুগ্ধ, তার অনেক কারণ আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জীবনের বেশিরভাগ সময় তাকে দূর থেকেই দেখে এসেছি। আমার শিক্ষাজীবন ও সরকারি চাকরির ধরনের কারণে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠতা বহু দিন হয়নি। দৈনিক সংবাদে 'সময় বহিয়া যায়' কলামের নিয়মিত পাঠক ছিলাম।
আমরা জানতাম যে, 'গাছপাথর' নামের আড়ালে আসলে রয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিতেন। আমি শ্রোতা হিসেবে সেখানে উপস্থিত থেকেছি। তার বক্তব্য আমার মনে ধরত। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিতর্ক প্রতিযোগিতার সভাপতি হিসেবেও তাকে দেখতাম। তিনি যেভাবে যুক্তিতর্কের বিচার করতেন; সেটা আমার মনে দাগ কাটত সবচেয়ে বেশি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে দূরের; কিন্তু চিন্তা ও চেতনায় আমার সবচেয়ে কাছের মানুষদের একজন।
স্যারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠতার সুযোগ আসে ২০০০ সালের দিকে। ওই সময় তার কাছে গিয়েছিলাম আমার লেখা 'বৃহত্তর বাংলার ইতিহাস পরিচয়' গ্রন্থটির একটি সৌজন্য কপি দিতে। সেদিন খুব বেশি আলাপ হয়নি। তবে একদিন পরই তিনি ফোন দিলেন। প্রশংসা করে বললেন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই তার হাতে আমি তুলে দিয়েছি। এটা বেশ কাজে লাগবে। সত্যি বলতে কি, তার মতো ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি আমার জন্য ছিল উৎসাহের রসদ। তারপর বললেন, পরদিন তার বাসায় যেতে পারি কি-না। বলাবাহুল্য, আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম।
পরদিন গিয়ে দেখি, সেখানে আরও আট-দশ জন উপস্থিত। অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের মধ্যে ড. আকমল হোসেন, ড. আহমেদ কামাল, অধ্যাপক জাহেদা আহমদ, পারভীন হাসান, জোনায়েদ সাকী প্রমুখের কথা মনে পড়ছে এখন। সবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, আমরা কয়েকজন সমমনা মানুষ মিলে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন গড়তে চাইছি। এই সংগঠন সমাজের বিভিন্ন রূপান্তর অধ্যয়ন করবে, গবেষণা চালাবে এবং সেসব বিষয়ে প্রকাশনা থাকবে। একটি পত্রিকাও আমরা প্রকাশ করতে চাই। আপনি থাকবেন? আমি খুশিই হয়েছিলাম। আর কয়েক বছর পর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিতে যাচ্ছি। সেই সময়ে এমন একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আমার কাছে নিজের চিন্তা ও চেতনা বাস্তবায়নের সুযোগ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল। 'সমাজ রূপায়ণ অধ্যয়ন কেন্দ্র' গঠিত হয়েছিল। স্যার এর সভাপতি। কয়েক মাসের মধ্যে প্রকাশ হয়েছিল নতুন দিগন্ত।
নতুন দিগন্ত এখনও নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তাও। দৈনিক পত্রিকা ও সেগুলোর নানা ক্রোড়পত্রের দাপটের এই যুগে এ ধরনের একটি পত্রিকার প্রকাশনা নিয়মিত রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। স্যারের দক্ষ সম্পাদনা সেটাকে সম্ভব করে তুলেছে। এও অস্বীকার করা যাবে না_ পত্রিকাটির প্রতি সচেতন পাঠকের আগ্রহের কারণ কেবল এর আধেয় নয়; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
স্যার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে যেভাবে বিশ্লেষণ হাজির করেন, যেভাবে রাজনীতি ব্যাখ্যা করেন, তা আমি সবসময়ই অনুসরণের চেষ্টা করেছি। রাজনীতির ব্যাপারেও কিন্তু স্যার চমৎকার বিশ্লেষক। খুবই ভালো বোঝেন। কিন্তু খুব সচেতনভাবেই তিনি দলীয় রাজনীতির স্পর্শ এড়িয়ে চলেছেন। আমি দেখেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মওলানা আবদুুল হামিদ খান ভাসানীর ব্যাপারে তার অনেক উঁচু ধারণা। রাজনৈতিক মত না মিললেও জাতীয় নেতৃবৃন্দকে কীভাবে শ্রদ্ধা করা যায়, সেটা আমি স্যারের কাছেই শিখেছি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেননি সত্য, কিন্তু যখনই নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন এসেছে, তিনি মাঠে নেমেছেন। ওসমানী উদ্যানের গাছ রক্ষার আন্দোলনে তাকে দেখা গেছে সবার সামনে। তখন আমি দূর থেকে দেখেছি। কিন্তু কাছ থেকে দেখেছি দুটি বড় নাগরিক আন্দোলনে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ প্রদর্শনের নামে পাচারের বিরুদ্ধে। আরেকটি ছিল মুন্সীগঞ্জের আড়িয়ল বিল রক্ষা আন্দোলন। তিনটি আন্দোলনই সাফল্য পেয়েছিল।
বস্তুত সমাজ ও স্যারের চিন্তা-ভাবনা, প্রজ্ঞা, দক্ষতার ব্যাপারে আগেই জানতাম। শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বশীলতার কথা তার শিক্ষার্থীদের কাছে শুনেছি। কাছ থেকে মিশে দেখেছি তিনি একজন চমৎকার পিতা। তিনি যেভাবে পরিবারকে আগলে রেখেছেন, তা দেখে চমৎকৃত হয়েছি। এখানেও আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে।
স্যারের জন্ম দিনে কিছু লেখার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, তিনি এখনও আমাদের সঙ্গে আছেন। আছেন চিন্তা ও তৎপরতায় আমাদের ভরসা হয়ে। তিনি বটবৃক্ষের মতো আমাদের ছায়া দিয়ে চলেছেন। এই ছায়া আমাদের প্রতিদিনের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক লড়াইয়ের ক্লান্তি দূর করে; নতুন করে লড়াইয়ের শক্তি জোগায়।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক
বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক
স্যারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠতার সুযোগ আসে ২০০০ সালের দিকে। ওই সময় তার কাছে গিয়েছিলাম আমার লেখা 'বৃহত্তর বাংলার ইতিহাস পরিচয়' গ্রন্থটির একটি সৌজন্য কপি দিতে। সেদিন খুব বেশি আলাপ হয়নি। তবে একদিন পরই তিনি ফোন দিলেন। প্রশংসা করে বললেন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই তার হাতে আমি তুলে দিয়েছি। এটা বেশ কাজে লাগবে। সত্যি বলতে কি, তার মতো ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি আমার জন্য ছিল উৎসাহের রসদ। তারপর বললেন, পরদিন তার বাসায় যেতে পারি কি-না। বলাবাহুল্য, আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম।
পরদিন গিয়ে দেখি, সেখানে আরও আট-দশ জন উপস্থিত। অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের মধ্যে ড. আকমল হোসেন, ড. আহমেদ কামাল, অধ্যাপক জাহেদা আহমদ, পারভীন হাসান, জোনায়েদ সাকী প্রমুখের কথা মনে পড়ছে এখন। সবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, আমরা কয়েকজন সমমনা মানুষ মিলে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন গড়তে চাইছি। এই সংগঠন সমাজের বিভিন্ন রূপান্তর অধ্যয়ন করবে, গবেষণা চালাবে এবং সেসব বিষয়ে প্রকাশনা থাকবে। একটি পত্রিকাও আমরা প্রকাশ করতে চাই। আপনি থাকবেন? আমি খুশিই হয়েছিলাম। আর কয়েক বছর পর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিতে যাচ্ছি। সেই সময়ে এমন একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আমার কাছে নিজের চিন্তা ও চেতনা বাস্তবায়নের সুযোগ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল। 'সমাজ রূপায়ণ অধ্যয়ন কেন্দ্র' গঠিত হয়েছিল। স্যার এর সভাপতি। কয়েক মাসের মধ্যে প্রকাশ হয়েছিল নতুন দিগন্ত।
নতুন দিগন্ত এখনও নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তাও। দৈনিক পত্রিকা ও সেগুলোর নানা ক্রোড়পত্রের দাপটের এই যুগে এ ধরনের একটি পত্রিকার প্রকাশনা নিয়মিত রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। স্যারের দক্ষ সম্পাদনা সেটাকে সম্ভব করে তুলেছে। এও অস্বীকার করা যাবে না_ পত্রিকাটির প্রতি সচেতন পাঠকের আগ্রহের কারণ কেবল এর আধেয় নয়; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
স্যার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে যেভাবে বিশ্লেষণ হাজির করেন, যেভাবে রাজনীতি ব্যাখ্যা করেন, তা আমি সবসময়ই অনুসরণের চেষ্টা করেছি। রাজনীতির ব্যাপারেও কিন্তু স্যার চমৎকার বিশ্লেষক। খুবই ভালো বোঝেন। কিন্তু খুব সচেতনভাবেই তিনি দলীয় রাজনীতির স্পর্শ এড়িয়ে চলেছেন। আমি দেখেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মওলানা আবদুুল হামিদ খান ভাসানীর ব্যাপারে তার অনেক উঁচু ধারণা। রাজনৈতিক মত না মিললেও জাতীয় নেতৃবৃন্দকে কীভাবে শ্রদ্ধা করা যায়, সেটা আমি স্যারের কাছেই শিখেছি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেননি সত্য, কিন্তু যখনই নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন এসেছে, তিনি মাঠে নেমেছেন। ওসমানী উদ্যানের গাছ রক্ষার আন্দোলনে তাকে দেখা গেছে সবার সামনে। তখন আমি দূর থেকে দেখেছি। কিন্তু কাছ থেকে দেখেছি দুটি বড় নাগরিক আন্দোলনে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ প্রদর্শনের নামে পাচারের বিরুদ্ধে। আরেকটি ছিল মুন্সীগঞ্জের আড়িয়ল বিল রক্ষা আন্দোলন। তিনটি আন্দোলনই সাফল্য পেয়েছিল।
বস্তুত সমাজ ও স্যারের চিন্তা-ভাবনা, প্রজ্ঞা, দক্ষতার ব্যাপারে আগেই জানতাম। শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বশীলতার কথা তার শিক্ষার্থীদের কাছে শুনেছি। কাছ থেকে মিশে দেখেছি তিনি একজন চমৎকার পিতা। তিনি যেভাবে পরিবারকে আগলে রেখেছেন, তা দেখে চমৎকৃত হয়েছি। এখানেও আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে।
স্যারের জন্ম দিনে কিছু লেখার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, তিনি এখনও আমাদের সঙ্গে আছেন। আছেন চিন্তা ও তৎপরতায় আমাদের ভরসা হয়ে। তিনি বটবৃক্ষের মতো আমাদের ছায়া দিয়ে চলেছেন। এই ছায়া আমাদের প্রতিদিনের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক লড়াইয়ের ক্লান্তি দূর করে; নতুন করে লড়াইয়ের শক্তি জোগায়।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক
বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক
No comments