দাহকালের কথা-বেহুলা by মাহমুদুজ্জামান বাবু

চাঁদ সওদাগরের ছেলে লখিন্দর বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতেই সর্পদংশনে মারা গিয়েছিলেন লোহার বাসরঘরে। তাঁকে ছোবল দিয়েছিল সুতানলি সাপ। নিয়তি নির্দিষ্ট ছিল যে স্ত্রী বেহুলাকে নিয়ে লখিন্দরের বাসর সম্পন্ন হবে না। নিয়তিকে পরাস্ত করা যায় কি না, এই ভেবে বাসরঘর বানানো হয়েছিল ধাতব বেষ্টনীর।


কিন্তু সেই ঘরেও কোথাও না-কোথাও ছিদ্র ছিল সূক্ষ্ম। চিকন একটি সাপ—যার নাম সুতানলি—সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ঢুকেছিল বাসরঘরে। লখিন্দরকে ছোবল দিয়ে মেরে ফেললে বেহুলা বিধবা হলেন, তারপর মৃত স্বামীকে নিয়ে কলাগাছের ভেলায় ভাসান দিলেন বেহুলা, দেবধামে যাবেন বেহুলা, দেবতাদের প্রশ্ন করবেন, তাঁদের অপরাধটা কোথায়! বিশেষ করে বেহুলার অন্যায় কী? যেতে যেতে রোদ-বৃষ্টিতে লখিন্দরের মৃত শরীর পচতে থাকল, কাক-শকুন উড়তে থাকল শবদেহ ঘিরে। মনসা দেবীর তবু মন টলল না। বণিকীপুঁজির মালিক চাঁদ সওদাগরের উন্মেষ মনসার জন্য কণ্টকজ্বালা, একচ্ছত্র আধিপত্যে মনসার রাজ্যে চাঁদ সওদাগর হুমকি। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বীর ন্যূনতম শান্তিও প্রতিহিংসার দাউ দাউ আগুন জ্বালায় ভেতরে। লখিন্দর ও বেহুলা কেবল ধারাবাহিক সেই প্রতিহিংসার পরিণতি।
গল্পের সেই প্রতিহিংসার আঁচ ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠস্বর ও গায়কিতে ছিল না। আশির দশকের শুরুতে আসামের শিল্পী ভূপেন হাজারিকার বাংলা ভাষায় গীত একটি অডিও ক্যাসেট বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। আমি এক যাযাবর শিরোনামের ওই ক্যাসেটে ‘বেহুলা’ নামের গানটিতে কথায়, সুরে ও যন্ত্রানুষঙ্গে বেদনা ও আহাজারির ছড়াছড়ি ছিল। বেহুলা-লখিন্দরের করুণ কাহিনি রূপক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল স্বদেশের অবয়বে। বন্যা, খরা, মড়কে বিপর্যস্ত বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে হাজার লখিন্দরের শবদেহ আগলে বসে থাকা বেহুলা ওই গানে হয়ে উঠেছিল বিপন্ন স্বদেশ। গীতিকবিতার ছত্রে ছত্রে ‘বাংলা’ হয়ে উঠেছিল ‘বেহুলা বাংলা আমার শ্যামলী বাংলা’...। প্রতিদ্বন্দ্বী সেখানে রুদ্র প্রকৃতি, যা কখনো কখনো মানুষের নিয়ন্ত্রণের অতীত, আচমকা ছোবল দিয়ে বিষ ঢাললে পুড়ে যেতে পারে ফসলের মাঠ, উগরে দিলে ভাসতে পারে প্লাবন, শ্বাসরোধী বিষাক্ত বাতাসে নীল হয়ে যেতে পারে জনপদ। তারপর আবার বুক বাঁধে সম্মিলিত বোধ; উঠে দাঁড়ায়, ঘুরে দাঁড়ায়, সবল বাহুতে নাচে প্রত্যয়, কলাকৌশলে নেচে ওঠে আঙুল, জয়ডঙ্কা বাজে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে, ‘মানুষ’ শব্দটি বাঙ্ময় হয়, পৃথিবী অবাক তাকায়—‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
এই বাংলায় বহুবার হয়েছে তেমন। ইতিহাসে সেসব গল্প সোনার কলমে লিখেছেনও কেউ কেউ। প্রাকৃতিক প্রকৃতি আর মানুষের হিংস্র প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই জনপদের মানুষের যুগপৎ লড়াই ও সচেতন প্রতিরোধের ইতিহাস বারবার আলোকিত দিনের দিকে ডাকে। ডাকে বলেই আমরা হাঁটি ক্লান্তিহীন, স্বপ্ন দেখি। আমাদের স্বপ্নালু চোখে নোনা জল ঠাঁই পায় না, আমরা নিজেদের উজাড় করতে চাই সমষ্টির স্বার্থে, উদার হতে চাই সব সংকীর্ণতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ভালোবাসাহীনতার কালে ভালোবেসে কত শত জয়গান গেয়ে ওঠে আমাদের মন...আর তখনই আমরা মা বলে ডেকে উঠি স্বদেশকে, মায়ের মুখ মলিন হলে আমাদের নয়ন জলে ভাসে, রবীন্দ্রনাথের ভেসেছিল, অনেকখানি পথ হেঁটে রবীন্দ্রনাথ তাই আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালি ও মানুষের মধ্যে বেশ খানিকটা দূরত্ব আছে, মুগ্ধ জননী বাংলাকে তাই তিনি বলেওছিলেন...‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালী করে—মানুষ করনি।’
মনসা তাঁর পূজা পাননি বলে, মানে বশ্যতা অস্বীকার করেছিলেন বলে চাঁদ সওদাগরকে পুত্রহারা করেছিলেন। লখিন্দর ও বেহুলা প্রতিহিংসার নিরূপায় শিকার। মনসার মন সাপের মন, সাপ তো মানুষ নয়, মানুষের মতো তার মগজ নেই, মগজের নিউরনে বিচার-বিবেচনা নেই। একুশ শতকের বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রমাণ করছে যে প্রাণিজগতে মানুষের মস্তিষ্কই সবচেয়ে উন্নত, অন্য কোনো প্রাণীর মানুষের মতো সচেতন ক্রিয়া করার মতো মাথা নেই, যা কিছু করে তা সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। এখানেই নাকি মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর বিভাজন রেখা। সচেতন ক্রিয়ায় নেমে মানুষ তার সভ্যতা গড়ে তুলেছে, সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদের শ্যামলী বাংলায় সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? এখানকার মানুষ কোথায় হারাল?
প্রশ্নটি আমাকে করা হয়েছিল মোবাইল ফোনে। আমার স্কুলজীবনের বন্ধু, একটি সরকারি ব্যাংকের চাকুরে, ঈদের ছুটিতে উত্তরবঙ্গে যেতে যেতে, সস্ত্রীক ও সপুত্র-কন্যা জ্যামে আটকে থাকতে থাকতে সব রাগ ঝেড়েছিল আমার ওপর। আমার অপরাধ—আমি দেশাত্মবোধ নিয়ে গান লিখি, গাই। ওদের গাইবান্ধা যাওয়ার বাসের টিকিট ছিল ১৪ নভেম্বর। কিন্তু ওই দিন খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করার বিএনপির অভিযোগের প্রতিশোধের হরতাল ঘোষিত ছিল। বাসওয়ালারা বাস ছাড়েননি অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ভয়ে। আমার সেই বন্ধু বহু কষ্টে পরদিন যাত্রারম্ভ করেছিল সকাল সাতটায় ঢাকার শ্যামলী থেকে। আমার কাছে ফোন করেছিল দুপুর একটায়, তখন তাদের বাসটি সাভারের ইপিজেড এলাকায় অনড় দাঁড়িয়ে ছিল। তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ছিল ক্রমেই এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বন্ধুটি আমাকে বলেছিল অনেক মুদ্রণ অযোগ্য কথা। যেন আমিই খালেদা জিয়া অথবা সরকার। অন্যের পাপের শাস্তি নিজে ভোগ করা আর কি!
এই কয়েক দিন ওলটপালট করে ভাবছি। সমস্যাটা আসলে কোথায়? খালেদা জিয়া ওই বাড়িতে আর থাকতে পারবেন না, আদালত এই মর্মে রায় দেওয়ার পর তাঁর বাড়ি ছাড়তে অসুবিধাটা কী ছিল? খালেদা জিয়া প্রচারমাধ্যমে অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, বাড়ির বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নজিরবিহীনভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁকে। আর একই দিন আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছিল: খালেদা জিয়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন। এই দুটি বিবৃতি পাঠ করে বা শুনে আদালত সম্পর্কে আমরা কী ভাবব? সমস্যাটা কোথায়?
চলুন, হিতোপদেশের জন্য বিখ্যাত ঈশপের গল্পভান্ডার থেকে একটি প্রাসঙ্গিক গল্প পড়ি। শিরোনাম ‘কুকুর ও তার প্রতিবিম্ব’। এক কুকুর এক টুকরো মাংস মুখে নদী পার হচ্ছিল। নদীর স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে কুকুরটির মনে হলো, আরেকটি কুকুরও মাংস মুখে নদী পার হচ্ছে। ওরটাও কেড়ে নেওয়া যাক—এই ভেবে যেই না সে হাঁ করেছে, অমনি তার মুখের টুকরো জলে পড়ে স্রোতে যে কোথায় ভেসে গেল। এটুকরো-ওটুকরো দুই-ই সে হারাল।
প্রতিহিংসার বিষে বেহুলা বাংলা আর কতবার নীল হবেন? মনসার ব্যবসার রাজ্যে চাঁদ সওদাগরের ব্যবসার আগ্রাসনের দ্বন্দ্ব—এই পুনরাবৃত্ত থেকে মুক্তি নেই? হবে না?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.