রবীন্দ্র-পুরস্কার by মাহবুব মোর্শেদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বহুবর্ণিল আয়োজনে মেতেছে বাংলাদেশ। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আয়োজন চলছে। চলবে আরও কিছুকাল। অনুরাগীরা বলছেন, আয়োজন যেন সার্ধশতবর্ষ পালনেই থেমে না থাকে। রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবনের চেষ্টাটা যেন অনুষ্ঠান-আয়োজনের বাইরেও চলতে থাকে।


বস্তুত, এই প্রত্যাশার মধ্যে ইতিবাচক দিক যেমন আছে তেমনি এর অন্তর্গত মৃদু পরিহাসও লক্ষ্য করার মতো। আমাদের গুণীরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের সর্বত্র। প্রশ্ন করেন রবীন্দ্রনাথ কোথায় নেই? সাহিত্যে, শিক্ষায়, জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজে সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আমাদের পাথেয়। কিন্তু কেতাবের কথা বাদ দিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, রবীন্দ্রনাথ আসলে আমাদের জীবনে, জীবনাচারে, রাজনীতিতে, সমাজে কোথায় আছেন? তবে অনেকেরই মাথায় হাত পড়বে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও আদর্শ খুঁজতে রীতিমতো গবেষণা শুরু করবেন।
বস্তুত, আমাদের জীবনের বহিরঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আছেন বটে; কিন্তু অন্তরে রবীন্দ্রনাথ বোধহয় অনুপস্থিত। তার সাহিত্য অনুধাবনের চেষ্টা কতটা আমাদের পাঠকদের মধ্যে আছে, সে প্রশ্ন তুলে রেখে যদি এ প্রশ্ন করা যায়, তার মতো সাহিত্য সাধনা, পরিশ্রম, নিষ্ঠা কি আজকাল কোনো সাহিত্যিকের মধ্যে দেখা যায়? সাহিত্যিক হিসেবে তিনি অনন্য প্রতিভা নিশ্চয়ই কিন্তু কর্মোদ্যোগী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যে শিক্ষা, সামাজিক উদ্যোগ তেমন উদ্যোগও কি আছে আমাদের সমাজে? রবীন্দ্রনাথকে, তার শুভ কাজকে অনুসরণের চেষ্টা যদি না থাকে, তাকে স্মরণ করে এত এত উৎসবের কী প্রয়োজন? কেউ বলবেন, উৎসবের নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তার নাম, গান, বাণীকে কিছুটা হলেও সঞ্চারিত করতে পারে এ উৎসবগুলো। সে নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু কতটুকু পারে? উৎসব শেষে প্যান্ডেল পড়ে থাকে, শামিয়ানার নিচে প্রচুর আবর্জনাও জমে। বক্তৃতা শেষ হলে তার অনুরণন রয়ে যায়। চারপাশে যত আয়োজন তার অধিকাংশই তো এভাবেই ফুরাবে। হয়তো কিছু বই, কিছু প্রকাশনা থাকবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রচনার চেয়ে শ্রেয়তর তো নয় সেসব। তবে? রবীন্দ্রনাথের রচনাকে মানুষের কাছে পেঁৗছানোর কোনো আয়োজন কিন্তু এবার এত ডামাডোলের মধ্যেও চোখে পড়ল না। রচনার কথা বাদ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের বাইরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখার মতো কিছু কি হলো? রবীন্দ্রনাথের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বাংলাদেশে। কোনো একাডেমী, ইনস্টিটিউট নেই, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এক বছরে কিছু গড়ে উঠল না। গড়ার উদ্যোগও এলো না। অন্যদিকে ভারতের দিকে তাকান। অনুষ্ঠান আয়োজনে ভারত আমাদের সঙ্গী। কলকাতা-দিলি্লতে নানা আয়োজন চলছে আমাদের মতোই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও কাজের উত্তরাধিকার ভারতীয়রাও গভীরভাবে বহন করে। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র-রচনাবলি অনলাইনে প্রকাশ করে ভারত আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছে। এবার রবীন্দ্রনাথের ২০০০ ছবি অনলাইনে প্রকাশ করা হলো। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীকে নতুনভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলো ৯৫ কোটি রুপি। ঘোষণা এসেছে শান্তিনিকেতনসহ রবীন্দ্রস্মৃতিগুলো আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সংরক্ষণেরও। আর আগামী বছর থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য এক ব্যক্তিকে রবীন্দ্র-পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদৃষ্টিকে আবারও সবার সামনে তুলে ধরার এমন আয়োজন নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। দেশে যেমন, দেশের বাইরেও তেমন পুরস্কারের মর্যাদা রক্ষায় ভারতীয়রা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দলমতের বাইরে এসে দেশের ভেতরে গুণীজনদের পুরস্কৃত করার একটি শক্তিশালী ধারা তারা গড়ে তুলেছে। তাদের আয়োজনে রবীন্দ্র-পুরস্কার নিশ্চয়ই বিশেষ মর্যাদা পাবে। কীভাবে গুণীদের পুরস্কৃত করতে হয় তা নিশ্চয় আমরা তাদের কাছে শিখতে পারি। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় শিখে নিতে হবে। সাময়িক আয়োজনে, তাৎক্ষণিক আবেগে না ভেসে কীভাবে একটি স্মরণ আয়োজনকে দীর্ঘস্থায়ী মাত্রা দেওয়া যায়, সে শিক্ষাও ভারতীয়দের কাছ থেকেই নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.