জলবায়ু পরিবর্তন-বাংলাদেশে জীবিকা হারানো মানুষের ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুতি’ by আহসান উদ্দিন আহমেদ ও শরমিন্দ নীলোর্মি
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা। যত সময় গড়াতে থাকবে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত ততই অনুভূত হতে থাকবে এবং তা কেবল কিছু নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ না থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ ওপরের দিকেই অবস্থান করবে।
আইপিসিসি বহু গবেষণার ফলাফল উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে দরিদ্র দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সেখানকার দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় প্রথম সারির দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। প্রশ্ন হলো, জলবায়ুতাড়িত বিপুলসংখ্যক দরিদ্রকে নিয়ে কীভাবে একটি অগ্রসর মধ্য-আয়ের দেশ হবে বাংলাদেশ?
বিগত তিন দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর অন্যতম হচ্ছে কৃষির আধুনিকায়ন এবং ফসলের উৎপাদন বাড়ানো। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষক ও কৃষি-গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টার এসব অর্জন নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। অথচ জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে তাই খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সমুদ্রের উপরিতলে স্ফীতি ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে উপকূলীয় কৃষকদের। লবণাক্ত এলাকা দেশের ভেতরে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। লবণের প্রকোপে প্রচলিত কৃষি তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমের বহু এলাকায় প্রচলিত বোরো ধানের আবাদ করা যাবে না। উপকূলীয় এলাকার নদীতে লবণ অনুপ্রবেশ করায় নদীর পানি দিয়ে সেচ দেওয়া যাবে না, ফলে শুকনো মৌসুমের ফসল উৎপাদন লক্ষণীয় পর্যায়ে কমে যাবে।
তীব্র বন্যা ও সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সড়ক যোগাযোগ ও স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে। সমুদ্রের পানির উজানমুখী ধাক্কা আরও বেশি সক্রিয় থাকার কারণে ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত ক্ষয়ে যাবে, এমনকি কোনোটির অংশবিশেষ হঠাৎ ভেসে গিয়ে বাঁধের ভেতরের মানুষ ও স্থাপনার জন্য দুর্যোগ বয়ে আনবে। এখনো পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে সামান্যই। অথচ তারই প্রভাবে সমুদ্রের পানির উজানমুখী ধাক্কা এতটাই বেড়েছে যে সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা ও কক্সবাজারের দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো অহরহ ভেঙে পড়ছে সমুদ্র থেকে আসা ঢেউয়ের তাণ্ডবে।
লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হবে (পুরোনো শিল্পগুলো এখন ধুঁকছে)। এমনকি এ দেশের গৌরব সুন্দরবনও লবণাক্ততার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ থাবায় বিপর্যস্ত হবে। অপরাপর এলাকার চেয়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুকনো মৌসুমে বৃষ্টিহীনতা নদীর ক্ষীণ প্রবাহকে আরও কমিয়ে দেবে, এতে জোয়ারের উজানমুখী চাপে ক্রমশ আরও বেশি এলাকায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়বে।
উপকূলে বাঁধের বেষ্টনী থাকা সত্ত্বেও মানুষের জীবনযাত্রা নানাভাবে বিঘ্নিত হবে। বিগত কয়েক বছরে অনেক এলাকায় বাঁধের বেষ্টনী ভেঙে গেছে সঞ্চিত তাপের প্রভাবে অধিকতর শক্তিশালী উজানমুখী ঢেউয়ের ধাক্কায়। এতে শস্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। এ ছাড়া সমুদ্র স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি ফুঁসতে থাকায় ঘনঘন ৩ নম্বর বিপৎসংকেত দেখানোর ফলে সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীরা নিয়মিত মাছ ধরতে পারেননি। এতে তাঁদের জীবিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ বারবার ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে, যা উপকূল এলাকার জনজীবনকে তীব্র ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
এ ছাড়া দুর্যোগের ঘনঘটা বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে পানিবাহিত ও অন্যান্য রোগ, যেমন—ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বর্তমানের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে। এ ছাড়া চৈত্র, বৈশাখ ও ভাদ্র মাসের গরমে শিশু এবং বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা রয়েছে।
আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কয়েকটি ‘আপদ-বলয়ভুক্ত’ এলাকা আছে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, এসব আপদ-বলয় থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ দলে দলে বেরিয়ে আসছে এবং অজানা পথে পাড়ি দিচ্ছে। শহরমুখী মানুষের ঢল লক্ষণীয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা আগেই জানা গেছে যে নগরে এবং উপকণ্ঠের অতিদরিদ্র মানুষের একটা বড় অংশ আপদ বা দুর্যোগ-পরবর্তী সীমাহীন কষ্টের প্রেক্ষাপটে সবকিছু খুইয়ে একসময় বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়েছে।
যেখানে জীবনযাপন-প্রক্রিয়া ও ভঙ্গুর জীবিকা টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন, সেখানে বিপন্নতা মাত্রাতিরিক্ত। সেখানে জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে মানুষ কীভাবে থাকবে? যেখানে বায়ুমণ্ডলের আজেবাজে গ্যাসের থাবায় মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেখানে সৃজনীশক্তি থাকলেও সে ভঙ্গুর জীবনীশক্তি নিয়ে বসবাস করতে পারে না। অগত্যা বাস্তুচ্যুতি ছাড়া তখন কীই-বা করার থাকে?
জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাবে তাই বাস্তুচ্যুতি অনিবার্যভাবে দেখা দিয়েছে। ব্যাপক মাত্রায় জীবন ও জীবিকা নষ্ট হলে বাস্তুচ্যুতির সংকট ঘনীভূত হবে। অথচ এই মানুষগুলো, যারা ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ঘটানোয় তাদের দায়দায়িত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এরা নিরীহ ও চলমান ঘটনার অশুভ বাস্তবতার অসহায় শিকার মাত্র।
এই অন্যায্য পরিস্থিতি থেকে বিপন্ন মানুষকে মুক্তি দিতে হলে প্রথমত দেশীয় পর্যায়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এর কার্যকরণটি আন্তর্জাতিক, তার ন্যায্য সমাধান তাই আন্তর্জাতিক পরিসরে হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক কাঠামো সনদ (১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত) মতে, এসব বাস্তুচ্যুত মানুষের অসহায় থাকার কথা নয়। এদের অভিযোজন করার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক মতৈক্য তৈরি হচ্ছে, এবারের তৃতীয় আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়ে এ বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘসহ সবার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু অভিযোজনের মাত্রাভেদ আছে। যখন বা যেখানে বিপন্নতা মাত্রাতিরিক্ত, সেখানে অভিযোজনের মানে হলো হয় আপদের সম্ভাব্য মাত্রা কমাতে হবে, নয়তো অন্যত্র সরে গিয়ে ঝুঁকির মাত্রা কমাতে হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে সম্ভাব্য কম ঝুঁকির এলাকায় সরে যাওয়াই সেখানে ‘অভিযোজন’।
কিন্তু এ দেশে সম্ভাব্য কম ঝুঁকির এলাকায় সরে যাওয়াটা সহজ নয়। এত ঘনবসতির দেশ পৃথিবীজুড়ে আর নেই। কোথায় পাওয়া যাবে এমন জায়গা, যেখানে সহজে ভাগ্যহত মানুষের নির্বিঘ্নে জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়া যাবে? গেলেও কতজনকে?
তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনতাড়িত বাস্তুহারা মানুষদের ভবিষৎ কী?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক কাঠামো সনদ মতে, ‘সরে গিয়ে’ বিপন্নতা কমাতে হলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন ছাড়া গতি নেই। কিন্তু এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতা এখনো খুব কম। এখনো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দর-কষাকষি ভালোভাবে শুরু হয়নি।
অভিবাসন বিষয়টি নতুন নয়। তবে এত দিন যা ছিল ‘সুযোগসন্ধানী অভিবাসন’ (যেমন, আমাদের শ্রমিকেরা গেছেন এবং নিরন্তর টাকা পাঠিয়ে দেশ গঠনে সবিশেষ ভূমিকা রাখছেন), তার চেয়ে এখনকার ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুতি’-জনিত অভিবাসন হবে মৌলিকভাবে ভিন্ন। এখানে যেহেতু সম্ভাব্য অভিবাসীদের অধিকার ও ন্যায্যতা হরণ করেছে উন্নত অর্থনীতির দেশের ছেড়ে দেওয়া গ্যাস, ন্যায্যতার বিচারে তাদের জন্য ওই সব দেশে অভিবাসনের সুযোগ করে দিতে হবে। এটা দয়া নয়, অধিকার। আর জলবায়ুূ পরিবর্তনতাড়িত ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুত’ কষ্টে থাকা মানুষের অধিকার নিয়ে আমাদের লড়াইটা চালাতেই হবে।
আমাদের মতে, বাংলাদেশ থেকে এ বিষয়ে কথা তোলা উচিত। আমাদের মতো বিপন্ন দেশ থেকে এবং এত বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা নিয়ে আমরা যদি এ বিষয়ে কথা না তুলি, তাহলে আমাদের হয়ে দর-কষাকষি করবে কে? দেরিতে হলেও এ বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছেন। যদিও আন্তর্জাতিক দর-কষাকষিতে আমাদের মতো নাগরিক সমাজের দাবি উপেক্ষা করে কখনোই বাংলাদেশ বাস্তুচ্যুত মানুষের অভিবাসন নিয়ে কোনো দাবিনামা পেশ করেনি, দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্র্রতি জাতিসংঘে তাঁর বক্তৃতায় বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেছেন। আশা করি, এ দেশের হয়ে, যাঁরা প্রতিনিধি হয়ে দর-কষাকষিতে অংশ নেন, তাঁরা এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত অতি যৌক্তিক দাবিটি বারবার তুলতে আর ভুলে যাবেন না।
দাবিনামা তুলতে পারলেই যে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো তা এমনি এমনি হাসিমুখে মেনে নেবে, তা নয়। তারা অনেক বিতর্ক তুলবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা, ভাষা জানার অযোগ্যতা, সাংস্কৃতিক বিভেদ—কত শত দুর্বলতা! সঠিকভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের ধারণা, অনেক বিতর্ক উঠবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একটু সুবিধাজনক জায়গায় আছে। আমরা জলবায়ুূ পরিবর্তনতাড়িত ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুত’ মানুষকে সহজেই খুঁজে দিতে পারি, ভোটার আইডি কার্ড ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুত’ মানুষের খুঁজে দিতে সাহায্য করবে। এখন দাবিটি যথাস্থানে পেশ করা হোক, আলোচনাটা শুরু হোক, অন্যরা এতে অংশ নিতে শুরু করুক। অনেক দেশই আমাদের সঙ্গী হবে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুত জনমত গঠন করা দরকার। সামনেই মেক্সিকোর কানকুনে উচ্চপর্যায়ে আন্তর্জাতিক দর-কষাকষি সংঘটিত হবে, একটি নতুন চুক্তিও হয়তো স্বাক্ষরিত হবে। আমরা কি পারব এ বিষয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে? আপামর মানুষ কিন্তু আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের দিকে আশা করে তাকিয়ে আছে।
আহসান উদ্দিন আহমেদ: সমন্বয়কারী, সেন্টার ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুডস, সিএসআরএল।
শরমিন্দ নীলোর্মি: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য, সিএসআরএল)।
বিগত তিন দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর অন্যতম হচ্ছে কৃষির আধুনিকায়ন এবং ফসলের উৎপাদন বাড়ানো। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষক ও কৃষি-গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টার এসব অর্জন নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। অথচ জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে তাই খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সমুদ্রের উপরিতলে স্ফীতি ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে উপকূলীয় কৃষকদের। লবণাক্ত এলাকা দেশের ভেতরে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। লবণের প্রকোপে প্রচলিত কৃষি তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমের বহু এলাকায় প্রচলিত বোরো ধানের আবাদ করা যাবে না। উপকূলীয় এলাকার নদীতে লবণ অনুপ্রবেশ করায় নদীর পানি দিয়ে সেচ দেওয়া যাবে না, ফলে শুকনো মৌসুমের ফসল উৎপাদন লক্ষণীয় পর্যায়ে কমে যাবে।
তীব্র বন্যা ও সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সড়ক যোগাযোগ ও স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে। সমুদ্রের পানির উজানমুখী ধাক্কা আরও বেশি সক্রিয় থাকার কারণে ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত ক্ষয়ে যাবে, এমনকি কোনোটির অংশবিশেষ হঠাৎ ভেসে গিয়ে বাঁধের ভেতরের মানুষ ও স্থাপনার জন্য দুর্যোগ বয়ে আনবে। এখনো পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে সামান্যই। অথচ তারই প্রভাবে সমুদ্রের পানির উজানমুখী ধাক্কা এতটাই বেড়েছে যে সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা ও কক্সবাজারের দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো অহরহ ভেঙে পড়ছে সমুদ্র থেকে আসা ঢেউয়ের তাণ্ডবে।
লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হবে (পুরোনো শিল্পগুলো এখন ধুঁকছে)। এমনকি এ দেশের গৌরব সুন্দরবনও লবণাক্ততার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ থাবায় বিপর্যস্ত হবে। অপরাপর এলাকার চেয়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুকনো মৌসুমে বৃষ্টিহীনতা নদীর ক্ষীণ প্রবাহকে আরও কমিয়ে দেবে, এতে জোয়ারের উজানমুখী চাপে ক্রমশ আরও বেশি এলাকায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়বে।
উপকূলে বাঁধের বেষ্টনী থাকা সত্ত্বেও মানুষের জীবনযাত্রা নানাভাবে বিঘ্নিত হবে। বিগত কয়েক বছরে অনেক এলাকায় বাঁধের বেষ্টনী ভেঙে গেছে সঞ্চিত তাপের প্রভাবে অধিকতর শক্তিশালী উজানমুখী ঢেউয়ের ধাক্কায়। এতে শস্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। এ ছাড়া সমুদ্র স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি ফুঁসতে থাকায় ঘনঘন ৩ নম্বর বিপৎসংকেত দেখানোর ফলে সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীরা নিয়মিত মাছ ধরতে পারেননি। এতে তাঁদের জীবিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ বারবার ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে, যা উপকূল এলাকার জনজীবনকে তীব্র ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
এ ছাড়া দুর্যোগের ঘনঘটা বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে পানিবাহিত ও অন্যান্য রোগ, যেমন—ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বর্তমানের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে। এ ছাড়া চৈত্র, বৈশাখ ও ভাদ্র মাসের গরমে শিশু এবং বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা রয়েছে।
আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কয়েকটি ‘আপদ-বলয়ভুক্ত’ এলাকা আছে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, এসব আপদ-বলয় থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ দলে দলে বেরিয়ে আসছে এবং অজানা পথে পাড়ি দিচ্ছে। শহরমুখী মানুষের ঢল লক্ষণীয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা আগেই জানা গেছে যে নগরে এবং উপকণ্ঠের অতিদরিদ্র মানুষের একটা বড় অংশ আপদ বা দুর্যোগ-পরবর্তী সীমাহীন কষ্টের প্রেক্ষাপটে সবকিছু খুইয়ে একসময় বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়েছে।
যেখানে জীবনযাপন-প্রক্রিয়া ও ভঙ্গুর জীবিকা টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন, সেখানে বিপন্নতা মাত্রাতিরিক্ত। সেখানে জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে মানুষ কীভাবে থাকবে? যেখানে বায়ুমণ্ডলের আজেবাজে গ্যাসের থাবায় মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেখানে সৃজনীশক্তি থাকলেও সে ভঙ্গুর জীবনীশক্তি নিয়ে বসবাস করতে পারে না। অগত্যা বাস্তুচ্যুতি ছাড়া তখন কীই-বা করার থাকে?
জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাবে তাই বাস্তুচ্যুতি অনিবার্যভাবে দেখা দিয়েছে। ব্যাপক মাত্রায় জীবন ও জীবিকা নষ্ট হলে বাস্তুচ্যুতির সংকট ঘনীভূত হবে। অথচ এই মানুষগুলো, যারা ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ঘটানোয় তাদের দায়দায়িত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এরা নিরীহ ও চলমান ঘটনার অশুভ বাস্তবতার অসহায় শিকার মাত্র।
এই অন্যায্য পরিস্থিতি থেকে বিপন্ন মানুষকে মুক্তি দিতে হলে প্রথমত দেশীয় পর্যায়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এর কার্যকরণটি আন্তর্জাতিক, তার ন্যায্য সমাধান তাই আন্তর্জাতিক পরিসরে হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক কাঠামো সনদ (১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত) মতে, এসব বাস্তুচ্যুত মানুষের অসহায় থাকার কথা নয়। এদের অভিযোজন করার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক মতৈক্য তৈরি হচ্ছে, এবারের তৃতীয় আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়ে এ বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘসহ সবার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু অভিযোজনের মাত্রাভেদ আছে। যখন বা যেখানে বিপন্নতা মাত্রাতিরিক্ত, সেখানে অভিযোজনের মানে হলো হয় আপদের সম্ভাব্য মাত্রা কমাতে হবে, নয়তো অন্যত্র সরে গিয়ে ঝুঁকির মাত্রা কমাতে হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে সম্ভাব্য কম ঝুঁকির এলাকায় সরে যাওয়াই সেখানে ‘অভিযোজন’।
কিন্তু এ দেশে সম্ভাব্য কম ঝুঁকির এলাকায় সরে যাওয়াটা সহজ নয়। এত ঘনবসতির দেশ পৃথিবীজুড়ে আর নেই। কোথায় পাওয়া যাবে এমন জায়গা, যেখানে সহজে ভাগ্যহত মানুষের নির্বিঘ্নে জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়া যাবে? গেলেও কতজনকে?
তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনতাড়িত বাস্তুহারা মানুষদের ভবিষৎ কী?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক কাঠামো সনদ মতে, ‘সরে গিয়ে’ বিপন্নতা কমাতে হলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন ছাড়া গতি নেই। কিন্তু এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতা এখনো খুব কম। এখনো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দর-কষাকষি ভালোভাবে শুরু হয়নি।
অভিবাসন বিষয়টি নতুন নয়। তবে এত দিন যা ছিল ‘সুযোগসন্ধানী অভিবাসন’ (যেমন, আমাদের শ্রমিকেরা গেছেন এবং নিরন্তর টাকা পাঠিয়ে দেশ গঠনে সবিশেষ ভূমিকা রাখছেন), তার চেয়ে এখনকার ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুতি’-জনিত অভিবাসন হবে মৌলিকভাবে ভিন্ন। এখানে যেহেতু সম্ভাব্য অভিবাসীদের অধিকার ও ন্যায্যতা হরণ করেছে উন্নত অর্থনীতির দেশের ছেড়ে দেওয়া গ্যাস, ন্যায্যতার বিচারে তাদের জন্য ওই সব দেশে অভিবাসনের সুযোগ করে দিতে হবে। এটা দয়া নয়, অধিকার। আর জলবায়ুূ পরিবর্তনতাড়িত ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুত’ কষ্টে থাকা মানুষের অধিকার নিয়ে আমাদের লড়াইটা চালাতেই হবে।
আমাদের মতে, বাংলাদেশ থেকে এ বিষয়ে কথা তোলা উচিত। আমাদের মতো বিপন্ন দেশ থেকে এবং এত বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা নিয়ে আমরা যদি এ বিষয়ে কথা না তুলি, তাহলে আমাদের হয়ে দর-কষাকষি করবে কে? দেরিতে হলেও এ বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছেন। যদিও আন্তর্জাতিক দর-কষাকষিতে আমাদের মতো নাগরিক সমাজের দাবি উপেক্ষা করে কখনোই বাংলাদেশ বাস্তুচ্যুত মানুষের অভিবাসন নিয়ে কোনো দাবিনামা পেশ করেনি, দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্র্রতি জাতিসংঘে তাঁর বক্তৃতায় বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেছেন। আশা করি, এ দেশের হয়ে, যাঁরা প্রতিনিধি হয়ে দর-কষাকষিতে অংশ নেন, তাঁরা এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত অতি যৌক্তিক দাবিটি বারবার তুলতে আর ভুলে যাবেন না।
দাবিনামা তুলতে পারলেই যে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো তা এমনি এমনি হাসিমুখে মেনে নেবে, তা নয়। তারা অনেক বিতর্ক তুলবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা, ভাষা জানার অযোগ্যতা, সাংস্কৃতিক বিভেদ—কত শত দুর্বলতা! সঠিকভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের ধারণা, অনেক বিতর্ক উঠবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একটু সুবিধাজনক জায়গায় আছে। আমরা জলবায়ুূ পরিবর্তনতাড়িত ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুত’ মানুষকে সহজেই খুঁজে দিতে পারি, ভোটার আইডি কার্ড ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুত’ মানুষের খুঁজে দিতে সাহায্য করবে। এখন দাবিটি যথাস্থানে পেশ করা হোক, আলোচনাটা শুরু হোক, অন্যরা এতে অংশ নিতে শুরু করুক। অনেক দেশই আমাদের সঙ্গী হবে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুত জনমত গঠন করা দরকার। সামনেই মেক্সিকোর কানকুনে উচ্চপর্যায়ে আন্তর্জাতিক দর-কষাকষি সংঘটিত হবে, একটি নতুন চুক্তিও হয়তো স্বাক্ষরিত হবে। আমরা কি পারব এ বিষয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে? আপামর মানুষ কিন্তু আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের দিকে আশা করে তাকিয়ে আছে।
আহসান উদ্দিন আহমেদ: সমন্বয়কারী, সেন্টার ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুডস, সিএসআরএল।
শরমিন্দ নীলোর্মি: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য, সিএসআরএল)।
No comments