রাজনীতি সংস্কৃতি-মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি by শাহদীন মালিক
‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটা প্রচণ্ড গোলমেলে। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, উন্নয়ন চিন্তা—সব জায়গায় মধ্যবিত্তের অবস্থান সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু অবস্থানটা ভালো না মন্দ তা নিয়ে বিতর্ক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো।
বামপন্থী রাষ্ট্রচিন্তা, ইতিহাস, বিপ্লব এবং আনুষঙ্গিক তত্ত্বকথায় ‘মধ্যবিত্তের’ অবস্থান ছিল নাজুক, বহুকাল ধরে।
বামপন্থী রাষ্ট্রচিন্তা, ইতিহাস, বিপ্লব এবং আনুষঙ্গিক তত্ত্বকথায় ‘মধ্যবিত্তের’ অবস্থান ছিল নাজুক, বহুকাল ধরে।
বুর্জুয়া, পাতি-বুর্জুয়ার সঙ্গে মধ্যবিত্তকে একাকার করে মাঝে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে মধ্যবিত্ত কোথায় লুকাবে তার হদিস পাচ্ছিল না। সারা বিশ্বের অতিবাম, মধ্যবাম, অল্পবাম—সব বামপন্থী মধ্যবিত্তের ওপর ভীষণভাবে চড়াও হলো ১৯২০-এর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিভিন্ন দেশ ঘুরে সত্তরের কম্বোডিয়া (এখন কাম্পুচিয়া) পর্যন্ত। জমিদার-জোতদার-বুর্জুয়া-মধ্যবিত্ত—বিভিন্ন দেশে সব একাকার হয়ে মারা পড়ল হাজারে হাজারে, কোথাও লাখ লাখ।
প্রায় এক যুগ আগে কম্বোডিয়ায় গিয়েছিলাম ‘আইন-বিচার’-এর খোঁজে। সত্তরের পলপট যুগ ও আশির ভিয়েতনাম-চীন-রাশিয়ার পর নব্বইয়ের প্রথম থেকে কিছুটা স্থিতি দিয়েছে দেশটিতে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে খুনোখুনি-হানাহানি আর হত্যাযজ্ঞ চলেছিল। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন সারা দেশে তিন মাস-ছয় মাসের কোর্স করে আইনজীবী-বিচারক তৈরির চেষ্টা চলছিল বিভিন্নভাবে। অনেকে ম্যাট্রিক বা সমমানের পরীক্ষা পাস। তারপর তিন মাসের কোর্স। এতেই আইনজীবী সনদ দেওয়া হচ্ছিল। কারণ সোজা। নব্বইয়ের শুরুর দিকে সারা দেশ খুঁজে কুল্লে জনা বারোর বেশি আইনজীবী জীবিত পাওয়া যায়নি। মধ্যবিত্ত-পেশাজীবী এরা সবাই দেশের শত্রু। অতএব দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এদের নিধন করো। এবং নিধন করাও হয়েছিল অকাতরে।
আমাদের দেশেও গণযুদ্ধ, জনযুদ্ধ, লাল-নীল যুদ্ধ ইত্যাদি নামে কিছু এলাকায় ‘শ্রেণীশত্রু’ নিধন অভিযান চলেছে। তাই বলছিলাম, মধ্যবিত্তের কপাল মন্দ হয়েছিল বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ছুতায়। কেনা-বেচা, পাইকারি-আড়তদারি, পেশাজীবী আর বিদেশে চাকরির সুবাদে যে মধ্যজীবী—এটা আমাদের দেশে ইদানীংকালের ব্যাপার। ভূমিদস্যু, চিংড়িঘের ব্যবসায়ী বা ভেজাল জিনিসে বাজার সয়লাব করে যারা টাকা-পয়সা কামিয়েছেন, তাঁদের বলা বাহুল্য, আমি মধ্যবিত্তের মধ্যে জায়গা দিচ্ছি না।
অনেকে বলতেই পারেন—নব্য মধ্যবিত্ত মানেই চুরি-বাটপারি, ভেজাল, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এটাও সত্য যে চোর-বাটপার-দুর্নীতিবাজ আর ভেজালবাদ থেকে অনেক অনেক বেশি লোক তাদের শ্রম, মেধা, পেশা আর বিদ্যা-বুদ্ধির জোরে এখন মধ্যবিত্তের কাতারভুক্ত হয়েছে।
২.
বেশ কয়েক বছর ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল যে এই কাতারটা হু হু করে লম্বা হচ্ছে। ঢাকা শহরের সব আনাচ-কানাচে অন্তত ১০ বছর ধরে বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, শপিং সেন্টার আর সেই সঙ্গে এলাকাভেদে আট শ-হাজার বর্গফুটের এত হাজার হাজার ইমারত হচ্ছে কিন্তু খালি পড়ে নেই একটাও। আমাদের আশপাশের কোনো দেশে এভাবে এক যুগ ধরে ক্রমাগতভাবে এমন ‘ইকোনমিক বুম’ নজরে পড়েনি।
শোষণ-দুর্নীতি-বৈষম্য—সবই আছে, কিন্তু মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে বেশুমার। এখন প্রতিদিন ঢাকা শহরে নতুন গাড়ির নিবন্ধন হয় দুই শর বেশি।
এই অধম দূর থেকে দেখে অর্থনীতি বোঝে না আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভয়ে দোকানে যাওয়া পরিত্যাগ করেছে বছর তিনেক সম্পূর্ণভাবে। কিন্তু ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ তো খবর রাখেন, পত্রপত্রিকায় লেখেন। ১২ নভেম্বর দি ডেইলি স্টার-এ তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল, ‘দি রাইজ অব দি মিডিল ক্লাস’ অর্থাৎ মধ্যবিত্তের উত্থান।
এই ঈদের মৌসুমে আমাদের আশপাশের দেশে যাওয়ার জন্য নাকি প্লেনের টিকিট নেই। গত রোজায় বড় বড় সব হোটেলে ইফতার খেতে গিয়ে ভিড়ের চোটে অনেকেই রোজা দীর্ঘায়িত করে ফিরে গেছেন।
আমার ছোটবেলার বন্ধু যাদের ফিটফাট স্টাইল মার্কা কাপড়ের দোকান অথবা ফ্রিজ, টেলিভিশন, তারা অনেক আগে থেকেই মফস্বল শহরে দোকান খুলে কূল পাচ্ছে না।
মধ্যবিত্ত কে, অর্থাৎ আয়ের পরিমাণ কী, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী, সামাজিক এবং ক্ষমতার বলয়ে সে কোথায়, শিক্ষা-দীক্ষা বা পেশা কী হতে হবে ইত্যাদি বহু প্রশ্ন-তত্ত্ব এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সাদামাটাভাবে একটা উত্তর দেওয়া যায়—কাজে বা ঈদে-পরবে যে লক্কড়ঝক্কড় লোকাল বাসে না উঠে একটু বেশি পয়সা খরচ করে ভালো বাসে যেতে পারে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য বাড়তি কিছু খরচ করতে পারে, ঈদে পছন্দ হলে একটার জায়গায় দুই সেট কাপড় কিনতে পারে। এসব ন্যূনতম শর্ত। এর ওপরে যারা অর্থাৎ গাড়ি আছে, বাড়ি না থাকলেও বাসায় মোটামুটি ভালো ফ্রিজ, টেলিভিশন আছে, ঈদে নিজের পরিবারের বাইরে আত্মীয় ও মাঝেমধ্যে অসচ্ছল পাড়া-প্রতিবেশীর জন্যও কাপড় কিনতে পারে। জনাপ্রতি লাখ তিনেক টাকা খরচ করে যে প্রায় লাখ খানেক বাঙালি এবার হজে গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই সাদামাটাভাবে মধ্যবিত্তের কাতারভুক্ত।
এ রকম মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা কত লাখ হবে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে অনেক লাখ যে হবে, তা নিয়ে নিশ্চয় বিতর্ক নেই।
৩.
মামুন রশীদের মতো আমারও ধারণা, এ দেশে এখন মধ্যবিত্তের একটা উত্থান হচ্ছে। সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি অনেক বাড়ছে। এই বৃদ্ধিমান সংখ্যাটা আমাদের রাজনীতি অতি শিগগিরই বিরাট পরিবর্তন বাধ্য করবে। কারণ ‘মধ্যবিত্ত’ শুধু টাকা-পয়সার হিসাবের ব্যাপার না। পুরোনো মার্ক্সীয় ধারণায় এবং সে ধারণার সঙ্গে খুব বেশি লোক যে তর্ক জুড়ে দেয়, তাও না—টাকা-পয়সা অর্থাৎ আর্থিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে মন-মানসিকতার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক উৎপাদন ব্যবস্থায় কী ধরনের অবস্থান ইত্যাদি তত্ত্বের কচকচানিতে না জড়িয়ে সাদামাটাভাবে যেটা অনস্বীকার্য, তা হলো মধ্যবিত্তের উত্থানের পরিণতিতে বা ফলে মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের ব্যাপ্তি ঘটবে। পুরো সমাজের মূল্যবোধের ওপর মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের প্রভাব পড়বে এবং শেষতক মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ সমাজের প্রধানতম বা প্রভাবশালী মূল্যবোধে পরিণত হবে।
এখানে সব ধরনের মূল্যবোধের কথা আনছি না। টার্গেট রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং আইনের শাসনের আকাঙ্ক্ষা। গণতন্ত্র, পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর আইনের শাসন—এটা মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ। সমাজে মধ্যবিত্ত কমবেশি সব সময়ই ছিল। পরিচ্ছন্ন, জনহিতকর রাজনীতি আর আইনের শাসনের সপক্ষের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধও ছিল। কিন্তু অতীতে—ধরুন, নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল অল্প কয়েক লাখ। ফলে তাদের মূল্যবোধ সমাজের প্রভাবশালী বা প্রধান মূল্যবোধ হয়ে উঠতে পারেনি।
ভারতের রাজনীতিতে সামরিক শাসন ছিল না, উর্দি পরারা আসতে পারেনি আর পাকিস্তান-বাংলাদেশে ঘনঘন এসেছে—অনেক সময় প্রচ্ছন্ন জনসমর্থনে—তার অন্যতম প্রধান কারণ ১৯৫০-এর দশক থেকেই ভারতীয় রাজনৈতিক মূল্যবোধের আঙিনায় ভারতীয় মধ্যবিত্তের আইনের শাসনের প্রতি যে সমর্থন ছিল, উর্দিওয়ালারা তা আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর বাধ্য হয়েছে এ জন্যই যে স্বাধীনতার পরপর ভারতে যে বিশাল মধ্যবিত্ত ছিল, তাদের মূল্যবোধ পুরো দেশ বা জাতির মূল্যবোধকে ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত করে।
গত ১০ বছরে ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকায় যে সারি সারি গাদাগাদি করে লাইন ধরে পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, সেটা কলকাতায় হয়েছে বহু আগে।
মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক মূল্যবোধ কী, এটা সাদা না কালো, ভালো না মন্দ, স্বার্থন্বেষী না পরোপকারী, নিজের আখের গোছানো না অন্যকে সাহায্য করা ইত্যাদি অনেক যথার্থ প্রশ্ন সহজেই উঠতে পারে। ওসবে না গিয়ে এক কথায় বলব—মধ্যবিত্ত চায় নিয়মতান্ত্রিক পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর আইনের শাসনের প্রতি হান্ড্রেড পারসেন্ট না হলেও বেশ পাকাপোক্ত সমীহা।
মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের এই যে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশার ধোপে আমাদের আজকের রাজনীতি টিকছে না।
বর্তমান রাজনীতি পঙ্কিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ, আখের গোছানোর রাজনীতি। নিজের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির রাজনীতি। আগে রাজনীতি-গণতন্ত্র মানে ছিল পাঁচ বছর পরপর একবার ভোট দেওয়া। দরিদ্র, শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া খেটে খাওয়া মানুষের অনেকের জন্য এ ভোট দেওয়াই গণতন্ত্র। কিন্তু পাঁচ বছরে একবার ভোট দিয়ে মধ্যবিত্ত গণতন্ত্র-রাজনীতি ভুলে যায় না।
প্রতিদিন জাতীয় পত্রিকার অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণ করা মধ্যবিত্তের সংখ্যা অনেক, অনেক হাজার। এরা প্রতিদিনই রাজনীতি করছে।
সব পত্রিকার অনলাইন জরিপের প্রশ্নগুলো মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের ক্রমাগত প্রথম অবস্থানও এই মূল্যবোধের প্রতিফলন।
মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রচুর দুর্নীতিবাজ, ভেজালবাজ, ঠগবাজ আছে। কিন্তু চুরি-ঘুষ-দুর্নীতি করে মোটামুটি একটা ফ্ল্যাট বা একখণ্ড জমি কিনে মধ্যবিত্তের খাতায় নাম লেখালে সে ‘ভদ্র’ হতে চায়। অন্তত চায়, তার ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল-কলেজে পড়ুক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও সস্তায়-মস্তায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রি হোক।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল বা সেশনজট হলো কি না তা নিয়ে দরিদ্র কৃষকের মাথাব্যথা নেই। মধ্যবিত্তের আছে। ২০ বছর আগে সারা দেশে শহুরে অর্থাৎ শহর এলাকায় বাস করা লোকের সংখ্যা ছিল লাখ বিশেক। এখন দুই কোটি ছুঁই ছুঁই করছে। হরতাল হলে গ্রামের লোকের কিছু যায়-আসে না, তাদের কৃষিকাজ, মাছধরা, নৌকা চালানো ব্যাহত হয় না। এখন সারা দেশে হরতাল হলে প্রায় দুই কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪.
বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং সে সঙ্গের ঘটনাগুলো যে পঙ্কিল রাজনীতি আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, তাতে মধ্যবিত্তের নাখোশ হওয়া আরও বেড়েছে। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তাদের অতীতমুখী প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে যে বেরোতে পারবে না, সেটা আরও স্পষ্ট, অনেকটা ধ্রুব সত্যের মতো ঠেকছে।
মধ্যবিত্ত চায় ভবিষ্যতের রাজনীতি, উন্নয়নের রাজনীতি, আইনের শাসনে পরিচালিত গণতন্ত্র। বাজিকরের রাজনীতি শেষপ্রায়। এখন এই মূল্যবোধের সপক্ষের মধ্যবিত্তের সংখ্যা অনেক অনেক বেড়েছে। বলা বাহুল্য, মধ্যবিত্ত মানেই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটাও সত্য যে মধ্যবিত্তই সব সমাজে সুস্থ, ভালো, মানবিক ও পরোপকারী চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক।
এই মধ্যবিত্তের কাছে ক্রমান্বয়ে মনে হচ্ছে বর্তমান রাজনীতি পঙ্কিলতা আর প্রতিহিংসায় আচ্ছন্ন। নিঃসন্দেহে দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ আছেন অনেক। কিন্তু প্রায় প্রতিটি দলে তাঁরা সংখ্যালঘু। এখন মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ অনুধাবন করে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনহিতকর রাজনীতির দিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যত জলদি মোড় নিতে পারে, ততই মঙ্গল। তবে এটা বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে হবে বলে বিশ্বাস দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
বিকল্প দুটো। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ দিনের ধ্যান-ধারণা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন। অথবা নতুন দল বা নেতৃত্ব সৃষ্টি। দুটোর কোনোটাই একদিনে বা এক বছরে হবে না। তবে বছর বছর ধরেও অপেক্ষা করতে হবে না। অন্য দুটো বিকল্প—সামরিক শাসন ও ধর্মীয় রাজনীতি—বাংলাদেশে এ ধরনের পরিবর্তন খুবই কঠিন হবে। মধ্যবিত্ত ধার্মিক, কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। মধ্যবিত্তের জন্য ধর্ম ইহ এবং পরজাগতিক। কিন্তু রাজনীতি-সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি ইহজাগতিক, পরজাগতিক চিন্তা-কল্পনা-আশা-দুঃস্বপ্ন তাদের সমাজ-রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করে না। বাঘ এল, বাঘ এল চিৎকার করা রাখাল বালকের মতো অনেকেই নিশ্চয় ধর্ম গেল, ইসলাম গেল গেল বলে বাজার গরম করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বেশি হলে আর এক দশক, ভোট মেলেনি গত নির্বাচনে, মিলবে না আগামী নির্বাচনেও।
আইন-আদালতে রাজনীতি ঢুকে গেছে, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, এমনকি রায় কেনা যায় বলে আমরা যতই উৎকণ্ঠিত হই না কেন, মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের চাপে এসব ঠিক হতে বাধ্য। ঠিক হতে কিছুটা দেরি হলে, আইনের শাসন বিন্দুমাত্র নেই, অর্থাৎ সামরিক জান্তার ক্ষমতা নেওয়ার বিষয়টিও এখন আর আগের মতো সহজ হবে না।
যারা বাড়ি ছাড়া করে, অথবা যারা বাড়ি রাখার রাজনীতি করে, তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে যে আমরা ত্যাক্ত-বিরক্ত। আপনাদের কোনো কথাতেই আর আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। আমরা বদলেছি, বদলাচ্ছি। আপনারাও বদলান। নতুবা আমাদের আস্থা সোপর্দ করব অন্য কোথাও।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
প্রায় এক যুগ আগে কম্বোডিয়ায় গিয়েছিলাম ‘আইন-বিচার’-এর খোঁজে। সত্তরের পলপট যুগ ও আশির ভিয়েতনাম-চীন-রাশিয়ার পর নব্বইয়ের প্রথম থেকে কিছুটা স্থিতি দিয়েছে দেশটিতে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে খুনোখুনি-হানাহানি আর হত্যাযজ্ঞ চলেছিল। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন সারা দেশে তিন মাস-ছয় মাসের কোর্স করে আইনজীবী-বিচারক তৈরির চেষ্টা চলছিল বিভিন্নভাবে। অনেকে ম্যাট্রিক বা সমমানের পরীক্ষা পাস। তারপর তিন মাসের কোর্স। এতেই আইনজীবী সনদ দেওয়া হচ্ছিল। কারণ সোজা। নব্বইয়ের শুরুর দিকে সারা দেশ খুঁজে কুল্লে জনা বারোর বেশি আইনজীবী জীবিত পাওয়া যায়নি। মধ্যবিত্ত-পেশাজীবী এরা সবাই দেশের শত্রু। অতএব দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এদের নিধন করো। এবং নিধন করাও হয়েছিল অকাতরে।
আমাদের দেশেও গণযুদ্ধ, জনযুদ্ধ, লাল-নীল যুদ্ধ ইত্যাদি নামে কিছু এলাকায় ‘শ্রেণীশত্রু’ নিধন অভিযান চলেছে। তাই বলছিলাম, মধ্যবিত্তের কপাল মন্দ হয়েছিল বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ছুতায়। কেনা-বেচা, পাইকারি-আড়তদারি, পেশাজীবী আর বিদেশে চাকরির সুবাদে যে মধ্যজীবী—এটা আমাদের দেশে ইদানীংকালের ব্যাপার। ভূমিদস্যু, চিংড়িঘের ব্যবসায়ী বা ভেজাল জিনিসে বাজার সয়লাব করে যারা টাকা-পয়সা কামিয়েছেন, তাঁদের বলা বাহুল্য, আমি মধ্যবিত্তের মধ্যে জায়গা দিচ্ছি না।
অনেকে বলতেই পারেন—নব্য মধ্যবিত্ত মানেই চুরি-বাটপারি, ভেজাল, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এটাও সত্য যে চোর-বাটপার-দুর্নীতিবাজ আর ভেজালবাদ থেকে অনেক অনেক বেশি লোক তাদের শ্রম, মেধা, পেশা আর বিদ্যা-বুদ্ধির জোরে এখন মধ্যবিত্তের কাতারভুক্ত হয়েছে।
২.
বেশ কয়েক বছর ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল যে এই কাতারটা হু হু করে লম্বা হচ্ছে। ঢাকা শহরের সব আনাচ-কানাচে অন্তত ১০ বছর ধরে বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, শপিং সেন্টার আর সেই সঙ্গে এলাকাভেদে আট শ-হাজার বর্গফুটের এত হাজার হাজার ইমারত হচ্ছে কিন্তু খালি পড়ে নেই একটাও। আমাদের আশপাশের কোনো দেশে এভাবে এক যুগ ধরে ক্রমাগতভাবে এমন ‘ইকোনমিক বুম’ নজরে পড়েনি।
শোষণ-দুর্নীতি-বৈষম্য—সবই আছে, কিন্তু মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে বেশুমার। এখন প্রতিদিন ঢাকা শহরে নতুন গাড়ির নিবন্ধন হয় দুই শর বেশি।
এই অধম দূর থেকে দেখে অর্থনীতি বোঝে না আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভয়ে দোকানে যাওয়া পরিত্যাগ করেছে বছর তিনেক সম্পূর্ণভাবে। কিন্তু ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ তো খবর রাখেন, পত্রপত্রিকায় লেখেন। ১২ নভেম্বর দি ডেইলি স্টার-এ তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল, ‘দি রাইজ অব দি মিডিল ক্লাস’ অর্থাৎ মধ্যবিত্তের উত্থান।
এই ঈদের মৌসুমে আমাদের আশপাশের দেশে যাওয়ার জন্য নাকি প্লেনের টিকিট নেই। গত রোজায় বড় বড় সব হোটেলে ইফতার খেতে গিয়ে ভিড়ের চোটে অনেকেই রোজা দীর্ঘায়িত করে ফিরে গেছেন।
আমার ছোটবেলার বন্ধু যাদের ফিটফাট স্টাইল মার্কা কাপড়ের দোকান অথবা ফ্রিজ, টেলিভিশন, তারা অনেক আগে থেকেই মফস্বল শহরে দোকান খুলে কূল পাচ্ছে না।
মধ্যবিত্ত কে, অর্থাৎ আয়ের পরিমাণ কী, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী, সামাজিক এবং ক্ষমতার বলয়ে সে কোথায়, শিক্ষা-দীক্ষা বা পেশা কী হতে হবে ইত্যাদি বহু প্রশ্ন-তত্ত্ব এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সাদামাটাভাবে একটা উত্তর দেওয়া যায়—কাজে বা ঈদে-পরবে যে লক্কড়ঝক্কড় লোকাল বাসে না উঠে একটু বেশি পয়সা খরচ করে ভালো বাসে যেতে পারে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য বাড়তি কিছু খরচ করতে পারে, ঈদে পছন্দ হলে একটার জায়গায় দুই সেট কাপড় কিনতে পারে। এসব ন্যূনতম শর্ত। এর ওপরে যারা অর্থাৎ গাড়ি আছে, বাড়ি না থাকলেও বাসায় মোটামুটি ভালো ফ্রিজ, টেলিভিশন আছে, ঈদে নিজের পরিবারের বাইরে আত্মীয় ও মাঝেমধ্যে অসচ্ছল পাড়া-প্রতিবেশীর জন্যও কাপড় কিনতে পারে। জনাপ্রতি লাখ তিনেক টাকা খরচ করে যে প্রায় লাখ খানেক বাঙালি এবার হজে গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই সাদামাটাভাবে মধ্যবিত্তের কাতারভুক্ত।
এ রকম মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা কত লাখ হবে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে অনেক লাখ যে হবে, তা নিয়ে নিশ্চয় বিতর্ক নেই।
৩.
মামুন রশীদের মতো আমারও ধারণা, এ দেশে এখন মধ্যবিত্তের একটা উত্থান হচ্ছে। সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি অনেক বাড়ছে। এই বৃদ্ধিমান সংখ্যাটা আমাদের রাজনীতি অতি শিগগিরই বিরাট পরিবর্তন বাধ্য করবে। কারণ ‘মধ্যবিত্ত’ শুধু টাকা-পয়সার হিসাবের ব্যাপার না। পুরোনো মার্ক্সীয় ধারণায় এবং সে ধারণার সঙ্গে খুব বেশি লোক যে তর্ক জুড়ে দেয়, তাও না—টাকা-পয়সা অর্থাৎ আর্থিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে মন-মানসিকতার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক উৎপাদন ব্যবস্থায় কী ধরনের অবস্থান ইত্যাদি তত্ত্বের কচকচানিতে না জড়িয়ে সাদামাটাভাবে যেটা অনস্বীকার্য, তা হলো মধ্যবিত্তের উত্থানের পরিণতিতে বা ফলে মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের ব্যাপ্তি ঘটবে। পুরো সমাজের মূল্যবোধের ওপর মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের প্রভাব পড়বে এবং শেষতক মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ সমাজের প্রধানতম বা প্রভাবশালী মূল্যবোধে পরিণত হবে।
এখানে সব ধরনের মূল্যবোধের কথা আনছি না। টার্গেট রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং আইনের শাসনের আকাঙ্ক্ষা। গণতন্ত্র, পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর আইনের শাসন—এটা মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ। সমাজে মধ্যবিত্ত কমবেশি সব সময়ই ছিল। পরিচ্ছন্ন, জনহিতকর রাজনীতি আর আইনের শাসনের সপক্ষের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধও ছিল। কিন্তু অতীতে—ধরুন, নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল অল্প কয়েক লাখ। ফলে তাদের মূল্যবোধ সমাজের প্রভাবশালী বা প্রধান মূল্যবোধ হয়ে উঠতে পারেনি।
ভারতের রাজনীতিতে সামরিক শাসন ছিল না, উর্দি পরারা আসতে পারেনি আর পাকিস্তান-বাংলাদেশে ঘনঘন এসেছে—অনেক সময় প্রচ্ছন্ন জনসমর্থনে—তার অন্যতম প্রধান কারণ ১৯৫০-এর দশক থেকেই ভারতীয় রাজনৈতিক মূল্যবোধের আঙিনায় ভারতীয় মধ্যবিত্তের আইনের শাসনের প্রতি যে সমর্থন ছিল, উর্দিওয়ালারা তা আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর বাধ্য হয়েছে এ জন্যই যে স্বাধীনতার পরপর ভারতে যে বিশাল মধ্যবিত্ত ছিল, তাদের মূল্যবোধ পুরো দেশ বা জাতির মূল্যবোধকে ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত করে।
গত ১০ বছরে ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকায় যে সারি সারি গাদাগাদি করে লাইন ধরে পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, সেটা কলকাতায় হয়েছে বহু আগে।
মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক মূল্যবোধ কী, এটা সাদা না কালো, ভালো না মন্দ, স্বার্থন্বেষী না পরোপকারী, নিজের আখের গোছানো না অন্যকে সাহায্য করা ইত্যাদি অনেক যথার্থ প্রশ্ন সহজেই উঠতে পারে। ওসবে না গিয়ে এক কথায় বলব—মধ্যবিত্ত চায় নিয়মতান্ত্রিক পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর আইনের শাসনের প্রতি হান্ড্রেড পারসেন্ট না হলেও বেশ পাকাপোক্ত সমীহা।
মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের এই যে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশার ধোপে আমাদের আজকের রাজনীতি টিকছে না।
বর্তমান রাজনীতি পঙ্কিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ, আখের গোছানোর রাজনীতি। নিজের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির রাজনীতি। আগে রাজনীতি-গণতন্ত্র মানে ছিল পাঁচ বছর পরপর একবার ভোট দেওয়া। দরিদ্র, শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া খেটে খাওয়া মানুষের অনেকের জন্য এ ভোট দেওয়াই গণতন্ত্র। কিন্তু পাঁচ বছরে একবার ভোট দিয়ে মধ্যবিত্ত গণতন্ত্র-রাজনীতি ভুলে যায় না।
প্রতিদিন জাতীয় পত্রিকার অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণ করা মধ্যবিত্তের সংখ্যা অনেক, অনেক হাজার। এরা প্রতিদিনই রাজনীতি করছে।
সব পত্রিকার অনলাইন জরিপের প্রশ্নগুলো মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের ক্রমাগত প্রথম অবস্থানও এই মূল্যবোধের প্রতিফলন।
মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রচুর দুর্নীতিবাজ, ভেজালবাজ, ঠগবাজ আছে। কিন্তু চুরি-ঘুষ-দুর্নীতি করে মোটামুটি একটা ফ্ল্যাট বা একখণ্ড জমি কিনে মধ্যবিত্তের খাতায় নাম লেখালে সে ‘ভদ্র’ হতে চায়। অন্তত চায়, তার ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল-কলেজে পড়ুক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও সস্তায়-মস্তায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রি হোক।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল বা সেশনজট হলো কি না তা নিয়ে দরিদ্র কৃষকের মাথাব্যথা নেই। মধ্যবিত্তের আছে। ২০ বছর আগে সারা দেশে শহুরে অর্থাৎ শহর এলাকায় বাস করা লোকের সংখ্যা ছিল লাখ বিশেক। এখন দুই কোটি ছুঁই ছুঁই করছে। হরতাল হলে গ্রামের লোকের কিছু যায়-আসে না, তাদের কৃষিকাজ, মাছধরা, নৌকা চালানো ব্যাহত হয় না। এখন সারা দেশে হরতাল হলে প্রায় দুই কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪.
বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং সে সঙ্গের ঘটনাগুলো যে পঙ্কিল রাজনীতি আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, তাতে মধ্যবিত্তের নাখোশ হওয়া আরও বেড়েছে। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তাদের অতীতমুখী প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে যে বেরোতে পারবে না, সেটা আরও স্পষ্ট, অনেকটা ধ্রুব সত্যের মতো ঠেকছে।
মধ্যবিত্ত চায় ভবিষ্যতের রাজনীতি, উন্নয়নের রাজনীতি, আইনের শাসনে পরিচালিত গণতন্ত্র। বাজিকরের রাজনীতি শেষপ্রায়। এখন এই মূল্যবোধের সপক্ষের মধ্যবিত্তের সংখ্যা অনেক অনেক বেড়েছে। বলা বাহুল্য, মধ্যবিত্ত মানেই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটাও সত্য যে মধ্যবিত্তই সব সমাজে সুস্থ, ভালো, মানবিক ও পরোপকারী চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক।
এই মধ্যবিত্তের কাছে ক্রমান্বয়ে মনে হচ্ছে বর্তমান রাজনীতি পঙ্কিলতা আর প্রতিহিংসায় আচ্ছন্ন। নিঃসন্দেহে দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ আছেন অনেক। কিন্তু প্রায় প্রতিটি দলে তাঁরা সংখ্যালঘু। এখন মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ অনুধাবন করে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনহিতকর রাজনীতির দিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যত জলদি মোড় নিতে পারে, ততই মঙ্গল। তবে এটা বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে হবে বলে বিশ্বাস দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
বিকল্প দুটো। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ দিনের ধ্যান-ধারণা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন। অথবা নতুন দল বা নেতৃত্ব সৃষ্টি। দুটোর কোনোটাই একদিনে বা এক বছরে হবে না। তবে বছর বছর ধরেও অপেক্ষা করতে হবে না। অন্য দুটো বিকল্প—সামরিক শাসন ও ধর্মীয় রাজনীতি—বাংলাদেশে এ ধরনের পরিবর্তন খুবই কঠিন হবে। মধ্যবিত্ত ধার্মিক, কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। মধ্যবিত্তের জন্য ধর্ম ইহ এবং পরজাগতিক। কিন্তু রাজনীতি-সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি ইহজাগতিক, পরজাগতিক চিন্তা-কল্পনা-আশা-দুঃস্বপ্ন তাদের সমাজ-রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করে না। বাঘ এল, বাঘ এল চিৎকার করা রাখাল বালকের মতো অনেকেই নিশ্চয় ধর্ম গেল, ইসলাম গেল গেল বলে বাজার গরম করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বেশি হলে আর এক দশক, ভোট মেলেনি গত নির্বাচনে, মিলবে না আগামী নির্বাচনেও।
আইন-আদালতে রাজনীতি ঢুকে গেছে, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, এমনকি রায় কেনা যায় বলে আমরা যতই উৎকণ্ঠিত হই না কেন, মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের চাপে এসব ঠিক হতে বাধ্য। ঠিক হতে কিছুটা দেরি হলে, আইনের শাসন বিন্দুমাত্র নেই, অর্থাৎ সামরিক জান্তার ক্ষমতা নেওয়ার বিষয়টিও এখন আর আগের মতো সহজ হবে না।
যারা বাড়ি ছাড়া করে, অথবা যারা বাড়ি রাখার রাজনীতি করে, তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে যে আমরা ত্যাক্ত-বিরক্ত। আপনাদের কোনো কথাতেই আর আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। আমরা বদলেছি, বদলাচ্ছি। আপনারাও বদলান। নতুবা আমাদের আস্থা সোপর্দ করব অন্য কোথাও।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
No comments