যুক্তি তর্ক গল্প-নেতিবাচক বাস্তবতার প্রতিষেধক ইতিবাচক অভিজ্ঞতা by আবুল মোমেন
আমাদের সমাজে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার নানা রকম প্রকাশ ঘটছে। এসিড-সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও সাম্প্রতিককালের ইভ টিজিং—সবই নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের সহিংসতার প্রকাশ। তার মধ্যে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করার ঘটনাই সবচেয়ে পুরোনো ও ব্যাপক।
নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিষয়ে সমাজ ও সরকারের সচেতনতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। সমাজের নানা স্তর থেকে এসবের বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আর সরকার আইন এবং তার প্রয়োগ কঠোরতর করে সমস্যার মোকাবিলা করতে চাইছে। মনে হচ্ছে, সব মহলেরই আন্তরিকতা আছে।
তবে এ সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক, মনোদৈহিক ও মনোসামাজিক প্রেক্ষাপট বেশ জটিল এবং তা বোঝা ও বিবেচনায় রাখা দরকার। এ নিয়ে মোহিত উল আলম চমৎকার ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তাঁর ইভ টিজিং নিয়ে দ্বিতীয় লেখাটিতে—ইভ টিজিং নিয়ে আরও কিছু কথা (প্রথম আলো, ৮ নভেম্বর ২০১০)।
আমাদের অনেক সমস্যাই আসলে রোগের লক্ষণ, যার বাড়াবাড়ির চোটে রোগ চাপা পড়ে যায়। আমরা যখন বলি দুর্নীতি, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, নারী নির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি তখন রোগ ও লক্ষণ গুলিয়ে ফেলি। লক্ষণের চিকিৎসা প্রয়োজন, যেমন জ্বরের জন্য ওষুধ দিতে হয়। বাড়াবাড়ি রকমের দেখা দিলে, তার জন্য কড়া ডোজের ওষুধও দিতে হয়। ফলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কড়া আইন, কড়া শাসন নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তাতে রোগের হাত থেকে নিস্তার পাব না। সাময়িকভাবে উপশম হতে পারে, কিন্তু অন্য নানাভাবে এর প্রকাশ ঘটবে, ঘটতেই থাকবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কঠোর অবস্থান, কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা ও প্রায় নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতির নিরিখেই আইনি ব্যবস্থার উদ্যোগ থেকে আমরা এখন সরে এসেছি। বলা যায়, দুর্নীতির সঙ্গে আপসের পুরোনো চিরাচরিত পথেই ফিরে এসেছি। এর কারণ সহজ ও সোজা।
আমাদের সমাজে, বিশেষত রাজনীতি ও প্রশাসনে, দুর্নীতির চাহিদা রয়েছে, দুর্নীতিবাজের যথেষ্ট মূল্য আছে। সবারই এসব জানা, তবুও মনে করিয়ে না দিলে চলে না।
সবাই জানে, আমাদের সমাজে যেকোনো কাজ, তা নির্বাচনে ভোট বা বিজয় হোক, কিংবা সরকারি দপ্তরে ফাইল নিষ্পন্ন (কাজ সম্পন্ন) করাই হোক, সেটা আদতে ‘আদায়’ করে নেওয়ার ব্যাপার। কোনো কাজ তার নিজস্ব নিয়মে ও নিয়মিত গতিতে যথাযথ পরিণতি পায় না, পেছনে লেগে থেকে তা ‘আদায়’ করে নিতে হয়। আমাদের সমাজে প্রবাদ আছে, ‘না কাঁদলে মা-ও শিশুকে দুধ দেয় না।’ বোধ করি, সমাজের সর্বত্র সব কাজেই এ কথা খাটে। আর খাটে বলেই এ প্রবাদের উৎপত্তি। এখানকার কর্মসংস্কৃতি (বা কর্মের অপসংস্কৃতি) হচ্ছে, ফাইল চালু করে এটাকে প্রশাসনিক সব ঘাট পার করিয়ে নেওয়ার জন্য পেছনে একজনকে লাগিয়ে দেওয়া। আর যেহেতু এ রকম লেগে থাকা লোকের সংখ্যা অনেক এবং প্রত্যেকের মধ্যে যুগপৎ অনিশ্চয়তার বোধ ও কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগাদা কাজ করে, তাই প্রার্থীদের মধ্যে গোপনে প্রতিযোগিতা শুরু হয় দাপ্তরিক দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলার। সে কাজে টাকাই হচ্ছে মাধ্যম। তাই নতুন যুগের প্রবাদ হচ্ছে, ‘টাকা কথা বলে, টাকাই কাজ করে।’
সরকারি দপ্তরের সাধারণ বাস্তবতা হচ্ছে কাজ বেশি, লোকবল কম এবং দক্ষ লোক হাতেগোনা। তার ওপর আছে যেকোনো ফাইল নিষ্পত্তিতে অনেক কর্মকর্তার অনুমোদন, মন্তব্যের রেওয়াজ। তারপর আছে দায়িত্ব নিজের কাঁধে না নেওয়া এবং দায়িত্ব এড়ানোর সংস্কৃতি। সব মিলে সাধারণভাবেই এখানে কাজের গতি মন্থর, অনেক সময় সামান্য একটি অনুমোদনে দীর্ঘ কালক্ষেপণের ফলে ব্যক্তির বা সরকারের কোটি টাকার ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে; কিন্তু সেদিকে কেউই ভ্রুক্ষেপ করে না।
আমাদের সমাজে কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন। কথাটা সত্যি, কিন্তু কথাটার অর্থ হলো, আমরা অন্যরা তাঁর মতো নই, বখাটেকে ভয় পাই, তার সঙ্গে আপস করে চলি। যদি কলেজশিক্ষক মিজানের কলেজের অধ্যক্ষসহ সব শিক্ষক মেয়েটির (এবং মেয়েদের) পাশে থেকে বখাটেটির (এবং বখাটেদের) বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন, তাহলে সম্ভবত বখাটের দৌরাত্ম্য মারাত্মক ঘটনা ঘটানোর আগেই থেমে যেত। কিন্তু বখাটেসহ আমরা সবাই কয়েকটি বিষয়ে সন্দিহান—আইন, প্রশাসন, পুলিশ শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের পক্ষে থাকবে কি না; ক্ষমতা ও রাজনীতির পক্ষপাত কোন দিকে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তার কী হবে! এই সংশয়াচ্ছন্ন অনিশ্চিত বাস্তবতায় বখাটে ও দুর্বৃত্ত তার আখের গোছায় আর ন্যায়ের পক্ষের লোক দোলাচলে ভোগে এবং বিবেকতাড়না ভুলে যথাসময়ে সক্রিয় হতে পারে না। পরে বিবেক ও মান বাঁচাতে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করেন মানববন্ধন, সভা-সেমিনারে জোরালো বক্তব্য রেখে। সমাজে পরিবর্তন ঘটছে ঠিকই, কিন্তু এখনো তা মানুষের কাছে এতটা নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে না যে সে অপরাধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেবে এবং তা অপরাধীর শাস্তি পর্যন্ত বজায় রাখবে। এসিড-সন্ত্রাস ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির কিছু ফল পাওয়া গেছে, কিন্তু অপরাধীর বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে ফল আশানুরূপ নয়। কারণ প্রধানত সাক্ষীর সাহস ও আগ্রহ বেশি দিন থাকে না। বিশেষত অপরাধী পক্ষের নিরন্তর চাপ-হুমকির বিপক্ষে কেবল ন্যায়ের পক্ষে ভূমিকার জন্য ঝুঁকিটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক বেশি বলে মনে হতে পারে। সাক্ষীকে খুন করে বাকি সাক্ষীদের (বলা যায় সাক্ষী সাধারণের) কাছে বারতা পৌঁছে দেওয়ার ঘটনা এ দেশে কম ঘটেনি।
দুর্নীতির ক্ষেত্রে আপস আরও ব্যাপক ও গভীর। এ সমাজে এমন মান্যবর ব্যক্তি প্রচুর, যাঁরা একদিকে দুর্নীতির রাঘব-বোয়াল, অন্যদিকে দানে-ধ্যানে ‘মহৎ’ ব্যক্তি। ব্যবসা ও রাজনীতিতে এ রকম হাঁসজারুরাই তো সংখ্যায় বেশি ও সফল। আর এদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এটা একটা খিচুড়ি সমাজে—যেখানে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ একাকার হয়ে যায়, পরিণত হচ্ছে।
খুলে বললে কথাটা এ রকম দাঁড়ায়। আমরা যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, নারীর সমানাধিকার ইত্যাদি চাহিদাপত্র তৈরি করেছি, তা পশ্চিমের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ থেকে নেওয়া। ওখানে চতুর্দশ শতাব্দী থেকে কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত সমাজ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। রেনেসাঁস, এনলাইটেনমেন্ট, শিল্প বিপ্লব পরপর এ ঘটনাগুলো ইউরোপে ঘটে গেছে প্রায় ৬০০ বছর ধরে। এর ফলে এখানে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও যাজকতন্ত্রের আধিপত্য গিয়ে সাধারণ ব্যক্তি নাগরিকের উত্থান ঘটে। প্রথা-সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে আইনই সমাজ পরিচালনায় নির্ধারকের ভূমিকা নেয়। বংশগত আভিজাত্যের দিন শেষ হয়ে শ্রম ও মেধার মূল্যে সমাজে ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয় হতে থাকে। আমাদের এখানে ইউরোপের মতো কঠিন সামন্তপ্রথা না থাকলেও সমাজের মধ্যে মজ্জাগত সামন্ত মনোভাব বা বিকৃত সামন্ত মনোভাব কিছুতেই তাড়াতে পারছি না আমরা। এখনো ভূমির মালিক ও কৃষক, চাকরিদাতা ও চাকুরে, ধনী ও দরিদ্রে, উচ্চপদস্থ ও অধীনে, কর্মকর্তা ও প্রার্থীতে, বিচারক ও বিচারপ্রার্থীতে, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুতে, পুরুষ ও নারীতে নানা মাত্রায় প্রভু ও প্রজার সম্পর্ক বিরাজ করছে। রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা—সমাজ নির্মাণ ও পরিবর্তনের এই তিন এজেন্ট এ ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করছে না। কেউ শিক্ষার মাধ্যমে নারীর স্বাধীনতার প্রতি অনুকূল হচ্ছে তো কেউ নারীকে কঠোরভাবে অধীন করে রাখার শিক্ষা পাচ্ছে, কারও পারিবারিক আবহ ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে তো কারও অবস্থান অসহিষ্ণু বিপক্ষতায়।
এ সমাজে সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তি হচ্ছে মুসলিম ধনী উচ্চশিক্ষিত ক্ষমতাবান (চাকরি বা রাজনীতির সূত্রে) নাগরিক পুরুষ। বিপরীতে সবচেয়ে দুর্বল হচ্ছে, গ্রামের অমুসলিম নিরক্ষর, দরিদ্র বিধবা নারী। এই দুই মেরুর বিপরীতে ক্ষমতার বিবেচনায় অসংখ্য স্তর রয়েছে।
আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বস্তুত সমতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অসম সমাজ অনবরত অবিচার, অন্যায় সৃষ্টি করে চলে। তারই একটি হচ্ছে ইভ টিজিং।
আইন ও পুলিশ নারী উত্ত্যক্তকারীদের উৎপাত প্রশমিত করতে পারবে, কিন্তু ধ্বংস করতে পারবে না। বরং ঠিক ভাইরাসের মতোই অব্যর্থ ওষুধ প্রয়োগ করা না হলে দ্বিগুণ ধ্বংসাত্মক শক্তি নিয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে পুনরায় ভাইরাসটি আবির্ভূত হবে।
শেষ করি নিজের একটি কথা বলে। ইভ টিজিংয়ে যখন ‘রমরমা’ চলছে (ক্ষমা করবেন পাঠক এভাবে বলার জন্য), তখন এক এনজিও কর্তা বললেন, আমাদের তো কিছু একটা করতে হয়। আমি বললাম, কী করবেন? তিনি বললেন, এই মানববন্ধন, শোভাযাত্রা, সচেতনতামূলক সভা আর কি। আমি বললাম, ওই বাজেটটা আমাকে দিন, আমি ১০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে দিনব্যাপী একটি ক্যাম্প করব। সেখানে কোনো আদেশ-নির্দেশের পথ না ধরে ওদের দলে মিলে নানা রকম কাজ করার এবং ইতিবাচক মানবিক অর্জনের কথা শোনার সুযোগ করে দেব। দিনশেষে ওরা নাটক করবে, গাইবে, দেয়াল পত্রিকা করবে, অনেক মনীষীকে জানবে।
এভাবে সবচেয়ে বড় দুটি প্রাপ্তি হবে—জীবনের জন্য স্মরণীয় একটি দিনের স্মৃতি এবং তরুণরা তরুণীদের সঙ্গে ও তরুণীরা তরুণদের সঙ্গে শালীনতা-শোভনতার মধ্যে সৃজনশীল সক্রিয়তায় দিন কাটানোর আনন্দ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। এ থেকে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুদল তৈরি হতে পারে। এটাই পথ, কেননা একমাত্র ইতিবাচক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নেতিবাচক বাস্তবতাকে দূর করা ও জয় করা যাবে। এড়িয়ে, গোপনে, লুকিয়ে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে স্বাভাবিক ইতিবাচক অর্জন সম্ভব নয়। অস্বাভাবিক শান্তি টেকসই হয় না।
ছেলে ও মেয়েদের পৃথক করে, তাদের মধ্যে অপরাধী ও ভিকটিমের সম্পর্ক দাঁড় করিয়ে এবং এক পক্ষের যাত্রাপথে আইন-পুলিশ ও বিধিনিষেধের কাঁটা ছড়িয়ে নিরাপত্তা কিংবা স্বাভাবিকতার তথা সুষ্ঠু জীবন বিকাশের দেখা মিলবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
তবে এ সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক, মনোদৈহিক ও মনোসামাজিক প্রেক্ষাপট বেশ জটিল এবং তা বোঝা ও বিবেচনায় রাখা দরকার। এ নিয়ে মোহিত উল আলম চমৎকার ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তাঁর ইভ টিজিং নিয়ে দ্বিতীয় লেখাটিতে—ইভ টিজিং নিয়ে আরও কিছু কথা (প্রথম আলো, ৮ নভেম্বর ২০১০)।
আমাদের অনেক সমস্যাই আসলে রোগের লক্ষণ, যার বাড়াবাড়ির চোটে রোগ চাপা পড়ে যায়। আমরা যখন বলি দুর্নীতি, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, নারী নির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি তখন রোগ ও লক্ষণ গুলিয়ে ফেলি। লক্ষণের চিকিৎসা প্রয়োজন, যেমন জ্বরের জন্য ওষুধ দিতে হয়। বাড়াবাড়ি রকমের দেখা দিলে, তার জন্য কড়া ডোজের ওষুধও দিতে হয়। ফলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কড়া আইন, কড়া শাসন নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তাতে রোগের হাত থেকে নিস্তার পাব না। সাময়িকভাবে উপশম হতে পারে, কিন্তু অন্য নানাভাবে এর প্রকাশ ঘটবে, ঘটতেই থাকবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কঠোর অবস্থান, কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা ও প্রায় নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতির নিরিখেই আইনি ব্যবস্থার উদ্যোগ থেকে আমরা এখন সরে এসেছি। বলা যায়, দুর্নীতির সঙ্গে আপসের পুরোনো চিরাচরিত পথেই ফিরে এসেছি। এর কারণ সহজ ও সোজা।
আমাদের সমাজে, বিশেষত রাজনীতি ও প্রশাসনে, দুর্নীতির চাহিদা রয়েছে, দুর্নীতিবাজের যথেষ্ট মূল্য আছে। সবারই এসব জানা, তবুও মনে করিয়ে না দিলে চলে না।
সবাই জানে, আমাদের সমাজে যেকোনো কাজ, তা নির্বাচনে ভোট বা বিজয় হোক, কিংবা সরকারি দপ্তরে ফাইল নিষ্পন্ন (কাজ সম্পন্ন) করাই হোক, সেটা আদতে ‘আদায়’ করে নেওয়ার ব্যাপার। কোনো কাজ তার নিজস্ব নিয়মে ও নিয়মিত গতিতে যথাযথ পরিণতি পায় না, পেছনে লেগে থেকে তা ‘আদায়’ করে নিতে হয়। আমাদের সমাজে প্রবাদ আছে, ‘না কাঁদলে মা-ও শিশুকে দুধ দেয় না।’ বোধ করি, সমাজের সর্বত্র সব কাজেই এ কথা খাটে। আর খাটে বলেই এ প্রবাদের উৎপত্তি। এখানকার কর্মসংস্কৃতি (বা কর্মের অপসংস্কৃতি) হচ্ছে, ফাইল চালু করে এটাকে প্রশাসনিক সব ঘাট পার করিয়ে নেওয়ার জন্য পেছনে একজনকে লাগিয়ে দেওয়া। আর যেহেতু এ রকম লেগে থাকা লোকের সংখ্যা অনেক এবং প্রত্যেকের মধ্যে যুগপৎ অনিশ্চয়তার বোধ ও কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগাদা কাজ করে, তাই প্রার্থীদের মধ্যে গোপনে প্রতিযোগিতা শুরু হয় দাপ্তরিক দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলার। সে কাজে টাকাই হচ্ছে মাধ্যম। তাই নতুন যুগের প্রবাদ হচ্ছে, ‘টাকা কথা বলে, টাকাই কাজ করে।’
সরকারি দপ্তরের সাধারণ বাস্তবতা হচ্ছে কাজ বেশি, লোকবল কম এবং দক্ষ লোক হাতেগোনা। তার ওপর আছে যেকোনো ফাইল নিষ্পত্তিতে অনেক কর্মকর্তার অনুমোদন, মন্তব্যের রেওয়াজ। তারপর আছে দায়িত্ব নিজের কাঁধে না নেওয়া এবং দায়িত্ব এড়ানোর সংস্কৃতি। সব মিলে সাধারণভাবেই এখানে কাজের গতি মন্থর, অনেক সময় সামান্য একটি অনুমোদনে দীর্ঘ কালক্ষেপণের ফলে ব্যক্তির বা সরকারের কোটি টাকার ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে; কিন্তু সেদিকে কেউই ভ্রুক্ষেপ করে না।
আমাদের সমাজে কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন। কথাটা সত্যি, কিন্তু কথাটার অর্থ হলো, আমরা অন্যরা তাঁর মতো নই, বখাটেকে ভয় পাই, তার সঙ্গে আপস করে চলি। যদি কলেজশিক্ষক মিজানের কলেজের অধ্যক্ষসহ সব শিক্ষক মেয়েটির (এবং মেয়েদের) পাশে থেকে বখাটেটির (এবং বখাটেদের) বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন, তাহলে সম্ভবত বখাটের দৌরাত্ম্য মারাত্মক ঘটনা ঘটানোর আগেই থেমে যেত। কিন্তু বখাটেসহ আমরা সবাই কয়েকটি বিষয়ে সন্দিহান—আইন, প্রশাসন, পুলিশ শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের পক্ষে থাকবে কি না; ক্ষমতা ও রাজনীতির পক্ষপাত কোন দিকে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তার কী হবে! এই সংশয়াচ্ছন্ন অনিশ্চিত বাস্তবতায় বখাটে ও দুর্বৃত্ত তার আখের গোছায় আর ন্যায়ের পক্ষের লোক দোলাচলে ভোগে এবং বিবেকতাড়না ভুলে যথাসময়ে সক্রিয় হতে পারে না। পরে বিবেক ও মান বাঁচাতে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করেন মানববন্ধন, সভা-সেমিনারে জোরালো বক্তব্য রেখে। সমাজে পরিবর্তন ঘটছে ঠিকই, কিন্তু এখনো তা মানুষের কাছে এতটা নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে না যে সে অপরাধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেবে এবং তা অপরাধীর শাস্তি পর্যন্ত বজায় রাখবে। এসিড-সন্ত্রাস ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির কিছু ফল পাওয়া গেছে, কিন্তু অপরাধীর বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে ফল আশানুরূপ নয়। কারণ প্রধানত সাক্ষীর সাহস ও আগ্রহ বেশি দিন থাকে না। বিশেষত অপরাধী পক্ষের নিরন্তর চাপ-হুমকির বিপক্ষে কেবল ন্যায়ের পক্ষে ভূমিকার জন্য ঝুঁকিটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক বেশি বলে মনে হতে পারে। সাক্ষীকে খুন করে বাকি সাক্ষীদের (বলা যায় সাক্ষী সাধারণের) কাছে বারতা পৌঁছে দেওয়ার ঘটনা এ দেশে কম ঘটেনি।
দুর্নীতির ক্ষেত্রে আপস আরও ব্যাপক ও গভীর। এ সমাজে এমন মান্যবর ব্যক্তি প্রচুর, যাঁরা একদিকে দুর্নীতির রাঘব-বোয়াল, অন্যদিকে দানে-ধ্যানে ‘মহৎ’ ব্যক্তি। ব্যবসা ও রাজনীতিতে এ রকম হাঁসজারুরাই তো সংখ্যায় বেশি ও সফল। আর এদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এটা একটা খিচুড়ি সমাজে—যেখানে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ একাকার হয়ে যায়, পরিণত হচ্ছে।
খুলে বললে কথাটা এ রকম দাঁড়ায়। আমরা যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, নারীর সমানাধিকার ইত্যাদি চাহিদাপত্র তৈরি করেছি, তা পশ্চিমের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ থেকে নেওয়া। ওখানে চতুর্দশ শতাব্দী থেকে কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত সমাজ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। রেনেসাঁস, এনলাইটেনমেন্ট, শিল্প বিপ্লব পরপর এ ঘটনাগুলো ইউরোপে ঘটে গেছে প্রায় ৬০০ বছর ধরে। এর ফলে এখানে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও যাজকতন্ত্রের আধিপত্য গিয়ে সাধারণ ব্যক্তি নাগরিকের উত্থান ঘটে। প্রথা-সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে আইনই সমাজ পরিচালনায় নির্ধারকের ভূমিকা নেয়। বংশগত আভিজাত্যের দিন শেষ হয়ে শ্রম ও মেধার মূল্যে সমাজে ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয় হতে থাকে। আমাদের এখানে ইউরোপের মতো কঠিন সামন্তপ্রথা না থাকলেও সমাজের মধ্যে মজ্জাগত সামন্ত মনোভাব বা বিকৃত সামন্ত মনোভাব কিছুতেই তাড়াতে পারছি না আমরা। এখনো ভূমির মালিক ও কৃষক, চাকরিদাতা ও চাকুরে, ধনী ও দরিদ্রে, উচ্চপদস্থ ও অধীনে, কর্মকর্তা ও প্রার্থীতে, বিচারক ও বিচারপ্রার্থীতে, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুতে, পুরুষ ও নারীতে নানা মাত্রায় প্রভু ও প্রজার সম্পর্ক বিরাজ করছে। রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা—সমাজ নির্মাণ ও পরিবর্তনের এই তিন এজেন্ট এ ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করছে না। কেউ শিক্ষার মাধ্যমে নারীর স্বাধীনতার প্রতি অনুকূল হচ্ছে তো কেউ নারীকে কঠোরভাবে অধীন করে রাখার শিক্ষা পাচ্ছে, কারও পারিবারিক আবহ ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে তো কারও অবস্থান অসহিষ্ণু বিপক্ষতায়।
এ সমাজে সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তি হচ্ছে মুসলিম ধনী উচ্চশিক্ষিত ক্ষমতাবান (চাকরি বা রাজনীতির সূত্রে) নাগরিক পুরুষ। বিপরীতে সবচেয়ে দুর্বল হচ্ছে, গ্রামের অমুসলিম নিরক্ষর, দরিদ্র বিধবা নারী। এই দুই মেরুর বিপরীতে ক্ষমতার বিবেচনায় অসংখ্য স্তর রয়েছে।
আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বস্তুত সমতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অসম সমাজ অনবরত অবিচার, অন্যায় সৃষ্টি করে চলে। তারই একটি হচ্ছে ইভ টিজিং।
আইন ও পুলিশ নারী উত্ত্যক্তকারীদের উৎপাত প্রশমিত করতে পারবে, কিন্তু ধ্বংস করতে পারবে না। বরং ঠিক ভাইরাসের মতোই অব্যর্থ ওষুধ প্রয়োগ করা না হলে দ্বিগুণ ধ্বংসাত্মক শক্তি নিয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে পুনরায় ভাইরাসটি আবির্ভূত হবে।
শেষ করি নিজের একটি কথা বলে। ইভ টিজিংয়ে যখন ‘রমরমা’ চলছে (ক্ষমা করবেন পাঠক এভাবে বলার জন্য), তখন এক এনজিও কর্তা বললেন, আমাদের তো কিছু একটা করতে হয়। আমি বললাম, কী করবেন? তিনি বললেন, এই মানববন্ধন, শোভাযাত্রা, সচেতনতামূলক সভা আর কি। আমি বললাম, ওই বাজেটটা আমাকে দিন, আমি ১০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে দিনব্যাপী একটি ক্যাম্প করব। সেখানে কোনো আদেশ-নির্দেশের পথ না ধরে ওদের দলে মিলে নানা রকম কাজ করার এবং ইতিবাচক মানবিক অর্জনের কথা শোনার সুযোগ করে দেব। দিনশেষে ওরা নাটক করবে, গাইবে, দেয়াল পত্রিকা করবে, অনেক মনীষীকে জানবে।
এভাবে সবচেয়ে বড় দুটি প্রাপ্তি হবে—জীবনের জন্য স্মরণীয় একটি দিনের স্মৃতি এবং তরুণরা তরুণীদের সঙ্গে ও তরুণীরা তরুণদের সঙ্গে শালীনতা-শোভনতার মধ্যে সৃজনশীল সক্রিয়তায় দিন কাটানোর আনন্দ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। এ থেকে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুদল তৈরি হতে পারে। এটাই পথ, কেননা একমাত্র ইতিবাচক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নেতিবাচক বাস্তবতাকে দূর করা ও জয় করা যাবে। এড়িয়ে, গোপনে, লুকিয়ে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে স্বাভাবিক ইতিবাচক অর্জন সম্ভব নয়। অস্বাভাবিক শান্তি টেকসই হয় না।
ছেলে ও মেয়েদের পৃথক করে, তাদের মধ্যে অপরাধী ও ভিকটিমের সম্পর্ক দাঁড় করিয়ে এবং এক পক্ষের যাত্রাপথে আইন-পুলিশ ও বিধিনিষেধের কাঁটা ছড়িয়ে নিরাপত্তা কিংবা স্বাভাবিকতার তথা সুষ্ঠু জীবন বিকাশের দেখা মিলবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments