বহে কাল নিরবধি-নিজ চালিকাশক্তিতেই ইন্দোনেশিয়ার উত্থান by এম আবদুল হাফিজ
২০১১ সালে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং ইউধোইয়োনো যখন তাঁর মেয়াদের মধ্যপথে এসবিওয়াই (দেশবাসী প্রদত্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত নাম) বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাফল্যের একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
১৯৯৮ সালে সুহার্তোর স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্বের অবসান হলে একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে উপনীত দেশটি ছিল প্রায় পতনোন্মুখ। সেই অবস্থা থেকে ইন্দোনেশিয়া ভীতিকর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিঘ্ন অতিক্রম করেছে, যেখানে উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যত্র অনেক দেশই মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
সেই ব্যর্থতা তো দূরের কথা, ইন্দোনেশিয়া আন্তর্জাতিক ক্ষমতার খেলায় অন্তত একটি মধ্যমমানের খেলুড়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইন্দোনেশিয়া এখন বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশ্বের নতুন গন্তব্য এবং ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু দেশ তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় আগ্রহী। তবু সময়ে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক কিছু কিছু সমস্যা দেশটির সামনে চলাকে কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত করে।
২৪ কোটি মানুষের দেশ হিসেবে বিশ্বের এই জনবহুল দেশটি- যার আবার ৯০ শতাংশ লোকই মুসলমান বহির্বিশ্বের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। জনসংখ্যার আধিক্য এবং তাদের ধর্ম একাধিক কারণে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও শুধু এই ফ্যাক্টরগুলোও কিন্তু আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে ইন্দোনেশিয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কুশীলবের স্থান দেয় না। যে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার মধ্যে তারা বাস করে এবং একটি প্রাণবন্ত অর্থনীতি, যা তাদের লালন করে, সেটাই ইন্দোনেশিয়াকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে।
৭০০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিই সর্ববৃহৎ। এই অর্থনীতি আরো স্ফীতি লাভ করেছে একটি উত্তম ম্যাক্রো ইকোনমিক নীতিমালা এবং অভ্যন্তরীণ কনজিউমারিজমের মধ্য দিয়ে। ফলে ২০১০ সালে অর্থনীতি ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে, ২০১১ সালে তা ৬.৫-এ পৌঁছেছে। অতঃপর ২০১২ সালে তা ৬.৬ থেকে ৭.০ শতাংশে স্থিতিশীল হয়। শুধু চীন এবং ভারত ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি 'গ্রুপ অব টুএনটির' অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। উল্লেখ্য, এই গ্রুপে ইন্দোনেশিয়াই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র সদস্য।
ইন্দোনেশিয়ার তেজি অর্থনৈতিক সংশোধন ইন্দোনেশীয়দের মধ্যে ব্রিকের (BRIC) (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনের সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপিং, যা আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবান্বিত করার কথা) শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হওয়ার আশা সঞ্চারক হলেও ইন্দোনেশিয়া নয়, দক্ষিণ আফ্রিকা গ্রুপিংয়ের তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। সে যা-ই হোক, ইন্দোনেশিয়া কি তার অর্থনৈতিক সংশোধনকে অব্যাহত রাখতে পারবে? সে জন্য দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামো এবং শিক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটিই সম্ভবত এসবিওয়াইয়ের তাঁরই অর্থমন্ত্রী ইন্দ্রাবতীর সঙ্গে মতান্তরের কারণ। ২০১০ সালে এই সংস্কারপন্থী অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য আবুরিজাল বাকরির রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী পদক্ষেপ নেন। আসলে ইন্দ্রাবতীর সংঘাতের মূল কারণ ছিল দুর্নীতি, যা রাষ্ট্রীয় ইনস্টিটিউটগুলো বিশেষ করে পুলিশ ও বিচার বিভাগের বিপথগামিতাকে রোধ।
এসবিওয়াইয়ের দ্বিতীয় পাঁচ বছর মেয়াদি প্রেসিডেন্সি শেষ হবে ২০১৪ সালে। সাংবিধানিকভাবেই তিনি আর তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারবেন না। সে জন্য ইতিমধ্যেই কিছুটা গা-ছাড়া ভাব এসে গেছে তাঁর মধ্যে। তা সত্ত্বেও তাঁর বর্তমান প্রেসিডেন্সি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। আরো দুর্ভাগ্য যে তাঁর প্রেসিডেন্সির অন্তিম সিদ্ধান্তগুলো তাঁকে এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পারিপাশ্বর্িকতার মধ্যেই নিতে হবে। এসবিওয়াইকে তাঁর নিজের দল থেকেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী দিতে হবে। সেই মনোনয়নের কাজটিও দুরূহ। এসবিওয়াইকে নিশ্চিত করতে হবে যে মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এমন একজন হবেন, যিনি ইন্দোনেশিয়ার সৃষ্ট জাদু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে পারেন। আরো ধরে রাখতে পারেন জাতীয় উন্নয়ন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও আধুনিকায়িত ইসলাম। এগুলোই হবে ইন্দোনেশিয়ার সফট পাওয়ারের উপাদান, যা প্রেসিডেন্ট এসবিওয়াই ও তাঁর বিদেশমন্ত্রী মার্তি মাতালেগাওয়াকে ইন্দোনেশিয়ার জন্য আরো বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ভূমিকা দাবি করার প্রত্যয় দেবে। অপ্রচলিত নিরাপত্তা বিষয়ে দেশটির নিজস্ব ডকট্রিন রয়েছে। বহুপাক্ষিক ফোরামে ইন্দোনেশিয়া সেগুলোর প্রচার ও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে চায়।
এসবিওয়াই ইন্দোনেশিয়ার জন্য পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে মেলবন্ধনের গুরুদায়িত্ব নিতে চায়। এই সেই ইন্দোনেশিয়া, যাকে প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১০ সালে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলেন। সে সময় ওবামা ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে নতুন এক 'কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপের' ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের মডেল আখ্যায়িত করেছিলেন।
এতদসত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরে কার্যকর সুশাসনের জন্য উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। তা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার আঞ্চলিক বাস্তবতা দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যদিও জাকার্তা তার সফট পাওয়ারের ডানা মেলতে চায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাসঙ্গিকতায় সেই উন্মুক্ত ডানাকে গুটিয়ে নিতে হয়।
১০ সদস্যের আঞ্চলিক সহযোগিতার সংগঠন আশিয়ানে ইন্দোনেশিয়া নিজেকে প্রধান চালিকাশক্তিরূপে দেখে; কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটি তারই প্রস্তাবিত 'আশিয়ান নিরাপত্তা গোষ্ঠী ২০১৫ সালের মধ্যে'- এমন ধারণার পশ্চাতে প্রয়োজনীয় গতিবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০০৩ সালে প্রথমে প্রস্তাবিত এই ধারণার বাস্তবায়ন এখন সুদূরপরাহত মনে হয়।
২০১১ সালে জাকার্তা তার পালা আসার আগেই আশিয়ান চেয়ারম্যানের আসন গ্রহণ করতে চেয়েছিল, যদিও তার পালা আসার তখনো দুই বছর বাকি। ইন্দোনেশিয়া যেহেতু এপেক (APEC) (Asia Pacific Economic Cooperation) সামিটেরও আয়োজন ওই সময়ে করতে যাচ্ছিল এবং একই সময়ে দুটি গুরুদায়িত্ব পালন ভারবহ হবে, তাই ইন্দোনেশিয়ার ওই চেয়ারম্যানশিপের জন্য তাড়াহুড়ো। কিন্তু আশিয়ানের বাকি সদস্যরা তাতে রাজি হয়নি।
এর আগেও মিয়ানমারে অর্থবহ গণতন্ত্রের লক্ষ্যেও ইন্দোনেশিয়ার উদ্যোগ সফল হয়নি। দ্বিপক্ষীয় বা আশিয়ানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটিতে রাজনৈতিক সংস্কারের ইন্দোনেশীয় ধারণাও অগ্রাহ্য হয়। আঞ্চলিক মানবাধিকারের মেকানিজম তৈরির ইন্দোনেশীয় উদ্যোগও ব্যাহত হয়। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার সংঘাত আশিয়ান সংহতির জন্য ক্ষতিকর হলেও ইন্দোনেশিয়া সেখানেও মধ্যস্থতা করতে পারেনি।
একইভাবে চীনের দক্ষিণ চীন সমুদ্রে আক্রমণাত্মক তৎপরতাকে ঠেকাতে এবং এই তৎপরতায় সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনকে সুরক্ষা দিতে আশিয়ান ঐকমত্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে ওই দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়, যা আশিয়ানের ক্রেডিবিলিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আশিয়ানের এখন একমাত্র সান্ত্বনা যে সংগঠনটি পূর্ব এশিয়ার যেকোনো নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রধান পরিচায়ক। যদিও সংগঠনটিতে অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত কোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার মতো সংহতি নেই, ঐকমত্যেরও অভাব।
ইন্দোনেশিয়ার বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও আশিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর ব্যর্থতায় তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আশিয়ানের সম্মিলিত নিরাপত্তা উদ্যোগের সংকট আরো প্রকট হবে, যখন আশিয়ানের ইন্দোনেশীয় চেয়ারম্যানশিপ কম্বোডিয়া ও পরে লাওস ও ব্রুনাইয়ের হাতে চলে যাবে। আশিয়ান চেয়ারম্যানশিপের এই উত্তরাধিকারী দেশগুলোর কোনোটারই ইন্দোনেশীয় শান্তি, সম্প্রীতি ও গণতন্ত্রের আঞ্চলিক ধারণার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই। তখন বরং ইন্দোনেশিয়ার আন্তর্জাতিক মর্যাদাই খানিকটা ক্ষুণ্ন হবে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া এ পর্যন্ত এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে তার আকস্মিক পতন ঘটবে না। তবে ইন্দোনেশিয়ার উত্থানের মূলমঞ্চ তখন আর আশিয়াননির্ভর হবে না।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
সেই ব্যর্থতা তো দূরের কথা, ইন্দোনেশিয়া আন্তর্জাতিক ক্ষমতার খেলায় অন্তত একটি মধ্যমমানের খেলুড়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইন্দোনেশিয়া এখন বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশ্বের নতুন গন্তব্য এবং ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু দেশ তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় আগ্রহী। তবু সময়ে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক কিছু কিছু সমস্যা দেশটির সামনে চলাকে কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত করে।
২৪ কোটি মানুষের দেশ হিসেবে বিশ্বের এই জনবহুল দেশটি- যার আবার ৯০ শতাংশ লোকই মুসলমান বহির্বিশ্বের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। জনসংখ্যার আধিক্য এবং তাদের ধর্ম একাধিক কারণে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও শুধু এই ফ্যাক্টরগুলোও কিন্তু আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে ইন্দোনেশিয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কুশীলবের স্থান দেয় না। যে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার মধ্যে তারা বাস করে এবং একটি প্রাণবন্ত অর্থনীতি, যা তাদের লালন করে, সেটাই ইন্দোনেশিয়াকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে।
৭০০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিই সর্ববৃহৎ। এই অর্থনীতি আরো স্ফীতি লাভ করেছে একটি উত্তম ম্যাক্রো ইকোনমিক নীতিমালা এবং অভ্যন্তরীণ কনজিউমারিজমের মধ্য দিয়ে। ফলে ২০১০ সালে অর্থনীতি ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে, ২০১১ সালে তা ৬.৫-এ পৌঁছেছে। অতঃপর ২০১২ সালে তা ৬.৬ থেকে ৭.০ শতাংশে স্থিতিশীল হয়। শুধু চীন এবং ভারত ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি 'গ্রুপ অব টুএনটির' অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। উল্লেখ্য, এই গ্রুপে ইন্দোনেশিয়াই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র সদস্য।
ইন্দোনেশিয়ার তেজি অর্থনৈতিক সংশোধন ইন্দোনেশীয়দের মধ্যে ব্রিকের (BRIC) (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনের সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপিং, যা আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবান্বিত করার কথা) শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হওয়ার আশা সঞ্চারক হলেও ইন্দোনেশিয়া নয়, দক্ষিণ আফ্রিকা গ্রুপিংয়ের তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। সে যা-ই হোক, ইন্দোনেশিয়া কি তার অর্থনৈতিক সংশোধনকে অব্যাহত রাখতে পারবে? সে জন্য দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামো এবং শিক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটিই সম্ভবত এসবিওয়াইয়ের তাঁরই অর্থমন্ত্রী ইন্দ্রাবতীর সঙ্গে মতান্তরের কারণ। ২০১০ সালে এই সংস্কারপন্থী অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য আবুরিজাল বাকরির রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী পদক্ষেপ নেন। আসলে ইন্দ্রাবতীর সংঘাতের মূল কারণ ছিল দুর্নীতি, যা রাষ্ট্রীয় ইনস্টিটিউটগুলো বিশেষ করে পুলিশ ও বিচার বিভাগের বিপথগামিতাকে রোধ।
এসবিওয়াইয়ের দ্বিতীয় পাঁচ বছর মেয়াদি প্রেসিডেন্সি শেষ হবে ২০১৪ সালে। সাংবিধানিকভাবেই তিনি আর তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারবেন না। সে জন্য ইতিমধ্যেই কিছুটা গা-ছাড়া ভাব এসে গেছে তাঁর মধ্যে। তা সত্ত্বেও তাঁর বর্তমান প্রেসিডেন্সি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। আরো দুর্ভাগ্য যে তাঁর প্রেসিডেন্সির অন্তিম সিদ্ধান্তগুলো তাঁকে এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পারিপাশ্বর্িকতার মধ্যেই নিতে হবে। এসবিওয়াইকে তাঁর নিজের দল থেকেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী দিতে হবে। সেই মনোনয়নের কাজটিও দুরূহ। এসবিওয়াইকে নিশ্চিত করতে হবে যে মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এমন একজন হবেন, যিনি ইন্দোনেশিয়ার সৃষ্ট জাদু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে পারেন। আরো ধরে রাখতে পারেন জাতীয় উন্নয়ন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও আধুনিকায়িত ইসলাম। এগুলোই হবে ইন্দোনেশিয়ার সফট পাওয়ারের উপাদান, যা প্রেসিডেন্ট এসবিওয়াই ও তাঁর বিদেশমন্ত্রী মার্তি মাতালেগাওয়াকে ইন্দোনেশিয়ার জন্য আরো বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ভূমিকা দাবি করার প্রত্যয় দেবে। অপ্রচলিত নিরাপত্তা বিষয়ে দেশটির নিজস্ব ডকট্রিন রয়েছে। বহুপাক্ষিক ফোরামে ইন্দোনেশিয়া সেগুলোর প্রচার ও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে চায়।
এসবিওয়াই ইন্দোনেশিয়ার জন্য পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে মেলবন্ধনের গুরুদায়িত্ব নিতে চায়। এই সেই ইন্দোনেশিয়া, যাকে প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১০ সালে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলেন। সে সময় ওবামা ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে নতুন এক 'কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপের' ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের মডেল আখ্যায়িত করেছিলেন।
এতদসত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরে কার্যকর সুশাসনের জন্য উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। তা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার আঞ্চলিক বাস্তবতা দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যদিও জাকার্তা তার সফট পাওয়ারের ডানা মেলতে চায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাসঙ্গিকতায় সেই উন্মুক্ত ডানাকে গুটিয়ে নিতে হয়।
১০ সদস্যের আঞ্চলিক সহযোগিতার সংগঠন আশিয়ানে ইন্দোনেশিয়া নিজেকে প্রধান চালিকাশক্তিরূপে দেখে; কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটি তারই প্রস্তাবিত 'আশিয়ান নিরাপত্তা গোষ্ঠী ২০১৫ সালের মধ্যে'- এমন ধারণার পশ্চাতে প্রয়োজনীয় গতিবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০০৩ সালে প্রথমে প্রস্তাবিত এই ধারণার বাস্তবায়ন এখন সুদূরপরাহত মনে হয়।
২০১১ সালে জাকার্তা তার পালা আসার আগেই আশিয়ান চেয়ারম্যানের আসন গ্রহণ করতে চেয়েছিল, যদিও তার পালা আসার তখনো দুই বছর বাকি। ইন্দোনেশিয়া যেহেতু এপেক (APEC) (Asia Pacific Economic Cooperation) সামিটেরও আয়োজন ওই সময়ে করতে যাচ্ছিল এবং একই সময়ে দুটি গুরুদায়িত্ব পালন ভারবহ হবে, তাই ইন্দোনেশিয়ার ওই চেয়ারম্যানশিপের জন্য তাড়াহুড়ো। কিন্তু আশিয়ানের বাকি সদস্যরা তাতে রাজি হয়নি।
এর আগেও মিয়ানমারে অর্থবহ গণতন্ত্রের লক্ষ্যেও ইন্দোনেশিয়ার উদ্যোগ সফল হয়নি। দ্বিপক্ষীয় বা আশিয়ানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটিতে রাজনৈতিক সংস্কারের ইন্দোনেশীয় ধারণাও অগ্রাহ্য হয়। আঞ্চলিক মানবাধিকারের মেকানিজম তৈরির ইন্দোনেশীয় উদ্যোগও ব্যাহত হয়। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার সংঘাত আশিয়ান সংহতির জন্য ক্ষতিকর হলেও ইন্দোনেশিয়া সেখানেও মধ্যস্থতা করতে পারেনি।
একইভাবে চীনের দক্ষিণ চীন সমুদ্রে আক্রমণাত্মক তৎপরতাকে ঠেকাতে এবং এই তৎপরতায় সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনকে সুরক্ষা দিতে আশিয়ান ঐকমত্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে ওই দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়, যা আশিয়ানের ক্রেডিবিলিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আশিয়ানের এখন একমাত্র সান্ত্বনা যে সংগঠনটি পূর্ব এশিয়ার যেকোনো নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রধান পরিচায়ক। যদিও সংগঠনটিতে অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত কোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার মতো সংহতি নেই, ঐকমত্যেরও অভাব।
ইন্দোনেশিয়ার বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও আশিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর ব্যর্থতায় তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আশিয়ানের সম্মিলিত নিরাপত্তা উদ্যোগের সংকট আরো প্রকট হবে, যখন আশিয়ানের ইন্দোনেশীয় চেয়ারম্যানশিপ কম্বোডিয়া ও পরে লাওস ও ব্রুনাইয়ের হাতে চলে যাবে। আশিয়ান চেয়ারম্যানশিপের এই উত্তরাধিকারী দেশগুলোর কোনোটারই ইন্দোনেশীয় শান্তি, সম্প্রীতি ও গণতন্ত্রের আঞ্চলিক ধারণার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই। তখন বরং ইন্দোনেশিয়ার আন্তর্জাতিক মর্যাদাই খানিকটা ক্ষুণ্ন হবে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া এ পর্যন্ত এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে তার আকস্মিক পতন ঘটবে না। তবে ইন্দোনেশিয়ার উত্থানের মূলমঞ্চ তখন আর আশিয়াননির্ভর হবে না।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
No comments