জন্মদিন-আদর্শে যিনি অবিচল by মযহারুল ইসলাম
আমাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্মদিন আজ। এযাবৎ স্যারের জন্মদিন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়নি, তাঁর কঠোর বিরোধিতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার সময় স্যারের জন্মদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের উদ্যোগ নিলেও তিনি রাজি হননি।
অধ্যাপক আহমেদ কামালকে স্যার দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘তোমরা যা-ই করো না কেন, আমি সেখানে উপস্থিত থাকব না।’ তবে স্যারের শিষ্যত্ব নিয়ে যাঁরা গর্ববোধ করেন, তাঁদের অনেকে স্যারের বাসায় জন্মদিনে শ্রদ্ধা-শুভেচ্ছা জানাতে যান। সেটা এড়ানো অসম্ভব বলেই বাধ্য হয়ে তা মেনে নেন। সেখানে আয়োজনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তাঁর সস্নেহ সান্নিধ্য, দেশ ও সমাজ নিয়ে আলাপচারিতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর চিন্তাশীল লেখার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাই স্যারের শিষ্য কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। প্রবন্ধ সাহিত্যও যে কত জনপ্রিয় হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত স্যারের রচনাগুলো। সেসব রচনা সচেতন ও ঋদ্ধ করে চলেছে অগণিত পাঠককে। তাঁর রচনায় শুধু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত ছবিটিই ফুটে ওঠে না, পাওয়া যায় মানবমুক্তির নির্দেশনাও। তিনি মনে করেন, আন্দোলন এবং আন্দোলনেই মানুষের মুক্তি আসতে পারে। তিনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যে অসম সমাজব্যবস্থাটি আমাদের ওপর অক্টোপাসের মতো চেপে বসেছে, তা কখনোই মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। পুঁজিবাদী এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এখনই লড়তে হবে রাজনৈতিকভাবে, সংঘবদ্ধ হয়ে। এই অতি সত্য কথাটি তাঁর কথায়-লেখায় বারবার প্রকাশ পেয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আজীবন মননশীল সাহিত্যের চর্চা করলেও মাঝেমধ্যে পাঠকপ্রিয় সৃজনশীল লেখা লিখেছেন। লিখেছেন ছোটদের জন্যও। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: আরণ্যক দৃশ্যাবলি, অনতিক্রান্ত, এরিস্টেটলের কাব্যতত্ত্ব, প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ, আমার পিতার মুখ, বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক, কুমুর বন্ধন, উপর কাঠামোর ভেতরেই, তাকিয়ে দেখি, বেকনের মৌমাছিরা, স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি, একই সমতলে, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি।
দেশের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকট চেহারা আমরা লক্ষ করি চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে। অনেকেই দুই দলে ভাগ হয়ে গেছেন, দলীয় স্বার্থচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থেই তাঁরা কোনো একটির পক্ষে ঝুঁকে আছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যন্ত দুই প্রধান রাজনৈতিক দলে বিভক্ত। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য যিনি আলোক-মশাল জ্বেলে চলেছেন, তিনি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হননি। ওসমানী উদ্যানের গাছ বাঁচানো কিংবা লালন আখড়ার ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। আদর্শবাদী তরুণেরাও তাঁকেই ভরসা মেনেছেন। ডানে ঝুঁকে পড়েননি। স্যারের মতো অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ।
দশ বছর ধরে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পাদনায় সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ওই পত্রিকায় সংশ্লিষ্ট। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি এতটাই সচেতন ও দায়িত্বশীল যে তাঁর চোখ এড়িয়ে একটি শব্দও পত্রিকায় প্রকাশের উপায় নেই। আমার একটি লেখায় দুটি ঘটনার উল্লেখ ছিল, কিন্তু তথ্যসূত্র না থাকায় তিনি আমাকে দুটি ঘটনার তথ্যসূত্র দেখাতে বলেন। তথ্যসূত্র দেখানোর পরই লেখাটি পত্রিকায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলে মেধাবী ছাত্রদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল শাসক-সহযোগী আমলা হওয়া। সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দিতে মেধাবীদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। অথচ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সিএসপি পরীক্ষার ফরম পূরণ না করে ছিঁড়ে তাঁর বাবাকে অধিক দৃঢ়তায় জানিয়েছিলেন শাসক-সহযোগী আমলা না হওয়ার কথাটি। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে শিক্ষকতা। সারা জীবন নির্মোহ ও সাদামাটা জীবন যাপন করে এসেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের নানা লোভনীয় প্রস্তাব সযত্নে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁর অনড় অবস্থান শত প্রলোভনও টলাতে পারেনি। শিক্ষকতা পেশার শুরু থেকে আজ অবধি তিনি জাতির মেধা-মননচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
একজন মানুষ সারা জীবন ভালো কাজ করতে পারে না এবং আদর্শিক এক স্থানেও চিরকাল থাকতে পারে না। অমন হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের সমাজে। কিন্তু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একই দৃঢ়তায় আজীবন স্থির থেকেছেন। আদর্শিক স্থানে সারাটি জীবন অবিচল আছেন। তিনি আদর্শের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র আপস কখনো করেননি। আমাদের চলার সম্মুখে স্যার আলোকবর্তিকা হিসেবেই আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন।
তাঁর ৭৭তম জন্মজয়ন্তীতে জানাই শ্রদ্ধা।
মযহারুল ইসলাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর চিন্তাশীল লেখার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাই স্যারের শিষ্য কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। প্রবন্ধ সাহিত্যও যে কত জনপ্রিয় হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত স্যারের রচনাগুলো। সেসব রচনা সচেতন ও ঋদ্ধ করে চলেছে অগণিত পাঠককে। তাঁর রচনায় শুধু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত ছবিটিই ফুটে ওঠে না, পাওয়া যায় মানবমুক্তির নির্দেশনাও। তিনি মনে করেন, আন্দোলন এবং আন্দোলনেই মানুষের মুক্তি আসতে পারে। তিনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যে অসম সমাজব্যবস্থাটি আমাদের ওপর অক্টোপাসের মতো চেপে বসেছে, তা কখনোই মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। পুঁজিবাদী এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এখনই লড়তে হবে রাজনৈতিকভাবে, সংঘবদ্ধ হয়ে। এই অতি সত্য কথাটি তাঁর কথায়-লেখায় বারবার প্রকাশ পেয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আজীবন মননশীল সাহিত্যের চর্চা করলেও মাঝেমধ্যে পাঠকপ্রিয় সৃজনশীল লেখা লিখেছেন। লিখেছেন ছোটদের জন্যও। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: আরণ্যক দৃশ্যাবলি, অনতিক্রান্ত, এরিস্টেটলের কাব্যতত্ত্ব, প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ, আমার পিতার মুখ, বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক, কুমুর বন্ধন, উপর কাঠামোর ভেতরেই, তাকিয়ে দেখি, বেকনের মৌমাছিরা, স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি, একই সমতলে, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি।
দেশের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকট চেহারা আমরা লক্ষ করি চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে। অনেকেই দুই দলে ভাগ হয়ে গেছেন, দলীয় স্বার্থচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থেই তাঁরা কোনো একটির পক্ষে ঝুঁকে আছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যন্ত দুই প্রধান রাজনৈতিক দলে বিভক্ত। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য যিনি আলোক-মশাল জ্বেলে চলেছেন, তিনি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হননি। ওসমানী উদ্যানের গাছ বাঁচানো কিংবা লালন আখড়ার ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। আদর্শবাদী তরুণেরাও তাঁকেই ভরসা মেনেছেন। ডানে ঝুঁকে পড়েননি। স্যারের মতো অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ।
দশ বছর ধরে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পাদনায় সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ওই পত্রিকায় সংশ্লিষ্ট। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি এতটাই সচেতন ও দায়িত্বশীল যে তাঁর চোখ এড়িয়ে একটি শব্দও পত্রিকায় প্রকাশের উপায় নেই। আমার একটি লেখায় দুটি ঘটনার উল্লেখ ছিল, কিন্তু তথ্যসূত্র না থাকায় তিনি আমাকে দুটি ঘটনার তথ্যসূত্র দেখাতে বলেন। তথ্যসূত্র দেখানোর পরই লেখাটি পত্রিকায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলে মেধাবী ছাত্রদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল শাসক-সহযোগী আমলা হওয়া। সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দিতে মেধাবীদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। অথচ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সিএসপি পরীক্ষার ফরম পূরণ না করে ছিঁড়ে তাঁর বাবাকে অধিক দৃঢ়তায় জানিয়েছিলেন শাসক-সহযোগী আমলা না হওয়ার কথাটি। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে শিক্ষকতা। সারা জীবন নির্মোহ ও সাদামাটা জীবন যাপন করে এসেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের নানা লোভনীয় প্রস্তাব সযত্নে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁর অনড় অবস্থান শত প্রলোভনও টলাতে পারেনি। শিক্ষকতা পেশার শুরু থেকে আজ অবধি তিনি জাতির মেধা-মননচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
একজন মানুষ সারা জীবন ভালো কাজ করতে পারে না এবং আদর্শিক এক স্থানেও চিরকাল থাকতে পারে না। অমন হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের সমাজে। কিন্তু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একই দৃঢ়তায় আজীবন স্থির থেকেছেন। আদর্শিক স্থানে সারাটি জীবন অবিচল আছেন। তিনি আদর্শের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র আপস কখনো করেননি। আমাদের চলার সম্মুখে স্যার আলোকবর্তিকা হিসেবেই আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন।
তাঁর ৭৭তম জন্মজয়ন্তীতে জানাই শ্রদ্ধা।
মযহারুল ইসলাম
No comments