কালের পুরাণ-আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীরা কাঁদেন কেন? by সোহরাব হাসান
ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। অ্যানথ্রাক্সের প্রকোপ কমে যাওয়ার পর সবাই চেয়েছিলেন উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করবেন, গ্রামে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে কোরবানি দেবেন; কিন্তু পশুর অ্যানথ্রাক্স কমলেও রাজনৈতিক অ্যানথ্রাক্স বাংলাদেশকে আক্রান্ত করেছে। তা থেকে কবে মুক্তি মিলবে জানি না।
ঈদুল আজহার দুই দিন আগে রোববার বিএনপি দেশব্যাপী হরতাল পালন করেছে দলীয় সভানেত্রী খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে ‘বের’ করে দেওয়ার প্রতিবাদে। আন্তবাহিনী গণসংযোগ বিভাগের পরিচালক দাবি করেছেন, খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় ৬ নম্বর শহীদ মইনুল সড়কের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে আসেননি। তাঁকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশনে যাঁরা এ দৃশ্য দেখেছেন, তাঁরাই ব্যথিত হয়েছেন।
খালেদা জিয়ার এই কান্না দেখে অনেকের হয়তো আরেকটি দিনের কথা মনে পড়বে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় আহত তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সেই নির্বাক-নিথর-ভাবলেষহীন চেহারা, যা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। তখন বিএনপির নেতারা কী মন্তব্য করেছিলেন, তা-ও আমাদের মনে আছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীরা কাঁদেন কেন? প্রধানমন্ত্রীরা কাঁদেন না কেন?
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, তাঁকে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তোলা হয়েছে। তাঁর এই অভিযোগকে হালকাভাবে দেখা ঠিক নয়। খালেদা জিয়ার অভিযোগ ঠিক হলে, সাদা পোশাকের কেউ করেননি। করেছেন ইউনিফর্মধারীরা। আইন খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে বললে তা সবাইকে মানতে হবে। কিন্তু একজন রাজনীতিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করা আইনের চোখে অন্যায় না হলেও মানুষ একে ভালোভাবে নেয়নি। মন্ত্রীদের কথাবার্তায়ও শিষ্টাচারের ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতারা যখন শোকে মুহ্যমান, তখন বিএনপির প্রথম সারির নেতারাও এ রকম নিষ্ঠুর মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি।
সবার মনে থাকার কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও গ্রেপ্তারের সময় ইউনিফর্মধারীরা টানাহেঁচড়া করেছিলেন। সেই ছবি সে সময়কার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমাদের কোনো নেতা বা নেত্রী ইউনিফর্মধারীদের হাতে এভাবে লাঞ্ছিত হবেন—সেটি কেউ চাই না। না চাইলেও বারবার ঘটে। এরই নাম গণতন্ত্র? এই গণতন্ত্রই কি আমরা চেয়েছিলাম?
খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির বিষয়টি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। আইনি লড়াইয়ের সঙ্গে রাজনীতি যুক্ত হয়ে রাজপথ গরম হয়েছে। হরতাল হয়েছে। সম্ভবত দেশবাসীকে আরও বহু দিন এর জের টানতে হবে।
২.
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসকের কার্যালয় খালেদা জিয়াকে তিনটি কারণ দেখিয়ে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়। কারণগুলো হলো—১. সেনাবাহিনীর সম্পত্তি কোনো বেসামরিক নাগরিককে দেওয়া যায় না, ২. সেনানিবাসের ভেতরে থেকে রাজনীতি করে তিনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন এবং ৩. একই ব্যক্তিকে ঢাকা শহরে দুটি বাড়ি দেওয়ার কোনো আইন নেই।
খালেদা জিয়া সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসকের নোটিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে প্রতিকার চেয়ে মামলা করলে দেড় বছর ধরে আইনি লড়াই চলার পর গত ১৩ অক্টোবর মাননীয় আদালত এক মাসের সময় দিয়ে তাঁকে বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেন। ১২ নভেম্বর সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ ২৯ নভেম্বর শুনানির তারিখ ধার্য করেন। ১৩ থেকে ২৯ নভেম্বরের ব্যবধান মাত্র ১৬ দিন। এরই মধ্যে কত কিছু ঘটে গেল। রাজনৈতিক বাদানুবাদ, আইনজীবীদের দৌড়ঝাঁপ।
বিরোধী দলের অভিযোগ, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় কার্যকর হতে পারে না। সরকারপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা আপিল বিভাগে স্থগিত হয়নি। অতএব, খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে আইনগত বাধা নেই। কিন্তু এখানে রাজনীতির প্রশ্নটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। খালেদা জিয়া একজন রাজনীতিক, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ১৩ নভেম্বরের মধ্যে সিদ্ধান্তটি কার্যকর না করলে সরকারের কতটা ক্ষতি হতো?
৩.
আগের একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম, বাড়ি নিয়ে দুই পক্ষই বাড়াবাড়ি করছে। ভেবেছিলাম, বাড়ি-বিতর্কটি সেখানেই শেষ হবে। হয়নি। শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে অফিস থেকে হেঁটে বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম, কারওয়ান বাজারে কয়েক শ নারী-পুরুষ বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু-একটি বাস-মিনিবাস এলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তাদের ঘরে ফিরতে হবে। কাছাকাছি যারা থাকে, তারা না হয় হেঁটে গেল, কিন্তু যারা দূরে থাকে, তারা কীভাবে যাবে? প্রতিদিনই গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটে ঘরমুখো মানুষের প্রচণ্ড ভিড় থাকলেও খানিক আগে বা পরে তারা বাস পেয়ে যায়। কিন্তু রোববার হরতাল থাকায় শনিবার সন্ধ্যার পরই শহরে যানবাহন চলাচল কমে যায়। শিশুসন্তানসহ এক দম্পতিকে দেখলাম, মিরপুরে যাওয়ার জন্য রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরাদরি করছেন। ঘরে তো ফিরতে হবে। জানি না সেই উৎকণ্ঠিত নারী-পুরুষ সেই রাতে কীভাবে ঘরে ফিরেছেন। রোববার বাড়ি যাওয়ার জন্য যারা টিকিট কেটেছিল, তারা আদৌ বাড়ি যেতে পেরেছে কি না।
শনিবার বিকেল থেকেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হচ্ছিল। পুলিশ লাঠিপেটা করছে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছে। বিএনপির কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়ে তার জবাব দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সড়কে তাঁরা কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছেন, বহু বাস-মিনিবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করেছেন।
টিভিতে দেখলাম, মাইক্রোবাসের এক চালক হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাঁর যানবাহনে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার গাড়িটা ভাঙচুর করেছেন, কষ্ট হলেও আমি মেরামত করে নিতে পারব। অন্তত আগুন দেবেন না।’ কর্মীরা তাঁর কথা শোনেননি। এই গরিব মাইক্রোচালক কি ঈদ করতে পারবেন?
শনিবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন খবরে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রচার করছিল। তাঁরা বলেছেন, ঈদের আগে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সরকার বাড়ি উচ্ছেদের পক্ষে রায় পেয়েছে, সে ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু যেভাবে এবং যে সময়ে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা কেউ সমর্থন করছেন না। তাঁরা বলেছেন, সরকার কাজটি ঈদের পরও করতে পারত।
অন্যদিকে বিএনপি উচ্ছেদের প্রতিবাদে রোববার হরতাল পালন করেছে। হরতালে ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ যাকে পেয়েছে, গাড়িতে তুলে নিয়েছে। কেবল সাধরণ মানুষ নয়, বিএনপির যে কর্মীরা পিকেটিং করতে গিয়ে হাজতে গেলেন, তাঁরাও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন।
শনিবার বিকেল থেকেই বিভিন্ন স্থানে হামলা-পাল্টাহামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপিও জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ঈদের পর হরতাল পালন করতে পারত। করেনি। তাতে তাদের জেদ বজায় থাকে না। আবার সরকারেরও জেদ বজায় রাখা চাই। এই জেদাজেদিতে পড়ে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত।
শনিবার কুষ্টিয়ায় সরকারদলীয় সাংসদের বাড়িতে বোমা মেরে তিনজনকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। খালেদা জিয়ার বাড়ি উচ্ছেদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, আমরা জানি না। ঘটনাটি দুঃখজনক। বোমাবাজির রাজনীতি এখানেই শেষ হবে, সেটিও ভাবার কারণ নেই।
সরকারের দাবি, তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে। বিরোধী দলের দাবি, তারাও জনগণের জন্য রাজনীতি করে। কিন্তু জনগণের রাজনীতি যে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলল, ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করল—এর দায় কে নেবেন? প্রধানমন্ত্রী নেবেন? বিরোধীদলীয় নেত্রী নেবেন? আওয়ামী লীগ নেবে? বিএনপি নেবে?
বিরোধী দল যেদিন হরতাল ডেকেছে, তার আগের রাতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন ৮৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে। তাঁরা কী দেখে যাবেন? দেখে যাবেন এখানে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম রেষারেষি। সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে বিরোধী দল যায় না। সফরকারী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের কর্মসূচিও বাতিল করা হয়েছে।
৪.
আমরা জানি, খালেদা জিয়া নিজে সেনানিবাসের বাড়ির বরাদ্দ নেননি। তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য বেআইনিভাবে তাঁকে এটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট খালেদার রিট নাকচ করে দিয়েছেন, তা-ও সত্য। তার পরও সরকার বা সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসক আপিল আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। কিংবা হাইকোর্টের রায়ে উল্লিখিত সময় পার হওয়ার পর তারা খালেদা জিয়াকে আরেকটি নোটিশ দিয়ে বলতে পারত, সাত বা পনেরো দিনের মধ্যে আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। তিনি সেই নোটিশ আমলে না নিলে সেনা কর্তৃপক্ষ জনগণকে বিষয়টি জানাতে পারত। এরপর তারা যে সিদ্ধান্ত নিত, জনগণ তার প্রতি সমর্থন জানাত। তাতে সেনানিবাসের বাড়িও উদ্ধার হতো, রাজনৈতিক সংঘাতও এড়ানো যেত।
সেনাবাহিনীকে দলীয় রাজনীতিতে টেনে আনা সমীচীন নয়। যদিও আমাদের দেশে প্রতিটি সরকারই দলীয় স্বর্থে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছে। এর ফল ভালো হয়নি। দেশের স্থপতিসহ দুজন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন সেনাসদস্যদের হাতে। সেনানিবাসের বাড়ি বরাদ্দের পেছনে রাজনীতি ছিল। এখন বাড়ি উচ্ছেদ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়েছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়। আরেকটি কথা, তাঁর বাড়িটির বরাদ্দ অবৈধ হলে বরাদ্দদাতাকেও ধরতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
যে বাড়ি উপলক্ষ করে এত সংঘাত-সংঘর্ষ, এত বাকযুদ্ধ, ঈদের আগে এত মানুষের দুর্ভোগ, তার দায় বরাদ্দদাতা এড়াতে পারেন না। অথচ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলছে না। তিনি মহাজোটের শরিক বলে? আইন তো সবার ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত।
সেনানিবাসের বাড়ি নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষ মর্মাহত। আর যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা মিটিমিটি হাসছেন। হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।
গণতন্ত্র মানে বাড়ি নয়, গণতন্ত্র মানে জেদ নয়; গণতন্ত্র মানে সুশাসন, সহিষ্ণুতা এবং নম্রতা ও সহনশীলতার নিয়ত অনুশীলন। দুর্ভাগ্য, আমাদের নেতা-নেত্রীরা তার থেকে অনেক অনেক দূরে আছেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net
খালেদা জিয়ার এই কান্না দেখে অনেকের হয়তো আরেকটি দিনের কথা মনে পড়বে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় আহত তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সেই নির্বাক-নিথর-ভাবলেষহীন চেহারা, যা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। তখন বিএনপির নেতারা কী মন্তব্য করেছিলেন, তা-ও আমাদের মনে আছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীরা কাঁদেন কেন? প্রধানমন্ত্রীরা কাঁদেন না কেন?
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, তাঁকে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তোলা হয়েছে। তাঁর এই অভিযোগকে হালকাভাবে দেখা ঠিক নয়। খালেদা জিয়ার অভিযোগ ঠিক হলে, সাদা পোশাকের কেউ করেননি। করেছেন ইউনিফর্মধারীরা। আইন খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে বললে তা সবাইকে মানতে হবে। কিন্তু একজন রাজনীতিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করা আইনের চোখে অন্যায় না হলেও মানুষ একে ভালোভাবে নেয়নি। মন্ত্রীদের কথাবার্তায়ও শিষ্টাচারের ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতারা যখন শোকে মুহ্যমান, তখন বিএনপির প্রথম সারির নেতারাও এ রকম নিষ্ঠুর মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি।
সবার মনে থাকার কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও গ্রেপ্তারের সময় ইউনিফর্মধারীরা টানাহেঁচড়া করেছিলেন। সেই ছবি সে সময়কার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমাদের কোনো নেতা বা নেত্রী ইউনিফর্মধারীদের হাতে এভাবে লাঞ্ছিত হবেন—সেটি কেউ চাই না। না চাইলেও বারবার ঘটে। এরই নাম গণতন্ত্র? এই গণতন্ত্রই কি আমরা চেয়েছিলাম?
খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির বিষয়টি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। আইনি লড়াইয়ের সঙ্গে রাজনীতি যুক্ত হয়ে রাজপথ গরম হয়েছে। হরতাল হয়েছে। সম্ভবত দেশবাসীকে আরও বহু দিন এর জের টানতে হবে।
২.
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসকের কার্যালয় খালেদা জিয়াকে তিনটি কারণ দেখিয়ে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়। কারণগুলো হলো—১. সেনাবাহিনীর সম্পত্তি কোনো বেসামরিক নাগরিককে দেওয়া যায় না, ২. সেনানিবাসের ভেতরে থেকে রাজনীতি করে তিনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন এবং ৩. একই ব্যক্তিকে ঢাকা শহরে দুটি বাড়ি দেওয়ার কোনো আইন নেই।
খালেদা জিয়া সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসকের নোটিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে প্রতিকার চেয়ে মামলা করলে দেড় বছর ধরে আইনি লড়াই চলার পর গত ১৩ অক্টোবর মাননীয় আদালত এক মাসের সময় দিয়ে তাঁকে বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেন। ১২ নভেম্বর সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ ২৯ নভেম্বর শুনানির তারিখ ধার্য করেন। ১৩ থেকে ২৯ নভেম্বরের ব্যবধান মাত্র ১৬ দিন। এরই মধ্যে কত কিছু ঘটে গেল। রাজনৈতিক বাদানুবাদ, আইনজীবীদের দৌড়ঝাঁপ।
বিরোধী দলের অভিযোগ, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় কার্যকর হতে পারে না। সরকারপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা আপিল বিভাগে স্থগিত হয়নি। অতএব, খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে আইনগত বাধা নেই। কিন্তু এখানে রাজনীতির প্রশ্নটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। খালেদা জিয়া একজন রাজনীতিক, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ১৩ নভেম্বরের মধ্যে সিদ্ধান্তটি কার্যকর না করলে সরকারের কতটা ক্ষতি হতো?
৩.
আগের একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম, বাড়ি নিয়ে দুই পক্ষই বাড়াবাড়ি করছে। ভেবেছিলাম, বাড়ি-বিতর্কটি সেখানেই শেষ হবে। হয়নি। শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে অফিস থেকে হেঁটে বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম, কারওয়ান বাজারে কয়েক শ নারী-পুরুষ বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু-একটি বাস-মিনিবাস এলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তাদের ঘরে ফিরতে হবে। কাছাকাছি যারা থাকে, তারা না হয় হেঁটে গেল, কিন্তু যারা দূরে থাকে, তারা কীভাবে যাবে? প্রতিদিনই গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটে ঘরমুখো মানুষের প্রচণ্ড ভিড় থাকলেও খানিক আগে বা পরে তারা বাস পেয়ে যায়। কিন্তু রোববার হরতাল থাকায় শনিবার সন্ধ্যার পরই শহরে যানবাহন চলাচল কমে যায়। শিশুসন্তানসহ এক দম্পতিকে দেখলাম, মিরপুরে যাওয়ার জন্য রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরাদরি করছেন। ঘরে তো ফিরতে হবে। জানি না সেই উৎকণ্ঠিত নারী-পুরুষ সেই রাতে কীভাবে ঘরে ফিরেছেন। রোববার বাড়ি যাওয়ার জন্য যারা টিকিট কেটেছিল, তারা আদৌ বাড়ি যেতে পেরেছে কি না।
শনিবার বিকেল থেকেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হচ্ছিল। পুলিশ লাঠিপেটা করছে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছে। বিএনপির কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়ে তার জবাব দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সড়কে তাঁরা কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছেন, বহু বাস-মিনিবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করেছেন।
টিভিতে দেখলাম, মাইক্রোবাসের এক চালক হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাঁর যানবাহনে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার গাড়িটা ভাঙচুর করেছেন, কষ্ট হলেও আমি মেরামত করে নিতে পারব। অন্তত আগুন দেবেন না।’ কর্মীরা তাঁর কথা শোনেননি। এই গরিব মাইক্রোচালক কি ঈদ করতে পারবেন?
শনিবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন খবরে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রচার করছিল। তাঁরা বলেছেন, ঈদের আগে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সরকার বাড়ি উচ্ছেদের পক্ষে রায় পেয়েছে, সে ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু যেভাবে এবং যে সময়ে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা কেউ সমর্থন করছেন না। তাঁরা বলেছেন, সরকার কাজটি ঈদের পরও করতে পারত।
অন্যদিকে বিএনপি উচ্ছেদের প্রতিবাদে রোববার হরতাল পালন করেছে। হরতালে ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ যাকে পেয়েছে, গাড়িতে তুলে নিয়েছে। কেবল সাধরণ মানুষ নয়, বিএনপির যে কর্মীরা পিকেটিং করতে গিয়ে হাজতে গেলেন, তাঁরাও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন।
শনিবার বিকেল থেকেই বিভিন্ন স্থানে হামলা-পাল্টাহামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপিও জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ঈদের পর হরতাল পালন করতে পারত। করেনি। তাতে তাদের জেদ বজায় থাকে না। আবার সরকারেরও জেদ বজায় রাখা চাই। এই জেদাজেদিতে পড়ে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত।
শনিবার কুষ্টিয়ায় সরকারদলীয় সাংসদের বাড়িতে বোমা মেরে তিনজনকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। খালেদা জিয়ার বাড়ি উচ্ছেদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, আমরা জানি না। ঘটনাটি দুঃখজনক। বোমাবাজির রাজনীতি এখানেই শেষ হবে, সেটিও ভাবার কারণ নেই।
সরকারের দাবি, তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে। বিরোধী দলের দাবি, তারাও জনগণের জন্য রাজনীতি করে। কিন্তু জনগণের রাজনীতি যে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলল, ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করল—এর দায় কে নেবেন? প্রধানমন্ত্রী নেবেন? বিরোধীদলীয় নেত্রী নেবেন? আওয়ামী লীগ নেবে? বিএনপি নেবে?
বিরোধী দল যেদিন হরতাল ডেকেছে, তার আগের রাতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন ৮৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে। তাঁরা কী দেখে যাবেন? দেখে যাবেন এখানে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম রেষারেষি। সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে বিরোধী দল যায় না। সফরকারী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের কর্মসূচিও বাতিল করা হয়েছে।
৪.
আমরা জানি, খালেদা জিয়া নিজে সেনানিবাসের বাড়ির বরাদ্দ নেননি। তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য বেআইনিভাবে তাঁকে এটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট খালেদার রিট নাকচ করে দিয়েছেন, তা-ও সত্য। তার পরও সরকার বা সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসক আপিল আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। কিংবা হাইকোর্টের রায়ে উল্লিখিত সময় পার হওয়ার পর তারা খালেদা জিয়াকে আরেকটি নোটিশ দিয়ে বলতে পারত, সাত বা পনেরো দিনের মধ্যে আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। তিনি সেই নোটিশ আমলে না নিলে সেনা কর্তৃপক্ষ জনগণকে বিষয়টি জানাতে পারত। এরপর তারা যে সিদ্ধান্ত নিত, জনগণ তার প্রতি সমর্থন জানাত। তাতে সেনানিবাসের বাড়িও উদ্ধার হতো, রাজনৈতিক সংঘাতও এড়ানো যেত।
সেনাবাহিনীকে দলীয় রাজনীতিতে টেনে আনা সমীচীন নয়। যদিও আমাদের দেশে প্রতিটি সরকারই দলীয় স্বর্থে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছে। এর ফল ভালো হয়নি। দেশের স্থপতিসহ দুজন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন সেনাসদস্যদের হাতে। সেনানিবাসের বাড়ি বরাদ্দের পেছনে রাজনীতি ছিল। এখন বাড়ি উচ্ছেদ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়েছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়। আরেকটি কথা, তাঁর বাড়িটির বরাদ্দ অবৈধ হলে বরাদ্দদাতাকেও ধরতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
যে বাড়ি উপলক্ষ করে এত সংঘাত-সংঘর্ষ, এত বাকযুদ্ধ, ঈদের আগে এত মানুষের দুর্ভোগ, তার দায় বরাদ্দদাতা এড়াতে পারেন না। অথচ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলছে না। তিনি মহাজোটের শরিক বলে? আইন তো সবার ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত।
সেনানিবাসের বাড়ি নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষ মর্মাহত। আর যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা মিটিমিটি হাসছেন। হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।
গণতন্ত্র মানে বাড়ি নয়, গণতন্ত্র মানে জেদ নয়; গণতন্ত্র মানে সুশাসন, সহিষ্ণুতা এবং নম্রতা ও সহনশীলতার নিয়ত অনুশীলন। দুর্ভাগ্য, আমাদের নেতা-নেত্রীরা তার থেকে অনেক অনেক দূরে আছেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net
No comments