এটিএন নিউজ আওয়ার এক্সট্রা-জনকল্যাণেও ভালো কাজ করছে গণমাধ্যম
প্রথম আলোর যুগপূর্তি উপলক্ষে মুন্নী সাহার মুখোমুখি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। ৩ নভেম্বর, ২০১০
মুন্নী সাহা: প্রিয় দর্শক, এটিএন নিউজের নিউজ আওয়ার এক্সট্রা অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি ধরে নিচ্ছি, এই মুহূর্তে যাঁরা টিভি সেটের সামনে বসে আছেন, তাঁরা সবাই পত্রিকা পড়েন।
মুন্নী সাহা: প্রিয় দর্শক, এটিএন নিউজের নিউজ আওয়ার এক্সট্রা অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি ধরে নিচ্ছি, এই মুহূর্তে যাঁরা টিভি সেটের সামনে বসে আছেন, তাঁরা সবাই পত্রিকা পড়েন।
এবং এ খবর অন্তত জানেন, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা, বহুল প্রচারিত পত্রিকা প্রথম আলোর এক যুগ পূর্তি হবে কাল অর্থাৎ ৪ নভেম্বর। এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে প্রথম আলোকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আজ নিউজ আওয়ার এক্সট্রায় একটু অন্য রকম আয়োজন করেছি। এই আয়োজনে আজ যিনি আমার সঙ্গে বসে আছেন, তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। আজ আমরা যে তরুণ প্রজন্ম সাংবাদিকতা করছি, তারা অনেকেই তাঁকে শিক্ষকের মতো দেখি। আমার রিপোর্টিংয়ে কাজ করার নেপথ্য নায়কও মতি ভাই। তিনি আমাদের অনেকেরই গুরু। আমরা যারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছি, তাদের অনেকেই কিছু না-কিছু কাজ তার সঙ্গে করেছি। সেই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
মতিউর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাকে আমার সহকর্মী মনে করি। কারণ, একসঙ্গে আমরা ভোরের কাগজ-এ কাজ করেছি।
মুন্নী সাহা: আপনি জোর করে আমাকে রিপোর্টিংয়ে পাঠাতেন। ফলে আজও রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে পারছি। আমার হাতে প্রথম আলোর আগামীকালের পত্রিকা, যার প্রধান শিরোনাম ‘বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনা’। আমরা আজ শুরু করি এই প্রথম আলোর প্রথম দিনের কথা দিয়ে। প্রথম আলোর যে অপার সম্ভাবনা ঘটেছে, তা কি আপনার মাথায় ছিল?
মতিউর রহমান: যদি পরিষ্কারভাবে বলি, আমরা এতটা ভাবিনি। তবে আমাদের মধ্যে একটা উৎসাহ, একটা উদ্দীপনা ছিল। আমাদের ভাবনায় ছিল—আমরা সৎ থাকব, বিনয়ী হব, আমরা সত্য প্রকাশে সাহসী হব। এসব কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের পত্রিকার পরিকল্পনা এবং পত্রিকার বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা একটা ভালো জায়গায় পৌঁছেছি। আপনারা জানেন, পাঠকসংখ্যা বা প্রচারসংখ্যা অনেক দেশে অনেক অনেক বেশি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা প্রায় ১২-১৩ লাখ ছাপা হয়। সে তুলনায় ধরেন আজ আমাদের পত্রিকা ছাপা হয়েছে চার লাখ ৮৭ হাজার, যা এমন বিরাট সংখ্যা কিছু নয়। আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম।
মুন্নী সাহা: কিন্তু শিক্ষিত জনসংখ্যার তুলনায় চার লাখ ৮৭ হাজার পাঠকসংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি।
মতিউর রহমান: বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস ধরলে আমরা একটি বড় জায়গায় পৌঁছেছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য আরও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। কারণ, পাঠকের সঙ্গে পত্রিকার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু আমাদের পত্রিকারই নয়, বাংলাদেশের আরও অনেক পত্রিকারই অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনের আরও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এগুলো দেশের মানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করছে।
মুন্নী সাহা: আপনি বললেন, আপনাদের শুরুটা এমন ছিল যে, সৎ থাকব বা ভালো কাজ করব, বিনয়ী থাকব, সত্য প্রকাশ করব। সেটির সঙ্গে কিন্তু ব্যবসায়িক সম্পর্ক হয়তো ছিল। কিন্তু আজকে যে হতাশার জায়গা থেকে কথা বলছেন, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার লাখ ৮৭ হাজার পাঠকসংখ্যা। সেখানে কি ব্যবসায়িক লাভের একটি আক্ষেপের জায়গা আছে?
মতিউর রহমান: এটা একটা ভালো প্রশ্ন, আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, আমরা সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করব। অন্যটি ছিল, আমাদের ব্যবসায়িকভাবেও সফল হতে হবে। বাংলাদেশে ৪০ বছরের ইতিহাস দেখলে দেখি, অনেক পত্রিকা বের হয়েছে, কিন্তু অনেক পত্রিকা ব্যবসায়িকভাবে অসফল। সেগুলো বন্ধও হয় না। কিন্তু ওই সব অনেক পত্রিকার সাংবাদিকদের, ওই পত্রিকার মালিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাঁদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, ওয়েজবোর্ড পূরণ ইত্যাদির অনেক ঘাটতি থাকে—এগুলো কিন্তু সত্য। এর কারণ, এসব পত্রিকা আর্থিকভাবে সফল নয়। যেসব পত্রিকা আর্থিকভাবে সফল, তাদের সংবাদকর্মীরা সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা ব্যবসয়িকভাবে সফল না হই, নিজের আয় থেকে চলতে না পারি, তবে তো আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারব না।
যদি ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে না পারি, তবে আমাকে সরকারের কাছে, ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হবে, নয়তো মালিকের কৃপার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। আজকে যদি আমি সফল হই, তবে আমি আমার মতো করে নীতি, পত্রিকা পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, পত্রিকার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারব। তাই প্রত্যেকটি কাগজের একটি ব্যবসায়িক লক্ষ্য থাকা উচিত। ব্যবসায়িক লক্ষ্য মানে এই নয় যে অসৎ উপায়ে যেকোনো উপায়ে লাভবান হতে হবে। আজকে বিশ্বে প্রমাণিত হয়েছে, ভালো সাংবাদিকতা করলে ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়া যায়। বাংলাদেশেও এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
মুন্নী সাহা: একটি পত্রিকা ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার জন্য কত অ্যাগ্রেসিভ হওয়া জরুরি বলে মনে করেন। কিংবা ব্যবসায়িকভাবে প্রথম আলোকে সফল করার জন্য আপনি কতটা অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন বা হবেন?
মতিউর রহমান: বাংলাদেশে পাঠকদের মধ্যে বর্তমানে একটি ভালো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আগে একসময় পত্রিকাগুলো ছিল কোনো দলের মুখপত্র, কোনো ব্যক্তির মুখপত্র। এখনো আমাদের দেশে কোনো কোনো পত্রিকা কোনো ব্যবসায়ী বা গোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাগজ বের করছে। পাঠক কিন্তু সেই সব পত্রিকা বেশি পড়তে চান, যেগুলো দলনিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন। এটি একটি ভালো পরিবর্তন। আর যে পত্রিকাগুলো দলীয় মুখপত্রের মতো, সেগুলোর পাঠকসংখ্যা কম। দলীয় কর্মীরা পর্যন্তও সে পত্রিকা কেনেন না বা পড়েন না। অর্থাৎ এখানে পাঠকেরা সাংবদিকতার পেশাদারির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। গত দুই দশকে এভাবে বাংলাদেশে সংবাদপত্রে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে।
মুন্নী সাহা: আজকে বলতে চাই, আপনার সাংবাদিকতার ৪০ বছরের জীবনে গুণগত অনেক পরিবর্তনের আপনি সাক্ষী, সে ক্ষেত্রে আসলে আমি যে আজকে সব ভালো কথা বলব, তাও নয়। এই যে অ্যাগ্রেসিভনেসের কথা বলছিলাম, যখন প্রথম আলো শীর্ষে, এখনো শীর্ষে, তবু নতুন কোনো পত্রিকা বাজারে এলেই আপনারা একটু নেগেটিভ অ্যাটিচুড শো করেন। এমন একটি সমালোচনা আছে, যেটি আমার নিজস্ব কোনো কথা নয়, এটি কীভাবে আপনি দেখেন?
মতিউর রহমান: আমি বলব, আমার বিবেচনায় নতুন কোনো কাগজ এলে অবশ্যই আমরা তাকে শুভেচ্ছা জানাব, তাদের কাছে আশা করব, তারা সুসাংবাদিকতা করবে, তাদের জবাবদিহি থাকবে। তারা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই, কোনো অসুবিধা থাকার কারণ নেই। ধরেন, যদি কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করে, অযথা একটা আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়, সেখানেও আমরা যথেষ্ট নম্র ও বিনয়ী। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং পত্রিকার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অহেতুকই আক্রমণাত্মক হওয়ার কথা আমরা ভাবব না। কোনো পত্রিকা যদি আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ভিত্তিহীন তথ্য প্রদান করে, তা দিয়ে কিন্তু কোনো পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় না।
মুন্নী সাহা: কিছুদিন আগে ফেসবুকে আমারই এক সহকর্মী লিখেছিল, আমরা ওই কারণেই পত্রিকা কিনি বা পড়ি কি না। প্রথম আলো ও এর প্রতিপক্ষ আরেকটি পত্রিকার সমালোচনা প্রথম আলোর মূল্যবান জায়গায় একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে। অথবা সেই পত্রিকার একটি মূল্যবান অংশ বা পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে মতিউর রহমান বা প্রথম আলোকে নিয়ে সমালোচনা থাকে। আমরা আসলে পাঠক হিসেবে বঞ্চিত হচ্ছি। এই যে রেষারেষি, এটি আসলে কবে থেকে শুরু হয়েছিল। আপনাদের স্লোগান ছিল ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো’। সেই ভালো পত্রিকাটি যখন রিপোর্টিং শুরু করল ওই পত্রিকার পার্টিকুলার ম্যানেজমেন্ট বা তাদের দুর্নীতি নিয়ে। কিন্তু তার আগে ওই পত্রিকার বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আপনারা ছেপেছেন। তাহলে আসলে আমরা প্রথম আলোর কোন ভালোটা ধরব?
মতিউর রহমান: ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিশ্চয়ই রিপোর্ট হতে পারে। প্রশ্ন হলো, রিপোর্টটি আসলে ভুল, না শুদ্ধ। যদি ভুল হয়ে থাকে, সেটি অবশ্যই খারাপ, অন্যায় কাজ হবে। আমরা এমন কোনো রিপোর্ট ছাপিনি, যেটি ভুল। আমরা এমন কোনো জায়গা পত্রিকায় দিচ্ছি না, যেখানে একটি গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বরাদ্দ। গত ছয় মাস, তিন মাস কিংবা এক মাসে আমাদের পত্রিকায় কোনো গোষ্ঠী, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক বড় কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রী, সাংসদ, ব্যবসায়ী দুর্নীতি বা অন্যায় করে থাকেন, সেগুলো যদি খবর হয়ে থাকে, তবে তা খবর আকারে ছাপা হয়েছে। কিন্তু আপনি যে অভিযোগের কথা বললেন, বা পাঠকের অভিযোগ, সেটি আমি গ্রহণ করতে পারছি না।
মুন্নী সাহা: আজকে পত্রিকায় আপনার লেখা পড়েছি, সেখানে আপনি লিখেছেন, প্রথম আলো শুধু একটি পত্রিকায়ই নয়। এর চেয়েও বেশি কিছু। সেই বেশি কিছুর অনেক ক্যাম্পেইন আমরা দেখি এসিড, মাদক, নারী নির্যাতন—এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রথম আলো সামনে আছে। আসলে এ বিষয়গুলো কীভাবে পত্রিকার সঙ্গে সংযোজন করলেন। আমরা দেখতাম, এনজিওগুলো এ ধরনের কার্যক্রম করত। কিন্তু পত্রিকা হিসেবে এ ধরনের কাজ করার বিষয়ে আপনার আসলে কী ধারণা ছিল?
মতিউর রহমান: আমি একসময় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। দেশের জন্য, সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার দায়িত্ববোধ প্রায় সবারই থেকে থাকে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আসলে এ ধরনের কাজ করা।
আমরা যখন প্রথম আলো শুরু করলাম, তার আগেও যখন ভোরের কাগজ-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তখন থেকেই এ ধরনের কিছু কিছু কাজ শুরু করেছিলাম। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির প্রথম সংবাদ আমরা করেছিলাম। তাঁকে আমরা সাহায্য করেছিলাম জায়গা দিয়ে এবং একটি বাড়ি করে দিয়ে। এ ধরনের আরও অনেক কাজ করেছিলাম। নানা বিষয়ে গোলটেবিল আয়োজন করেছিলাম। আমরা সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এ দেশের নাগরিকও। আমরা কি শুধু পত্রিকায় লিখব, অন্যের ভুল ধরব, সমালোচনা করব!
একসময় আমাদের মনে হলো, কিছু বিষয় আছে, যেগুলো মানবিক ও অতি জরুরি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। সেগুলোতেও আমাদের সরাসরি কিছু করা দরকার। সেই থেকে একটি লক্ষ্য ও ভাবনা হিসেবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করলাম। আমরা নারীদের ওপর এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সভা, সেমিনার, আন্দোলন করে আসছি। ১০ বছর ধরে আমরা সরাসরি এই এসিডদগ্ধ নারীদের পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা করে আসছি। একইভাবে মাদককে না বলছি, ত্রাণ কার্যক্রম করছি। অদম্য মেধাবী, যারা অতিদরিদ্র তাদের খুঁজে বের করে বৃত্তি দেওয়া—এ ধরনের কাজগুলো করছি। আমরা দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব মনে করে কাজগুলো করে যাচ্ছি। সাংবাদিক বলে আমাদের মনে হয়েছে, এ দায়িত্বগুলো আরও বেশি করা উচিত। এ কাজগুলো যে শুধু পত্রিকায় আমরা করছি তা কিন্তু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পত্রিকাগুলো এ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। আমেরিকায়, ব্রিটেনে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকাগুলো কাজ করছে। কেউ হয়তো ক্রীড়া, কেউ আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজনে উৎসাহ দিয়ে থাকে। আমরা একটু মানবিক দিকগুলোর ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। আমরা মনে করি, এ ধরনের কাজ অব্যাহত থাকা উচিত। আরও বড় করা উচিত। এটি শুধু প্রথম আলোর কাজ নয়। প্রথম আলো ট্রাস্ট করে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে কাজগুলো করেছি, যেখানে সমাজে বিশিষ্টজনেরা আছেন। তাঁদের সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে এ কাজগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে।
মুন্নী সাহা: আপনি যেহেতু রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন বলেছেন। রাজনীতিতে একটি কথা আছে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। কিন্তু যখন আপনি সম্পাদক হিসেবে পত্রিকায় এলেন, তখন উল্টো। আপনি গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের মতো করেও প্রচার করার চেষ্টা করেছেন আপনি। কেন?
মতিউর রহমান: প্রথম আলো কয়েক শ সাংবাদিক নিয়ে একটি টিম হিসেবে কাজ করছে। একটি যৌথতা—ঐক্যবদ্ধ, মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিন্তু কোনো বড় কাজ করা সম্ভব নয়। যদি আজকে মনে করি, প্রথম আলো কিছুটা সফল হয়েছে, সেখানেও কিন্তু বিভিন্ন বিভাগের সবার সমবেত চেষ্টার মাধ্যমেই সফল হয়েছে, যার মাধ্যমে আজ আমরা এ অবস্থানে আসতে পেরেছি।
মুন্নী সাহা: তাহলে কি এ সিদ্ধান্ত সবাই মিলিতভাবে অথবা দলের চেয়ে একজন ব্যক্তি অভিজ্ঞ, যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ফজলে হাসান আবেদ—তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক স্বনামধন্য মানুষ। কথায় কথায় এ নামগুলো এল। এর বাইরেও কিছু নাম প্রথম আলো তৈরি করেছে।
মতিউর রহমান: যৌথতার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। একসময় রাজনীতিতে দেখেছি, যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা ছিল। আবার ব্যক্তির উদ্যোগও থাকতে হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ইত্যাদিতে একজন ব্যক্তি আসলে আসেন তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে। তিনি সেটি অন্যদের বোঝান, জানান। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তির গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। যেমন আমরা ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের নাম বলতে পারি। বিশ্বে যদি দেখি, আফ্রিকায় বর্ণবৈষ্যম্য নিরসনে একক নেতৃত্ব যিনি দিয়েছেন, তিনি হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। এই অবদান তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না। এ রকম বাংলাদেশেও আছে। তাঁদের কথা আমরা শুনি। আজ বাংলাদেশে যদি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কিছু করতে বলেন, অবশ্যই আমি সেটি করব। আমি মনে করি, এ ধরনের লোকজন সৎ, মানুষের কল্যাণ চান। আমি প্রায়ই বলি, ড. জাফর ইকবাল ও ড. কায়কোবাদের মতো আরও কিছু পাগল আমাদের দরকার। তাঁরা একদিন এসে আমাকে বললেন, আপনারা খেলা আর বিনোদন নিয়ে অনেক কিছু করেন, কিন্তু আমাদের শিক্ষা নিয়ে কিছু করতে হবে আপনাদের। আমি বলি, কী করতে হবে? তাঁরা সারা দেশে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করার জন্য বলেন। আজ তাঁদের জন্যই সারা দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিজ্ঞানমনস্ক ও গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের আরও ভূমিকা পালন করা দরকার। তাই ব্যক্তিগুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে চাই।
মুন্নী সাহা: আপনার এই ব্যক্তিগুরুত্বকে অনেকে ভুল বোঝেন। অনেকে মনে করেন, আপনি প্রচলিত রাজনীতির বিরাজনৈতিকীকরণের একজন প্রবর্তক। এ বিষয়ে অনেকে আপনাকে পছন্দ করেন না।
মতিউর রহমান: কে কী বলে, তাতে আমরা কান দিচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, দেশ পরিচালনা করবেন রাজনীতিকেরা, দেশ পরিচালিত হবে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে এটা প্রমাণিত যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে বিকল্প কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। যতই ভুলত্রুটি থাকুক না কেন, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে থাকতে হবে, চলতে হবে। নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হবে। এটি আমাদের সব সময়ের বিশ্বাস।
মুন্নী সাহা: অনেকে অভিযোগ করে, ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর ব্যাপারে আপনার হাত ছিল।
মতিউর রহমান: আমাদের কাগজে ৩ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদমাধ্যম নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বলেছি, প্রথম আলোয় প্রকাশিত সেই দুই বছর সময়ে আমরা যেসব লেখা ছেপেছিলাম, তা বই আকারে প্রকাশ করব। পাঠক যেন তা জানতে পারে, আমাদের ভূমিকা কী ছিল। আমরা কখনো সেনা শাসন, সামরিক শাসন চাইনি—প্রথম দিন থেকে। আমরা বারবার বলেছি, আমরা চাই গণতন্ত্র, নির্বাচন, নির্বাচিত সরকার। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত সারা দেশে হানাহানি, হত্যা, রক্তপাতের ঘটনা ছিল। সবাই এগুলো থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিল। সেই পটভূমিতে সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। দেশের অধিকাংশ মানুষ এই পরিবর্তনকে সমর্থন জানিয়েছিল। তবে এ তর্ক চলতে থাকবে এক দশক ধরে। হয়তো ওই পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমাদের সামনে খোলা ছিল না।
মুন্নী সাহা: ওই সময় আপনার অবস্থান কী ছিল?
মতিউর রহমান: আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্টে প্রথম আলো নিষিদ্ধ ছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান এই নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং পরে তা স্বীকার করেছিলেন। তো সে সময় আমাদের সম্পর্কে সেনাবাহিনীর এই ছিল অবস্থান। আমরা তো নিষিদ্ধ। আমাদের তো কোনো ভূমিকা রাখার প্রশ্নই ওঠে না, বরং নানাভাবে চাপের মধ্যে ছিলাম।
মুন্নী সাহা: এর পেছনে আসলে কী কারণ ছিল? এর প্রধান কারণ কি ছিল স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন বলে?
মতিউর রহমান: হ্যাঁ, অবশ্যই প্রথম আলো স্বাধীনভাবে লিখতে পারে। জেন ডিফেন্স উইকলি নামে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সামরিক জার্নাল আছে। ২০০৬ সালে সেই জার্নালে বাংলাদেশের তিন বাহিনী—বাংলাদেশের বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধানেরা তিনটি বড় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যেখানে আগামী ২০ বছরে আমাদের বাহিনীগুলোর পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড, অস্ত্র কেনা-সম্পর্কিত বিস্তৃত তথ্য দিয়েছিলেন। সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের কাগজে মিজানুর রহমান খান সমালোচনা করে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন। সে জন্যই প্রথম আলোর ব্যাপারে ওই ব্যবস্থা নিয়েছিল। আর ওই সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের ১৪ জন সাংবাদিককে সেনাক্যাম্পে নিয়ে ভয় দেখানো, চাপ প্রয়োগ, মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, মামলাও হয়েছিল। সে সময় আমাদের বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার করা হয়েছিল, সবই একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা হয়েছিল। একটি বিশেষ সংস্থার প্রচারণায় একটি উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আমাদের কাগজ বিক্রিতে বাধা দিয়েছে, বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রচারণা চালিয়েছে। সর্বশেষ আমাদের প্রথম আলোর সাত বছরের অ্যাকাউন্টসের সব কাগজ তারা নিয়ে গিয়ে এক বছর ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছু পায়নি। এগুলো তো কোনো সহযোগিতার উদাহরণ নয়। আমরা বরং অন্য যেকোনো পত্রিকার চেয়ে সে সময় বেশি চাপের মধ্যে ছিলাম।
মুন্নী সাহা: যত বেশি চাপ, সার্কুলেশন তত বাড়ে।
মতিউর রহমান: সত্যি কথা বলতে গেলে ২০০৭ থেকে ২০০৮—এই দুই বছরে আমাদের পত্রিকার ৭০ হাজার কপি বিক্রি বেড়েছিল, যা আগে কোনো এক বছর এত বাড়েনি।
মুন্নী সাহা: আমরা জানি, গণমাধ্যমের ওপর যখন চাপ আসে, তখন তার পাঠকদের আগ্রহ বাড়ে।
মতিউর রহমান: এটি সত্য কথা। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সত্য কথা বলতে গিয়ে চাপের মধ্যে থেকেছে বলেই প্রথম আলো এত এগিয়েছে। যদি কেউ বলে, আমরা ভুল করেছি, আমরা সে ভুল স্বীকার করি। জেনেশুনে যদি ভুল করি, তা বারবার আমরা স্বীকার করব। কিন্তু আমরা যা বিশ্বাস করে লিখেছি, যদি পাঠক গ্রহণ করে, সেগুলো আমরা অবশ্যই বারবার প্রকাশ করব। কারণ, পাঠকেরা তো আর এমনি এমনি আট টাকা দিয়ে কাগজ কিনে পড়েন না।
মুন্নী সাহা: এবার আমি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে একটা ব্যাপার বলতে চাই। আমি জানি, যখনই নারীদের বিষয় আসে, তখন আপনি বলেন, আমি সিস্টারদের পক্ষে। কিন্তু রাজনীতির বেলায় দেখেছি, খুবই অগুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ বা নতুন দল করার উদ্যোগকে আপনি সমর্থন করেছেন। আর দুই নেত্রীর বেলায় সব সময় আপনি ক্রিটিক্যাল, তাহলে কি আপনি মেয়েদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরোধী?
মতিউর রহমান: দেখুন, দুই দল, দুই নেত্রী, বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁরা দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ—এ কথা অস্বীকার করার কিছু নেই। তাঁদের পক্ষে যেমন অনেক কথা বলা যায়, তেমনি তাঁদের সমালোচনা করারও অনেক জায়গা আছে। এটি করা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব। তাঁরা ভালো কাজ করলে সেগুলো বলব; আবার ভুল করলে তার সমালোচনা করব। এ ক্ষেত্রে নারীবাদী বা নারীদের বিপক্ষে এটি দেখার কোনো অবকাশ নেই। তাঁরা দেশের জনগণের নেত্রী। তাঁদের কর্মদক্ষতা, ভালো-মন্দ, যোগ্যতা—এগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
মুন্নী সাহা: আপনি যেভাবে নতুন রাজনীতিবিদদের সহযোগিতা বা সমর্থন করেন, সেভাবে কিন্তু এই দুই নেত্রীর প্রতি যা-ই বলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে শ্রদ্ধা বা সমর্থন তেমন কিন্তু দেখা যায় না, যা প্রথম আলো পড়লে বোঝা যায়।
মতিউর রহমান: আপনি আসলে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি। আমরা আসলে সংবাদপত্র হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দলকেই সমর্থন বা সহযোগিতার পক্ষে নই। আমরা আসলে তাদের কাছে যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা করি, তা পূরণে তারা কতটুকু করতে পারছে, সেটিই আমাদের বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়। তাদের অনেক পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আবার তাদের বিভিন্ন স্তরের নেতা, এমপি কিংবা মন্ত্রীরা ভুল করলে তাঁদের সমালোচনা করি। উভয় দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা আমাদের গালমন্দ করেন, সমালোচনা করেন, মামলা করেন—যার কারণে বিভিন্ন স্থানে আদালতে যেতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের সংবাদ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব দেলোয়ার হোসেন, সাংসদ নাসিরুদ্দিন পিন্টুসহ অনেকের মামলাই কিন্তু আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আমরা নিশ্চিত, এই মামলাটিতেও আমরা জিতব এবং আদালতে তা খারিজ হয়ে যাবে। এটি কোনো পক্ষপাত, সমর্থন এগুলো কিছু নয়। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন বা উৎসাহ প্রদান করিনি। একসময় আমি একটি দলের জন্যই কাজ করেছিলাম বা যুক্ত ছিলাম। অন্য কোনো নতুন দলের হয়ে কোনো কাজ করিনি। ভবিষ্যতেও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মুন্নী সাহা: আপনার নিজের সাংবাদিকতার ৪০ বছর এবং প্রথম আলোর ১২ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক হুমকি ও চাপ নিশ্চয়ই এসেছে। আমরা জানি, সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। যত বেশি হুমকি, যত বেশি চাপ আসবে, তত বেশি সার্থকতা। এ ধরনের সার্থকতা ও সফলতার কথা যদি বলতেন।
মতিউর রহমান: সারা বিশ্বেই কিন্তু সাংবাদিকেরা এসব চাপ ও হুমকির মধ্যে থাকে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। যদি সরকার বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সাংবাদিকেরা মিলেমিশে একাকার হয়ে যান, তাহলে আলাদা করে সাংবাদিকতার কিছু থাকে না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিচারের মানদণ্ডে আমাদের সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো একটু নিচু অবস্থানে আছে।
বিভিন্ন সময় বা বিভিন্ন সরকারের সময় নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। সম্পাদক হিসেবে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার কথা বলতে পারি। সত্তরের জুলাইতে শুরু হয়ে একাত্তরের মার্চে এটি বন্ধ হয়ে গেল। বায়াত্তরে আবার শুরু করে চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে জরুরি আইনের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। আবার ’৭৯ সালে শুরু হয়ে ’৮৬ সালে এরশাদের আমলে আবার একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময়গুলোতে অনেক চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
’৯১-এর পর যখন ভোরের কাগজ-এ ছিলাম, তখন বিএনপি সরকার একবার আমাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিল। মিছিল-আন্দোলন করে ধীরে ধীরে আবার বিজ্ঞাপন পেলাম। আওয়ামী লীগ সরকার একসময় প্রথম আলোয় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিল। পরে আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় এল, কিছুদিন পরই তারা আমাদের বিজ্ঞাপন দৈনিক ১০ ইঞ্চিতে নামিয়ে নিয়ে এল। তখন আমরা মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আমরা কোনো তদবির নিয়ে আসিনি, আপনাদের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিচ্ছি, তবে একটি কথা বলি, যে সরকার বা প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে লেগে যায়, তার পতন হয়। আপনার মনে আছে, বিএনপি সরকারের লজ্জাজনকভাবে পতন হয়েছিল।
এ ধরনের চাপের মধ্যে সংবাদপত্রকে সব সময়ই থাকতে হয়। এসব থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তারপর প্রকাশ্যে অনেক রাজনীতিবিদ গালমন্দ করেন। সম্প্রতি সংসদে প্রথম আলো ও গণমাধ্যমকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ ধরনের অনেক চাপ ও হুমকি থেকেই যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও পাঠকের কাছে আমাদের কাগজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কে গালমন্দ করল, কে হুমকি দিল, কে বিজ্ঞাপন দিল না—এসব বিষয় নিয়ে আমরা ভয় পাই না। আমাদের সাংবাদিকতার কাজ, আমরা ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাব। আমরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করব। যদি ভুল হয়, আমরা সব সময় চেষ্টা করি, যে পৃষ্ঠার সংবাদের প্রতিবাদ হয়, প্রতিবাদ সেখানেই ছাপানোর জন্য বা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছাপাতে চেষ্টা করি। যদি ভুলটি যথাযথভাবে স্বীকার করেন, তবে মানুষ আপনাকে সম্মান করবে। মানুষ আপনাকে সৎ হিসেবে দেখতে চায়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি খাড়াখাড়ি দ্বিধাবিভক্তি দেখা যাচ্ছে। আমাদের সমাজেও এ বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিতে এমন বিভক্তি নিয়ে একটি দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।
মুন্নী সাহা: রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির কথা বলছেন। কিন্তু আমরা নতুন নেতৃত্ব তৈরির জায়গায় আপনার কোনো উদ্যোগ দেখিনি। এ সম্পর্কে আপনার মত কী?
মতিউর রহমান: যাঁরা রাজনীতি করবেন, দেশ পরিচালনা করবেন, তাঁদের একটি বিশেষ যোগ্যতা ও ধারা অর্জন করা দরকার। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংসদকে কেন্দ্র করে এ ধরনের যোগ্যতা বা ধারা তৈরির জন্য সহযোগিতা করছে। সংসদ কার্যকর করা, সাংসদদের আরও উন্নত করা—এসব বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর পরও আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আমাদের রাজনীতিবিদদের আরও উদ্যোগী, সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সঙ্গে এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করা উচিত।
মুন্নী সাহা: রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর জন্য আপনি কী উদ্যোগ নিয়েছেন? আমরা সাংবাদিকতায় জানি, ভালো খবর আসলে খবর নয়। আপনার ৪০ বছরের সাংবাদিকতার এই দীর্ঘ সময় বদলানো কথা বলছেন। এই বিভাজন কমানোর জন্য আপনারা কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না?
মতিউর রহমান: এই বিভাজন কমানোর কাজটি অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময়ের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেক দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, বিভেদ সৃষ্টি হয়ে গেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে। নিশ্চয়ই আমাদের দেশে এই গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে এমন কোনো নেতা, দল, প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হবে, যারা এই ভেদাভেদ, বিভাজন কাটিয়ে উঠে নতুন পথে যাত্রা শুরু করবে। এ কথাগুলো সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমাদের বলা উচিত। আমরা বলার চেষ্টা করছি।
সবার একটি সমবেত চেষ্টা থাকা উচিত বিভাজন কমানোর জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে যে অবস্থায় রয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়াও কঠিন। অনেকেই মনে করবেন, এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য বা স্বার্থ আছে। কিন্তু আমাদের এ ধরনের কোনো লক্ষ্য নেই। আমরা কিছু কিছু পরিবর্তন দেখছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বড় বড় ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। আমাদের সবাইকে ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
মুন্নী সাহা: আপনাদের একটি প্রচার কার্যক্রম আছে, আপনারা বলেন, ‘বদলে যাও, বদলে দাও’। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইব, আপনি কতটুকু বদলেছেন।
মতিউর রহমান: আমরা নিজেরা চেষ্টা করছি নিজেদের বদলে ফেলতে। চেষ্টা আসলে কি, আমাদের সৎ থাকতে হবে, আমরা হয়তো ১০০ ভাগ সৎ হতে না পারলেও সৎ থাকার চেষ্টা করছি। আমরা উদ্দেশ্যমূলক বা বস্তুনিষ্ঠতার অভাব রয়েছে, এমন সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকছি। আমি নিজে আরও একটু বেশি সহনশীল হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে আরও খোলামেলা আলোচনা করা, উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। কতটুকু সফল হয়েছি, তা আমার সহকর্মী বন্ধুরা বলতে পারবেন। আমাদের অফিসের ভেতর অবশ্যই একটি পরিবর্তন এসেছে। তা না হলে একজন ব্যক্তি বা সম্পাদকের পক্ষে বড় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সব কর্মীর মধ্যে সমঝোতা, সহযোগিতা ও সমন্বয় বেড়েছে। দুই বছর ধরে এগুলো বাড়ানোর আমরা চেষ্টা করছি নিজেদের মধ্যে। আমাদের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করছি।
মুন্নী সাহা: প্রথম আলো পত্রিকার অনেক কিছু বদলে গেছে, সেগুলো লক্ষ করেছি। কিন্তু একটি প্রসঙ্গে বলতে চাই, মানুষের ডাকনাম আপনি ছেঁটে দিচ্ছেন—এ প্রসঙ্গে আপনার মত কী?
মতিউর রহমান: একটি ডাকনাম মা-বাবা দেন তাঁর পরিবারের ভেতর ব্যবহারের জন্য। সেই ডাকনামটি বাইরে সবার মধ্যে প্রচার করা আমাদের কাছে পছন্দনীয় নয়। আবার এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন ১৯৬২ সাল থেকে রাশেদ খানের সঙ্গে মেনন যুক্ত হয়ে নামটি স্থায়ী হয়ে গেছে। যেমন সাদেক হোসেন খোকা কিংবা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক—এ নামগুলো অপরিবর্তিনীয় হয়ে গেছে। আবার উদাহরণ হিসেবে বলছি, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলেও কিন্তু আগে এ ধরনের ডাকনাম যুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা নেই। আমরা মনে করি, এই ডাকনাম ছেঁটে ফেলার মাধ্যমে একটি মানদণ্ডও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশেই আপনি পাবেন না যে, ডাকনামগুলো এমনভাবে ব্যবহূত হয়।
মুন্নী সাহা: আবার অনেক সময় দেখি, অনেক ডাকনাম ভালো নয়, তারা চায় না সেগুলো ব্যবহার করতে, কিন্তু মাঝেমধ্যে প্রথম আলোয় দেখা যায়।
মতিউর রহমান: যদি এ ধরনের হয়ে থাকে, তবে আমি মনে করি এটি ভুল, এর জন্য আমরা ভুল স্বীকার করছি। তখন হয়তো প্রয়োজন পড়ে, ডাকনাম দিয়ে সহজে যাতে মানুষ বুঝতে পারে পরিচয়।
মুন্নী সাহা: ব্যবসায়িক সফলতার অংশ বাদ দিয়ে প্রথম আলোর ১২ বছরের ব্যর্থতার কথা জানতে চাইছি আপনার কাছে।
মতিউর রহমান: নিশ্চয়ই আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে। তা না হলে কেন আমাদের সার্কুলেশন সাড়ে চার লাখ হবে, কেন আমাদের সার্কুলেশন সাত-আট লাখ হবে না। আমাদের দেশে এত লোকসংখ্যা, ক্রমে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, কিন্তু সে তুলনায় কেন পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ছে না। আমাদের সাংবাদিকদের যোগ্যতা, গুণগত মান আরও বাড়ানো উচিত বলে আমাদের মনে হয়। আমাদের সাংবাদিকদের নিয়ে আরও প্রশিক্ষণ, আলোচনার আয়োজন করা উচিত।
আজ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত কিংবা পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে সাংবাদিকেরা বড় বড় বই লেখেন। কিন্তু আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এ ধরনের আন্তর্জাতিক মানের বই লিখেছেন, সে উদাহরণ পাইনি। আমাদের সাংবাদিকদের নিজেদের তৈরি করা, বিষয়ের গভীরে বেশি করে যাওয়া, আরও পড়া, গবেষণা করা—এ বিষয়গুলো দরকার। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আছে।
মুন্নী সাহা: কাল প্রথম আলোর জন্মদিন। প্রথম আলোর বন্ধুসভাসহ সারা দেশের মানুষ এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনে উৎসবে মেতে উঠেছে। সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আজকাল আমরা দেখছি, একটি মিডিয়ার বা খবরের কাগজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে গোটা দেশ মাতামাতি করা শুরু করে নিজের জন্মদিন বা প্রিয়জনের জন্মদিন ভুলে গিয়ে। চ্যানেল আই দেখলে তো মনে হয়, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীও যে পাড়া-মহল্লায়, শিল্পকলায় হতে পারে, সেটা ভোলানোর জন্য তাদের চেষ্টার শেষ নেই। রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে চ্যানেলে...তাও আবার নাম হবে ‘চ্যানেল আই রবীন্দ্রজয়ন্তী’। আর বিখ্যাতজনেরা সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে হইহই করেন...এসব বিষয় নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই....আমরা তো বিবিসির জন্মদিন করতে শুনি না, জানি না টাইম ম্যাগাজিনের ২০ বছর কবে হলো...।
মতিউর রহমান: গণমাধ্যম একটি শক্তি, কারণ এটি সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এটি গণমাধ্যমের আগ্রাসী কোনো দিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন করা উচিত ছিল। কিংবা নাগরিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর দায়িত্ব নেওয়া দরকার ছিল এমন জাতীয় উৎসবগুলো আয়োজন করার। আমাদের ষাট থেকে আশির দশকে সামাজিক সংগঠনগুলো এসবের দায়িত্ব নিয়েছিল, সেগুলো বর্তমানে দুর্বল হয়ে গেছে। এর পেছনে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বিভক্তির কারণ উল্লেখযোগ্য। আমরা আজকে কেউ উদ্যোগ নিতে পারি না। কারণ সর্বত্র বিভক্তি দেখা যায়। আজকে সাংবাদিকদের দু-তিনটা ইউনিয়ন কিংবা জেলায় দু-তিনটা প্রেসক্লাব রয়েছে। সে জায়গায় আসলে গণমাধ্যমগুলোকে এগিয়ে এসে অনেক দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। আর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়। অনেক কিছুই হয়।
মুন্নী সাহা: প্রথম আলো ও সাংবাদিকতাকে আসলে কোথায় দেখতে চান? আপনার প্রত্যাশা কী?
মতিউর রহমান: আমাদের সাংবাদিকতার জগতের দীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। পঞ্চাশের দশকে আজাদ, সংবাদ, ষাটের দশকে ইত্তেফাক, তারপর আবার সংবাদ, একসময়ে অবজারভার কিংবা জনকণ্ঠর ভূমিকার কথা আমরা জানি। এ পত্রিকাগুলো কিন্তু বিভিন্ন সময় ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—এগুলোর ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা চাই এই ভূমিকাগুলো আরও বাড়াতে। এটি নির্ভর করে পত্রিকার পরিচালনা গোষ্ঠী, সাংবাদিকদের সততা, নিষ্ঠা ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ওপর। আমরা বলতে চাই, গণমাধ্যমের সবাইকেই নিজের দায়িত্ব পালনে সচেতন হওয়া এবং গণমাধ্যমকে কীভাবে ব্যবহার করছি সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে বলতে চাই, আমরা আরও সচেষ্ট হব, যাতে ভুল সংবাদ প্রকাশ না পায়। আমরা যেন অন্যায় না করি। সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সমাজে বিভেদ বিভাজন দূর হবে। রাজনৈতিক বিরোধ থাকবে, কিন্তু এটি বর্তমানে যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে।
মুন্নী সাহা: প্রথম আলো যেভাবে অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সে জন্য প্রথম আলোর এক যুগ পূর্তিতে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক ও সামাজিক যে বিরোধ রয়েছে, তা নিরসন হবে জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি আজকের আয়োজন।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
মতিউর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাকে আমার সহকর্মী মনে করি। কারণ, একসঙ্গে আমরা ভোরের কাগজ-এ কাজ করেছি।
মুন্নী সাহা: আপনি জোর করে আমাকে রিপোর্টিংয়ে পাঠাতেন। ফলে আজও রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে পারছি। আমার হাতে প্রথম আলোর আগামীকালের পত্রিকা, যার প্রধান শিরোনাম ‘বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনা’। আমরা আজ শুরু করি এই প্রথম আলোর প্রথম দিনের কথা দিয়ে। প্রথম আলোর যে অপার সম্ভাবনা ঘটেছে, তা কি আপনার মাথায় ছিল?
মতিউর রহমান: যদি পরিষ্কারভাবে বলি, আমরা এতটা ভাবিনি। তবে আমাদের মধ্যে একটা উৎসাহ, একটা উদ্দীপনা ছিল। আমাদের ভাবনায় ছিল—আমরা সৎ থাকব, বিনয়ী হব, আমরা সত্য প্রকাশে সাহসী হব। এসব কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের পত্রিকার পরিকল্পনা এবং পত্রিকার বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা একটা ভালো জায়গায় পৌঁছেছি। আপনারা জানেন, পাঠকসংখ্যা বা প্রচারসংখ্যা অনেক দেশে অনেক অনেক বেশি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা প্রায় ১২-১৩ লাখ ছাপা হয়। সে তুলনায় ধরেন আজ আমাদের পত্রিকা ছাপা হয়েছে চার লাখ ৮৭ হাজার, যা এমন বিরাট সংখ্যা কিছু নয়। আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম।
মুন্নী সাহা: কিন্তু শিক্ষিত জনসংখ্যার তুলনায় চার লাখ ৮৭ হাজার পাঠকসংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি।
মতিউর রহমান: বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস ধরলে আমরা একটি বড় জায়গায় পৌঁছেছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য আরও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। কারণ, পাঠকের সঙ্গে পত্রিকার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু আমাদের পত্রিকারই নয়, বাংলাদেশের আরও অনেক পত্রিকারই অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনের আরও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এগুলো দেশের মানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করছে।
মুন্নী সাহা: আপনি বললেন, আপনাদের শুরুটা এমন ছিল যে, সৎ থাকব বা ভালো কাজ করব, বিনয়ী থাকব, সত্য প্রকাশ করব। সেটির সঙ্গে কিন্তু ব্যবসায়িক সম্পর্ক হয়তো ছিল। কিন্তু আজকে যে হতাশার জায়গা থেকে কথা বলছেন, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার লাখ ৮৭ হাজার পাঠকসংখ্যা। সেখানে কি ব্যবসায়িক লাভের একটি আক্ষেপের জায়গা আছে?
মতিউর রহমান: এটা একটা ভালো প্রশ্ন, আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, আমরা সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করব। অন্যটি ছিল, আমাদের ব্যবসায়িকভাবেও সফল হতে হবে। বাংলাদেশে ৪০ বছরের ইতিহাস দেখলে দেখি, অনেক পত্রিকা বের হয়েছে, কিন্তু অনেক পত্রিকা ব্যবসায়িকভাবে অসফল। সেগুলো বন্ধও হয় না। কিন্তু ওই সব অনেক পত্রিকার সাংবাদিকদের, ওই পত্রিকার মালিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাঁদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, ওয়েজবোর্ড পূরণ ইত্যাদির অনেক ঘাটতি থাকে—এগুলো কিন্তু সত্য। এর কারণ, এসব পত্রিকা আর্থিকভাবে সফল নয়। যেসব পত্রিকা আর্থিকভাবে সফল, তাদের সংবাদকর্মীরা সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা ব্যবসয়িকভাবে সফল না হই, নিজের আয় থেকে চলতে না পারি, তবে তো আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারব না।
যদি ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে না পারি, তবে আমাকে সরকারের কাছে, ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হবে, নয়তো মালিকের কৃপার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। আজকে যদি আমি সফল হই, তবে আমি আমার মতো করে নীতি, পত্রিকা পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, পত্রিকার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারব। তাই প্রত্যেকটি কাগজের একটি ব্যবসায়িক লক্ষ্য থাকা উচিত। ব্যবসায়িক লক্ষ্য মানে এই নয় যে অসৎ উপায়ে যেকোনো উপায়ে লাভবান হতে হবে। আজকে বিশ্বে প্রমাণিত হয়েছে, ভালো সাংবাদিকতা করলে ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়া যায়। বাংলাদেশেও এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
মুন্নী সাহা: একটি পত্রিকা ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার জন্য কত অ্যাগ্রেসিভ হওয়া জরুরি বলে মনে করেন। কিংবা ব্যবসায়িকভাবে প্রথম আলোকে সফল করার জন্য আপনি কতটা অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন বা হবেন?
মতিউর রহমান: বাংলাদেশে পাঠকদের মধ্যে বর্তমানে একটি ভালো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আগে একসময় পত্রিকাগুলো ছিল কোনো দলের মুখপত্র, কোনো ব্যক্তির মুখপত্র। এখনো আমাদের দেশে কোনো কোনো পত্রিকা কোনো ব্যবসায়ী বা গোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাগজ বের করছে। পাঠক কিন্তু সেই সব পত্রিকা বেশি পড়তে চান, যেগুলো দলনিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন। এটি একটি ভালো পরিবর্তন। আর যে পত্রিকাগুলো দলীয় মুখপত্রের মতো, সেগুলোর পাঠকসংখ্যা কম। দলীয় কর্মীরা পর্যন্তও সে পত্রিকা কেনেন না বা পড়েন না। অর্থাৎ এখানে পাঠকেরা সাংবদিকতার পেশাদারির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। গত দুই দশকে এভাবে বাংলাদেশে সংবাদপত্রে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে।
মুন্নী সাহা: আজকে বলতে চাই, আপনার সাংবাদিকতার ৪০ বছরের জীবনে গুণগত অনেক পরিবর্তনের আপনি সাক্ষী, সে ক্ষেত্রে আসলে আমি যে আজকে সব ভালো কথা বলব, তাও নয়। এই যে অ্যাগ্রেসিভনেসের কথা বলছিলাম, যখন প্রথম আলো শীর্ষে, এখনো শীর্ষে, তবু নতুন কোনো পত্রিকা বাজারে এলেই আপনারা একটু নেগেটিভ অ্যাটিচুড শো করেন। এমন একটি সমালোচনা আছে, যেটি আমার নিজস্ব কোনো কথা নয়, এটি কীভাবে আপনি দেখেন?
মতিউর রহমান: আমি বলব, আমার বিবেচনায় নতুন কোনো কাগজ এলে অবশ্যই আমরা তাকে শুভেচ্ছা জানাব, তাদের কাছে আশা করব, তারা সুসাংবাদিকতা করবে, তাদের জবাবদিহি থাকবে। তারা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই, কোনো অসুবিধা থাকার কারণ নেই। ধরেন, যদি কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করে, অযথা একটা আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়, সেখানেও আমরা যথেষ্ট নম্র ও বিনয়ী। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং পত্রিকার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অহেতুকই আক্রমণাত্মক হওয়ার কথা আমরা ভাবব না। কোনো পত্রিকা যদি আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ভিত্তিহীন তথ্য প্রদান করে, তা দিয়ে কিন্তু কোনো পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় না।
মুন্নী সাহা: কিছুদিন আগে ফেসবুকে আমারই এক সহকর্মী লিখেছিল, আমরা ওই কারণেই পত্রিকা কিনি বা পড়ি কি না। প্রথম আলো ও এর প্রতিপক্ষ আরেকটি পত্রিকার সমালোচনা প্রথম আলোর মূল্যবান জায়গায় একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে। অথবা সেই পত্রিকার একটি মূল্যবান অংশ বা পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে মতিউর রহমান বা প্রথম আলোকে নিয়ে সমালোচনা থাকে। আমরা আসলে পাঠক হিসেবে বঞ্চিত হচ্ছি। এই যে রেষারেষি, এটি আসলে কবে থেকে শুরু হয়েছিল। আপনাদের স্লোগান ছিল ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো’। সেই ভালো পত্রিকাটি যখন রিপোর্টিং শুরু করল ওই পত্রিকার পার্টিকুলার ম্যানেজমেন্ট বা তাদের দুর্নীতি নিয়ে। কিন্তু তার আগে ওই পত্রিকার বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আপনারা ছেপেছেন। তাহলে আসলে আমরা প্রথম আলোর কোন ভালোটা ধরব?
মতিউর রহমান: ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিশ্চয়ই রিপোর্ট হতে পারে। প্রশ্ন হলো, রিপোর্টটি আসলে ভুল, না শুদ্ধ। যদি ভুল হয়ে থাকে, সেটি অবশ্যই খারাপ, অন্যায় কাজ হবে। আমরা এমন কোনো রিপোর্ট ছাপিনি, যেটি ভুল। আমরা এমন কোনো জায়গা পত্রিকায় দিচ্ছি না, যেখানে একটি গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বরাদ্দ। গত ছয় মাস, তিন মাস কিংবা এক মাসে আমাদের পত্রিকায় কোনো গোষ্ঠী, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক বড় কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রী, সাংসদ, ব্যবসায়ী দুর্নীতি বা অন্যায় করে থাকেন, সেগুলো যদি খবর হয়ে থাকে, তবে তা খবর আকারে ছাপা হয়েছে। কিন্তু আপনি যে অভিযোগের কথা বললেন, বা পাঠকের অভিযোগ, সেটি আমি গ্রহণ করতে পারছি না।
মুন্নী সাহা: আজকে পত্রিকায় আপনার লেখা পড়েছি, সেখানে আপনি লিখেছেন, প্রথম আলো শুধু একটি পত্রিকায়ই নয়। এর চেয়েও বেশি কিছু। সেই বেশি কিছুর অনেক ক্যাম্পেইন আমরা দেখি এসিড, মাদক, নারী নির্যাতন—এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রথম আলো সামনে আছে। আসলে এ বিষয়গুলো কীভাবে পত্রিকার সঙ্গে সংযোজন করলেন। আমরা দেখতাম, এনজিওগুলো এ ধরনের কার্যক্রম করত। কিন্তু পত্রিকা হিসেবে এ ধরনের কাজ করার বিষয়ে আপনার আসলে কী ধারণা ছিল?
মতিউর রহমান: আমি একসময় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। দেশের জন্য, সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার দায়িত্ববোধ প্রায় সবারই থেকে থাকে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আসলে এ ধরনের কাজ করা।
আমরা যখন প্রথম আলো শুরু করলাম, তার আগেও যখন ভোরের কাগজ-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তখন থেকেই এ ধরনের কিছু কিছু কাজ শুরু করেছিলাম। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির প্রথম সংবাদ আমরা করেছিলাম। তাঁকে আমরা সাহায্য করেছিলাম জায়গা দিয়ে এবং একটি বাড়ি করে দিয়ে। এ ধরনের আরও অনেক কাজ করেছিলাম। নানা বিষয়ে গোলটেবিল আয়োজন করেছিলাম। আমরা সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এ দেশের নাগরিকও। আমরা কি শুধু পত্রিকায় লিখব, অন্যের ভুল ধরব, সমালোচনা করব!
একসময় আমাদের মনে হলো, কিছু বিষয় আছে, যেগুলো মানবিক ও অতি জরুরি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। সেগুলোতেও আমাদের সরাসরি কিছু করা দরকার। সেই থেকে একটি লক্ষ্য ও ভাবনা হিসেবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করলাম। আমরা নারীদের ওপর এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সভা, সেমিনার, আন্দোলন করে আসছি। ১০ বছর ধরে আমরা সরাসরি এই এসিডদগ্ধ নারীদের পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা করে আসছি। একইভাবে মাদককে না বলছি, ত্রাণ কার্যক্রম করছি। অদম্য মেধাবী, যারা অতিদরিদ্র তাদের খুঁজে বের করে বৃত্তি দেওয়া—এ ধরনের কাজগুলো করছি। আমরা দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব মনে করে কাজগুলো করে যাচ্ছি। সাংবাদিক বলে আমাদের মনে হয়েছে, এ দায়িত্বগুলো আরও বেশি করা উচিত। এ কাজগুলো যে শুধু পত্রিকায় আমরা করছি তা কিন্তু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পত্রিকাগুলো এ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। আমেরিকায়, ব্রিটেনে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকাগুলো কাজ করছে। কেউ হয়তো ক্রীড়া, কেউ আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজনে উৎসাহ দিয়ে থাকে। আমরা একটু মানবিক দিকগুলোর ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। আমরা মনে করি, এ ধরনের কাজ অব্যাহত থাকা উচিত। আরও বড় করা উচিত। এটি শুধু প্রথম আলোর কাজ নয়। প্রথম আলো ট্রাস্ট করে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে কাজগুলো করেছি, যেখানে সমাজে বিশিষ্টজনেরা আছেন। তাঁদের সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে এ কাজগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে।
মুন্নী সাহা: আপনি যেহেতু রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন বলেছেন। রাজনীতিতে একটি কথা আছে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। কিন্তু যখন আপনি সম্পাদক হিসেবে পত্রিকায় এলেন, তখন উল্টো। আপনি গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের মতো করেও প্রচার করার চেষ্টা করেছেন আপনি। কেন?
মতিউর রহমান: প্রথম আলো কয়েক শ সাংবাদিক নিয়ে একটি টিম হিসেবে কাজ করছে। একটি যৌথতা—ঐক্যবদ্ধ, মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিন্তু কোনো বড় কাজ করা সম্ভব নয়। যদি আজকে মনে করি, প্রথম আলো কিছুটা সফল হয়েছে, সেখানেও কিন্তু বিভিন্ন বিভাগের সবার সমবেত চেষ্টার মাধ্যমেই সফল হয়েছে, যার মাধ্যমে আজ আমরা এ অবস্থানে আসতে পেরেছি।
মুন্নী সাহা: তাহলে কি এ সিদ্ধান্ত সবাই মিলিতভাবে অথবা দলের চেয়ে একজন ব্যক্তি অভিজ্ঞ, যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ফজলে হাসান আবেদ—তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক স্বনামধন্য মানুষ। কথায় কথায় এ নামগুলো এল। এর বাইরেও কিছু নাম প্রথম আলো তৈরি করেছে।
মতিউর রহমান: যৌথতার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। একসময় রাজনীতিতে দেখেছি, যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা ছিল। আবার ব্যক্তির উদ্যোগও থাকতে হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ইত্যাদিতে একজন ব্যক্তি আসলে আসেন তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে। তিনি সেটি অন্যদের বোঝান, জানান। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তির গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। যেমন আমরা ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের নাম বলতে পারি। বিশ্বে যদি দেখি, আফ্রিকায় বর্ণবৈষ্যম্য নিরসনে একক নেতৃত্ব যিনি দিয়েছেন, তিনি হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। এই অবদান তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না। এ রকম বাংলাদেশেও আছে। তাঁদের কথা আমরা শুনি। আজ বাংলাদেশে যদি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কিছু করতে বলেন, অবশ্যই আমি সেটি করব। আমি মনে করি, এ ধরনের লোকজন সৎ, মানুষের কল্যাণ চান। আমি প্রায়ই বলি, ড. জাফর ইকবাল ও ড. কায়কোবাদের মতো আরও কিছু পাগল আমাদের দরকার। তাঁরা একদিন এসে আমাকে বললেন, আপনারা খেলা আর বিনোদন নিয়ে অনেক কিছু করেন, কিন্তু আমাদের শিক্ষা নিয়ে কিছু করতে হবে আপনাদের। আমি বলি, কী করতে হবে? তাঁরা সারা দেশে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করার জন্য বলেন। আজ তাঁদের জন্যই সারা দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিজ্ঞানমনস্ক ও গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের আরও ভূমিকা পালন করা দরকার। তাই ব্যক্তিগুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে চাই।
মুন্নী সাহা: আপনার এই ব্যক্তিগুরুত্বকে অনেকে ভুল বোঝেন। অনেকে মনে করেন, আপনি প্রচলিত রাজনীতির বিরাজনৈতিকীকরণের একজন প্রবর্তক। এ বিষয়ে অনেকে আপনাকে পছন্দ করেন না।
মতিউর রহমান: কে কী বলে, তাতে আমরা কান দিচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, দেশ পরিচালনা করবেন রাজনীতিকেরা, দেশ পরিচালিত হবে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে এটা প্রমাণিত যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে বিকল্প কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। যতই ভুলত্রুটি থাকুক না কেন, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে থাকতে হবে, চলতে হবে। নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হবে। এটি আমাদের সব সময়ের বিশ্বাস।
মুন্নী সাহা: অনেকে অভিযোগ করে, ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর ব্যাপারে আপনার হাত ছিল।
মতিউর রহমান: আমাদের কাগজে ৩ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদমাধ্যম নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বলেছি, প্রথম আলোয় প্রকাশিত সেই দুই বছর সময়ে আমরা যেসব লেখা ছেপেছিলাম, তা বই আকারে প্রকাশ করব। পাঠক যেন তা জানতে পারে, আমাদের ভূমিকা কী ছিল। আমরা কখনো সেনা শাসন, সামরিক শাসন চাইনি—প্রথম দিন থেকে। আমরা বারবার বলেছি, আমরা চাই গণতন্ত্র, নির্বাচন, নির্বাচিত সরকার। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত সারা দেশে হানাহানি, হত্যা, রক্তপাতের ঘটনা ছিল। সবাই এগুলো থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিল। সেই পটভূমিতে সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। দেশের অধিকাংশ মানুষ এই পরিবর্তনকে সমর্থন জানিয়েছিল। তবে এ তর্ক চলতে থাকবে এক দশক ধরে। হয়তো ওই পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমাদের সামনে খোলা ছিল না।
মুন্নী সাহা: ওই সময় আপনার অবস্থান কী ছিল?
মতিউর রহমান: আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্টে প্রথম আলো নিষিদ্ধ ছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান এই নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং পরে তা স্বীকার করেছিলেন। তো সে সময় আমাদের সম্পর্কে সেনাবাহিনীর এই ছিল অবস্থান। আমরা তো নিষিদ্ধ। আমাদের তো কোনো ভূমিকা রাখার প্রশ্নই ওঠে না, বরং নানাভাবে চাপের মধ্যে ছিলাম।
মুন্নী সাহা: এর পেছনে আসলে কী কারণ ছিল? এর প্রধান কারণ কি ছিল স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন বলে?
মতিউর রহমান: হ্যাঁ, অবশ্যই প্রথম আলো স্বাধীনভাবে লিখতে পারে। জেন ডিফেন্স উইকলি নামে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সামরিক জার্নাল আছে। ২০০৬ সালে সেই জার্নালে বাংলাদেশের তিন বাহিনী—বাংলাদেশের বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধানেরা তিনটি বড় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যেখানে আগামী ২০ বছরে আমাদের বাহিনীগুলোর পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড, অস্ত্র কেনা-সম্পর্কিত বিস্তৃত তথ্য দিয়েছিলেন। সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের কাগজে মিজানুর রহমান খান সমালোচনা করে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন। সে জন্যই প্রথম আলোর ব্যাপারে ওই ব্যবস্থা নিয়েছিল। আর ওই সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের ১৪ জন সাংবাদিককে সেনাক্যাম্পে নিয়ে ভয় দেখানো, চাপ প্রয়োগ, মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, মামলাও হয়েছিল। সে সময় আমাদের বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার করা হয়েছিল, সবই একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা হয়েছিল। একটি বিশেষ সংস্থার প্রচারণায় একটি উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আমাদের কাগজ বিক্রিতে বাধা দিয়েছে, বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রচারণা চালিয়েছে। সর্বশেষ আমাদের প্রথম আলোর সাত বছরের অ্যাকাউন্টসের সব কাগজ তারা নিয়ে গিয়ে এক বছর ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছু পায়নি। এগুলো তো কোনো সহযোগিতার উদাহরণ নয়। আমরা বরং অন্য যেকোনো পত্রিকার চেয়ে সে সময় বেশি চাপের মধ্যে ছিলাম।
মুন্নী সাহা: যত বেশি চাপ, সার্কুলেশন তত বাড়ে।
মতিউর রহমান: সত্যি কথা বলতে গেলে ২০০৭ থেকে ২০০৮—এই দুই বছরে আমাদের পত্রিকার ৭০ হাজার কপি বিক্রি বেড়েছিল, যা আগে কোনো এক বছর এত বাড়েনি।
মুন্নী সাহা: আমরা জানি, গণমাধ্যমের ওপর যখন চাপ আসে, তখন তার পাঠকদের আগ্রহ বাড়ে।
মতিউর রহমান: এটি সত্য কথা। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সত্য কথা বলতে গিয়ে চাপের মধ্যে থেকেছে বলেই প্রথম আলো এত এগিয়েছে। যদি কেউ বলে, আমরা ভুল করেছি, আমরা সে ভুল স্বীকার করি। জেনেশুনে যদি ভুল করি, তা বারবার আমরা স্বীকার করব। কিন্তু আমরা যা বিশ্বাস করে লিখেছি, যদি পাঠক গ্রহণ করে, সেগুলো আমরা অবশ্যই বারবার প্রকাশ করব। কারণ, পাঠকেরা তো আর এমনি এমনি আট টাকা দিয়ে কাগজ কিনে পড়েন না।
মুন্নী সাহা: এবার আমি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে একটা ব্যাপার বলতে চাই। আমি জানি, যখনই নারীদের বিষয় আসে, তখন আপনি বলেন, আমি সিস্টারদের পক্ষে। কিন্তু রাজনীতির বেলায় দেখেছি, খুবই অগুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ বা নতুন দল করার উদ্যোগকে আপনি সমর্থন করেছেন। আর দুই নেত্রীর বেলায় সব সময় আপনি ক্রিটিক্যাল, তাহলে কি আপনি মেয়েদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরোধী?
মতিউর রহমান: দেখুন, দুই দল, দুই নেত্রী, বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁরা দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ—এ কথা অস্বীকার করার কিছু নেই। তাঁদের পক্ষে যেমন অনেক কথা বলা যায়, তেমনি তাঁদের সমালোচনা করারও অনেক জায়গা আছে। এটি করা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব। তাঁরা ভালো কাজ করলে সেগুলো বলব; আবার ভুল করলে তার সমালোচনা করব। এ ক্ষেত্রে নারীবাদী বা নারীদের বিপক্ষে এটি দেখার কোনো অবকাশ নেই। তাঁরা দেশের জনগণের নেত্রী। তাঁদের কর্মদক্ষতা, ভালো-মন্দ, যোগ্যতা—এগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
মুন্নী সাহা: আপনি যেভাবে নতুন রাজনীতিবিদদের সহযোগিতা বা সমর্থন করেন, সেভাবে কিন্তু এই দুই নেত্রীর প্রতি যা-ই বলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে শ্রদ্ধা বা সমর্থন তেমন কিন্তু দেখা যায় না, যা প্রথম আলো পড়লে বোঝা যায়।
মতিউর রহমান: আপনি আসলে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি। আমরা আসলে সংবাদপত্র হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দলকেই সমর্থন বা সহযোগিতার পক্ষে নই। আমরা আসলে তাদের কাছে যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা করি, তা পূরণে তারা কতটুকু করতে পারছে, সেটিই আমাদের বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়। তাদের অনেক পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আবার তাদের বিভিন্ন স্তরের নেতা, এমপি কিংবা মন্ত্রীরা ভুল করলে তাঁদের সমালোচনা করি। উভয় দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা আমাদের গালমন্দ করেন, সমালোচনা করেন, মামলা করেন—যার কারণে বিভিন্ন স্থানে আদালতে যেতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের সংবাদ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব দেলোয়ার হোসেন, সাংসদ নাসিরুদ্দিন পিন্টুসহ অনেকের মামলাই কিন্তু আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আমরা নিশ্চিত, এই মামলাটিতেও আমরা জিতব এবং আদালতে তা খারিজ হয়ে যাবে। এটি কোনো পক্ষপাত, সমর্থন এগুলো কিছু নয়। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন বা উৎসাহ প্রদান করিনি। একসময় আমি একটি দলের জন্যই কাজ করেছিলাম বা যুক্ত ছিলাম। অন্য কোনো নতুন দলের হয়ে কোনো কাজ করিনি। ভবিষ্যতেও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মুন্নী সাহা: আপনার নিজের সাংবাদিকতার ৪০ বছর এবং প্রথম আলোর ১২ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক হুমকি ও চাপ নিশ্চয়ই এসেছে। আমরা জানি, সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। যত বেশি হুমকি, যত বেশি চাপ আসবে, তত বেশি সার্থকতা। এ ধরনের সার্থকতা ও সফলতার কথা যদি বলতেন।
মতিউর রহমান: সারা বিশ্বেই কিন্তু সাংবাদিকেরা এসব চাপ ও হুমকির মধ্যে থাকে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। যদি সরকার বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সাংবাদিকেরা মিলেমিশে একাকার হয়ে যান, তাহলে আলাদা করে সাংবাদিকতার কিছু থাকে না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিচারের মানদণ্ডে আমাদের সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো একটু নিচু অবস্থানে আছে।
বিভিন্ন সময় বা বিভিন্ন সরকারের সময় নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। সম্পাদক হিসেবে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার কথা বলতে পারি। সত্তরের জুলাইতে শুরু হয়ে একাত্তরের মার্চে এটি বন্ধ হয়ে গেল। বায়াত্তরে আবার শুরু করে চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে জরুরি আইনের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। আবার ’৭৯ সালে শুরু হয়ে ’৮৬ সালে এরশাদের আমলে আবার একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময়গুলোতে অনেক চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
’৯১-এর পর যখন ভোরের কাগজ-এ ছিলাম, তখন বিএনপি সরকার একবার আমাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিল। মিছিল-আন্দোলন করে ধীরে ধীরে আবার বিজ্ঞাপন পেলাম। আওয়ামী লীগ সরকার একসময় প্রথম আলোয় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিল। পরে আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় এল, কিছুদিন পরই তারা আমাদের বিজ্ঞাপন দৈনিক ১০ ইঞ্চিতে নামিয়ে নিয়ে এল। তখন আমরা মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আমরা কোনো তদবির নিয়ে আসিনি, আপনাদের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিচ্ছি, তবে একটি কথা বলি, যে সরকার বা প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে লেগে যায়, তার পতন হয়। আপনার মনে আছে, বিএনপি সরকারের লজ্জাজনকভাবে পতন হয়েছিল।
এ ধরনের চাপের মধ্যে সংবাদপত্রকে সব সময়ই থাকতে হয়। এসব থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তারপর প্রকাশ্যে অনেক রাজনীতিবিদ গালমন্দ করেন। সম্প্রতি সংসদে প্রথম আলো ও গণমাধ্যমকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ ধরনের অনেক চাপ ও হুমকি থেকেই যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও পাঠকের কাছে আমাদের কাগজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কে গালমন্দ করল, কে হুমকি দিল, কে বিজ্ঞাপন দিল না—এসব বিষয় নিয়ে আমরা ভয় পাই না। আমাদের সাংবাদিকতার কাজ, আমরা ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাব। আমরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করব। যদি ভুল হয়, আমরা সব সময় চেষ্টা করি, যে পৃষ্ঠার সংবাদের প্রতিবাদ হয়, প্রতিবাদ সেখানেই ছাপানোর জন্য বা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছাপাতে চেষ্টা করি। যদি ভুলটি যথাযথভাবে স্বীকার করেন, তবে মানুষ আপনাকে সম্মান করবে। মানুষ আপনাকে সৎ হিসেবে দেখতে চায়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি খাড়াখাড়ি দ্বিধাবিভক্তি দেখা যাচ্ছে। আমাদের সমাজেও এ বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিতে এমন বিভক্তি নিয়ে একটি দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।
মুন্নী সাহা: রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির কথা বলছেন। কিন্তু আমরা নতুন নেতৃত্ব তৈরির জায়গায় আপনার কোনো উদ্যোগ দেখিনি। এ সম্পর্কে আপনার মত কী?
মতিউর রহমান: যাঁরা রাজনীতি করবেন, দেশ পরিচালনা করবেন, তাঁদের একটি বিশেষ যোগ্যতা ও ধারা অর্জন করা দরকার। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংসদকে কেন্দ্র করে এ ধরনের যোগ্যতা বা ধারা তৈরির জন্য সহযোগিতা করছে। সংসদ কার্যকর করা, সাংসদদের আরও উন্নত করা—এসব বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর পরও আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আমাদের রাজনীতিবিদদের আরও উদ্যোগী, সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সঙ্গে এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করা উচিত।
মুন্নী সাহা: রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর জন্য আপনি কী উদ্যোগ নিয়েছেন? আমরা সাংবাদিকতায় জানি, ভালো খবর আসলে খবর নয়। আপনার ৪০ বছরের সাংবাদিকতার এই দীর্ঘ সময় বদলানো কথা বলছেন। এই বিভাজন কমানোর জন্য আপনারা কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না?
মতিউর রহমান: এই বিভাজন কমানোর কাজটি অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময়ের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেক দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, বিভেদ সৃষ্টি হয়ে গেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে। নিশ্চয়ই আমাদের দেশে এই গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে এমন কোনো নেতা, দল, প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হবে, যারা এই ভেদাভেদ, বিভাজন কাটিয়ে উঠে নতুন পথে যাত্রা শুরু করবে। এ কথাগুলো সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমাদের বলা উচিত। আমরা বলার চেষ্টা করছি।
সবার একটি সমবেত চেষ্টা থাকা উচিত বিভাজন কমানোর জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে যে অবস্থায় রয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়াও কঠিন। অনেকেই মনে করবেন, এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য বা স্বার্থ আছে। কিন্তু আমাদের এ ধরনের কোনো লক্ষ্য নেই। আমরা কিছু কিছু পরিবর্তন দেখছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বড় বড় ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। আমাদের সবাইকে ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
মুন্নী সাহা: আপনাদের একটি প্রচার কার্যক্রম আছে, আপনারা বলেন, ‘বদলে যাও, বদলে দাও’। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইব, আপনি কতটুকু বদলেছেন।
মতিউর রহমান: আমরা নিজেরা চেষ্টা করছি নিজেদের বদলে ফেলতে। চেষ্টা আসলে কি, আমাদের সৎ থাকতে হবে, আমরা হয়তো ১০০ ভাগ সৎ হতে না পারলেও সৎ থাকার চেষ্টা করছি। আমরা উদ্দেশ্যমূলক বা বস্তুনিষ্ঠতার অভাব রয়েছে, এমন সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকছি। আমি নিজে আরও একটু বেশি সহনশীল হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে আরও খোলামেলা আলোচনা করা, উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। কতটুকু সফল হয়েছি, তা আমার সহকর্মী বন্ধুরা বলতে পারবেন। আমাদের অফিসের ভেতর অবশ্যই একটি পরিবর্তন এসেছে। তা না হলে একজন ব্যক্তি বা সম্পাদকের পক্ষে বড় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সব কর্মীর মধ্যে সমঝোতা, সহযোগিতা ও সমন্বয় বেড়েছে। দুই বছর ধরে এগুলো বাড়ানোর আমরা চেষ্টা করছি নিজেদের মধ্যে। আমাদের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করছি।
মুন্নী সাহা: প্রথম আলো পত্রিকার অনেক কিছু বদলে গেছে, সেগুলো লক্ষ করেছি। কিন্তু একটি প্রসঙ্গে বলতে চাই, মানুষের ডাকনাম আপনি ছেঁটে দিচ্ছেন—এ প্রসঙ্গে আপনার মত কী?
মতিউর রহমান: একটি ডাকনাম মা-বাবা দেন তাঁর পরিবারের ভেতর ব্যবহারের জন্য। সেই ডাকনামটি বাইরে সবার মধ্যে প্রচার করা আমাদের কাছে পছন্দনীয় নয়। আবার এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন ১৯৬২ সাল থেকে রাশেদ খানের সঙ্গে মেনন যুক্ত হয়ে নামটি স্থায়ী হয়ে গেছে। যেমন সাদেক হোসেন খোকা কিংবা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক—এ নামগুলো অপরিবর্তিনীয় হয়ে গেছে। আবার উদাহরণ হিসেবে বলছি, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলেও কিন্তু আগে এ ধরনের ডাকনাম যুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা নেই। আমরা মনে করি, এই ডাকনাম ছেঁটে ফেলার মাধ্যমে একটি মানদণ্ডও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশেই আপনি পাবেন না যে, ডাকনামগুলো এমনভাবে ব্যবহূত হয়।
মুন্নী সাহা: আবার অনেক সময় দেখি, অনেক ডাকনাম ভালো নয়, তারা চায় না সেগুলো ব্যবহার করতে, কিন্তু মাঝেমধ্যে প্রথম আলোয় দেখা যায়।
মতিউর রহমান: যদি এ ধরনের হয়ে থাকে, তবে আমি মনে করি এটি ভুল, এর জন্য আমরা ভুল স্বীকার করছি। তখন হয়তো প্রয়োজন পড়ে, ডাকনাম দিয়ে সহজে যাতে মানুষ বুঝতে পারে পরিচয়।
মুন্নী সাহা: ব্যবসায়িক সফলতার অংশ বাদ দিয়ে প্রথম আলোর ১২ বছরের ব্যর্থতার কথা জানতে চাইছি আপনার কাছে।
মতিউর রহমান: নিশ্চয়ই আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে। তা না হলে কেন আমাদের সার্কুলেশন সাড়ে চার লাখ হবে, কেন আমাদের সার্কুলেশন সাত-আট লাখ হবে না। আমাদের দেশে এত লোকসংখ্যা, ক্রমে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, কিন্তু সে তুলনায় কেন পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ছে না। আমাদের সাংবাদিকদের যোগ্যতা, গুণগত মান আরও বাড়ানো উচিত বলে আমাদের মনে হয়। আমাদের সাংবাদিকদের নিয়ে আরও প্রশিক্ষণ, আলোচনার আয়োজন করা উচিত।
আজ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত কিংবা পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে সাংবাদিকেরা বড় বড় বই লেখেন। কিন্তু আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এ ধরনের আন্তর্জাতিক মানের বই লিখেছেন, সে উদাহরণ পাইনি। আমাদের সাংবাদিকদের নিজেদের তৈরি করা, বিষয়ের গভীরে বেশি করে যাওয়া, আরও পড়া, গবেষণা করা—এ বিষয়গুলো দরকার। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আছে।
মুন্নী সাহা: কাল প্রথম আলোর জন্মদিন। প্রথম আলোর বন্ধুসভাসহ সারা দেশের মানুষ এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনে উৎসবে মেতে উঠেছে। সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আজকাল আমরা দেখছি, একটি মিডিয়ার বা খবরের কাগজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে গোটা দেশ মাতামাতি করা শুরু করে নিজের জন্মদিন বা প্রিয়জনের জন্মদিন ভুলে গিয়ে। চ্যানেল আই দেখলে তো মনে হয়, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীও যে পাড়া-মহল্লায়, শিল্পকলায় হতে পারে, সেটা ভোলানোর জন্য তাদের চেষ্টার শেষ নেই। রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে চ্যানেলে...তাও আবার নাম হবে ‘চ্যানেল আই রবীন্দ্রজয়ন্তী’। আর বিখ্যাতজনেরা সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে হইহই করেন...এসব বিষয় নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই....আমরা তো বিবিসির জন্মদিন করতে শুনি না, জানি না টাইম ম্যাগাজিনের ২০ বছর কবে হলো...।
মতিউর রহমান: গণমাধ্যম একটি শক্তি, কারণ এটি সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এটি গণমাধ্যমের আগ্রাসী কোনো দিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন করা উচিত ছিল। কিংবা নাগরিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর দায়িত্ব নেওয়া দরকার ছিল এমন জাতীয় উৎসবগুলো আয়োজন করার। আমাদের ষাট থেকে আশির দশকে সামাজিক সংগঠনগুলো এসবের দায়িত্ব নিয়েছিল, সেগুলো বর্তমানে দুর্বল হয়ে গেছে। এর পেছনে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বিভক্তির কারণ উল্লেখযোগ্য। আমরা আজকে কেউ উদ্যোগ নিতে পারি না। কারণ সর্বত্র বিভক্তি দেখা যায়। আজকে সাংবাদিকদের দু-তিনটা ইউনিয়ন কিংবা জেলায় দু-তিনটা প্রেসক্লাব রয়েছে। সে জায়গায় আসলে গণমাধ্যমগুলোকে এগিয়ে এসে অনেক দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। আর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়। অনেক কিছুই হয়।
মুন্নী সাহা: প্রথম আলো ও সাংবাদিকতাকে আসলে কোথায় দেখতে চান? আপনার প্রত্যাশা কী?
মতিউর রহমান: আমাদের সাংবাদিকতার জগতের দীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। পঞ্চাশের দশকে আজাদ, সংবাদ, ষাটের দশকে ইত্তেফাক, তারপর আবার সংবাদ, একসময়ে অবজারভার কিংবা জনকণ্ঠর ভূমিকার কথা আমরা জানি। এ পত্রিকাগুলো কিন্তু বিভিন্ন সময় ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—এগুলোর ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা চাই এই ভূমিকাগুলো আরও বাড়াতে। এটি নির্ভর করে পত্রিকার পরিচালনা গোষ্ঠী, সাংবাদিকদের সততা, নিষ্ঠা ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ওপর। আমরা বলতে চাই, গণমাধ্যমের সবাইকেই নিজের দায়িত্ব পালনে সচেতন হওয়া এবং গণমাধ্যমকে কীভাবে ব্যবহার করছি সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে বলতে চাই, আমরা আরও সচেষ্ট হব, যাতে ভুল সংবাদ প্রকাশ না পায়। আমরা যেন অন্যায় না করি। সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সমাজে বিভেদ বিভাজন দূর হবে। রাজনৈতিক বিরোধ থাকবে, কিন্তু এটি বর্তমানে যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে।
মুন্নী সাহা: প্রথম আলো যেভাবে অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সে জন্য প্রথম আলোর এক যুগ পূর্তিতে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক ও সামাজিক যে বিরোধ রয়েছে, তা নিরসন হবে জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি আজকের আয়োজন।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
No comments