ইতিউতি-সেরার তালিকায় নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় by আতাউস সামাদ
আমার বাবা মরহুম আবদুস সামাদ যখন গ্র্যাজুয়েট হন, তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়নি। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আর সেই কলেজ তখন ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত। বাবার কাছে শুনেছি, ঢাকা কলেজ সেই সময় ছিল পুরনো হাইকোর্ট ভবনে। তিনি থাকতেন হোস্টেলে।
সেই হোস্টেল ছিল এখন যেটা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মূল ভবন সেটা। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন আমাদের কলা ভবন ছিল ওই হাসপাতালের সঙ্গে লাগানো। এখন সেই কলা ভবনও হাসপাতালের অংশ। আমি যা বলতে চাচ্ছি, তা হলো আমি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বটেই; আমার বাবা তা না হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকায়ই উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন।
আমার পরে আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আতিকুস সামাদ, বর্তমানে বিবিসির সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমার আপন ভাতিজা শহীদ লে. আশফাকুুস সামাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। আমাদের পরে আমার এক মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমার স্ত্রীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আর কটা ভাগ্নে ঢাকায় পড়াশোনা করেছে, তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের পরিবারে_আমরা একটা ছোটখাটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ছাত্রছাত্রী সমিতি গড়তে পারি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে বহুদিন_সম্ভবত ১৮ বছর, খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছি। তাই এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য আমাদের মধ্যে একটা বিশেষ টান আছে আর সে কারণেই এর সুখ্যাতি শুনলে খুশি হই। অন্যদিকে বদনাম হলে কষ্ট পাই। বাংলাদেশে আমাদের মতো এ রকম বহু পরিবার আছে।
দিনকয়েক আগে আরটিভির খবরে শুনলাম, পাশ্চাত্যের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এশিয়ার প্রথম ২০০টির মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। আর বিশ্বের সেরা ৫০০টির মধ্যেও আসছে না আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের নাম। খবরটা শুনে মন খারাপ হলো। এর আগেও একবার এ রকম খবর বেরিয়েছিল। তখন সেই সময়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেক ওপরে। বর্তমান প্রশাসনও হয়তো এ রকম কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা আমাদের দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান কেমন তা জানার আগে অবশ্য আমরা নিজেদের মনে নিশ্চিত হতে চাই যে এগুলো সত্যিই ভালো প্রতিষ্ঠান। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গটি একটু আলাদা বিবেচনা দাবি করে। কারণ এটা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয়ত, মহান ভাষা আন্দোলনের যাত্রা এখান থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাকিস্তানি হানাদারদের সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, বুদ্ধিজীবী হত্যার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পাকিস্তানিরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হানা দিয়ে গেছে। একজন বীরশ্রেষ্ঠ ও একজন বীর উত্তম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এককথায় দেশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয় এখান থেকেই। কাজেই চিন্তাচেতনা ও কাজে বাংলাদেশে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তৃতীয়ত, দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই একে নিয়ে আমরা যেমন গর্ব করি, তেমনি কোনো কারণে এর মান নেমে গেলে আমরা দুশ্চিন্তিত হই। আর তেমন যে ঘটেছে দুঃখের সঙ্গে হলেও তা মেনে নেওয়া ভালো। কারণ তাহলে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে ব্রতী হব। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন জায়গায় এবং এক পুনর্মিলনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সবাই একই ধরনের মত ব্যক্ত করলেন। সবাই চান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারও গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
এ জন্য কী করা দরকার, তা বর্তমান কর্ণধাররা জানেন না_এমন কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তা ছাড়া তেমন মন্তব্য করবই বা কেন? এখন যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই তো দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। তাঁদের নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবে আবার সে কথাও অস্বীকার করা যায় না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে যেসব সুতা টানা হয়, তাঁরা অনেকেই নিজেদের সেসব সুতার সঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন। তাঁদের পক্ষে স্বাধীনভাবে নিজের পথ বেছে নেওয়া কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ফিরে আসবে কি না, তা এখন নির্ভর করছে ওই সব সুতা যাঁরা টানেন তাঁদের সদিচ্ছার ওপর।
সেই তাঁরা যদি ইচ্ছুক হন, তাহলে প্রথমেই যা করতে পারেন তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নামধারীদের দাঙ্গা বন্ধ করা। আমার এক পুরনো বন্ধু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ক্লাস নেন। তাঁকে বলছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে ভয় করে। তিনি বললেন, 'আমাদের ভয় করে না। এর মধ্যেই কাজ করি। তবে সেদিন ক্লাস নিতে যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম দুই দল যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে একে অপরকে তাড়া করছে। গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম এই ভেবে যে এরা ঠাণ্ডা হয়ে এলে ক্লাসে যাব। কিন্তু না, তা হলো না; অপেক্ষা করতে করতে ক্লাসের সময় পার হয়ে গেল। দুঃখ লাগল একটা ক্লাস নষ্ট হলো বলে।' আশা করি, মাননীয় শিক্ষকের এ কথা শোনার পর সবাই বুঝবেন যে আমরা কিভাবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আমার পরে আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আতিকুস সামাদ, বর্তমানে বিবিসির সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমার আপন ভাতিজা শহীদ লে. আশফাকুুস সামাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। আমাদের পরে আমার এক মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমার স্ত্রীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আর কটা ভাগ্নে ঢাকায় পড়াশোনা করেছে, তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের পরিবারে_আমরা একটা ছোটখাটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ছাত্রছাত্রী সমিতি গড়তে পারি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে বহুদিন_সম্ভবত ১৮ বছর, খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছি। তাই এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য আমাদের মধ্যে একটা বিশেষ টান আছে আর সে কারণেই এর সুখ্যাতি শুনলে খুশি হই। অন্যদিকে বদনাম হলে কষ্ট পাই। বাংলাদেশে আমাদের মতো এ রকম বহু পরিবার আছে।
দিনকয়েক আগে আরটিভির খবরে শুনলাম, পাশ্চাত্যের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এশিয়ার প্রথম ২০০টির মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। আর বিশ্বের সেরা ৫০০টির মধ্যেও আসছে না আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের নাম। খবরটা শুনে মন খারাপ হলো। এর আগেও একবার এ রকম খবর বেরিয়েছিল। তখন সেই সময়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেক ওপরে। বর্তমান প্রশাসনও হয়তো এ রকম কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা আমাদের দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান কেমন তা জানার আগে অবশ্য আমরা নিজেদের মনে নিশ্চিত হতে চাই যে এগুলো সত্যিই ভালো প্রতিষ্ঠান। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গটি একটু আলাদা বিবেচনা দাবি করে। কারণ এটা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয়ত, মহান ভাষা আন্দোলনের যাত্রা এখান থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাকিস্তানি হানাদারদের সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, বুদ্ধিজীবী হত্যার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পাকিস্তানিরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হানা দিয়ে গেছে। একজন বীরশ্রেষ্ঠ ও একজন বীর উত্তম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এককথায় দেশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয় এখান থেকেই। কাজেই চিন্তাচেতনা ও কাজে বাংলাদেশে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তৃতীয়ত, দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই একে নিয়ে আমরা যেমন গর্ব করি, তেমনি কোনো কারণে এর মান নেমে গেলে আমরা দুশ্চিন্তিত হই। আর তেমন যে ঘটেছে দুঃখের সঙ্গে হলেও তা মেনে নেওয়া ভালো। কারণ তাহলে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে ব্রতী হব। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন জায়গায় এবং এক পুনর্মিলনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সবাই একই ধরনের মত ব্যক্ত করলেন। সবাই চান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারও গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
এ জন্য কী করা দরকার, তা বর্তমান কর্ণধাররা জানেন না_এমন কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তা ছাড়া তেমন মন্তব্য করবই বা কেন? এখন যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই তো দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। তাঁদের নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবে আবার সে কথাও অস্বীকার করা যায় না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে যেসব সুতা টানা হয়, তাঁরা অনেকেই নিজেদের সেসব সুতার সঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন। তাঁদের পক্ষে স্বাধীনভাবে নিজের পথ বেছে নেওয়া কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ফিরে আসবে কি না, তা এখন নির্ভর করছে ওই সব সুতা যাঁরা টানেন তাঁদের সদিচ্ছার ওপর।
সেই তাঁরা যদি ইচ্ছুক হন, তাহলে প্রথমেই যা করতে পারেন তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নামধারীদের দাঙ্গা বন্ধ করা। আমার এক পুরনো বন্ধু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ক্লাস নেন। তাঁকে বলছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে ভয় করে। তিনি বললেন, 'আমাদের ভয় করে না। এর মধ্যেই কাজ করি। তবে সেদিন ক্লাস নিতে যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম দুই দল যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে একে অপরকে তাড়া করছে। গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম এই ভেবে যে এরা ঠাণ্ডা হয়ে এলে ক্লাসে যাব। কিন্তু না, তা হলো না; অপেক্ষা করতে করতে ক্লাসের সময় পার হয়ে গেল। দুঃখ লাগল একটা ক্লাস নষ্ট হলো বলে।' আশা করি, মাননীয় শিক্ষকের এ কথা শোনার পর সবাই বুঝবেন যে আমরা কিভাবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments