স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ওয়াজেদ মিয়া by এম শামসুর রহমান
আজ বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ মিয়ার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
আমি ১৯৫৬-৫৮ সময়কালে রাজশাহী কলেজে আবদুল ওয়াজেদের সহপাঠী ছিলাম। আমরা দু'জনই বিজ্ঞানের ছাত্র। ওয়াজেদ সাহেব পড়তেন 'বি' সেকশনে।
আমি ১৯৫৬-৫৮ সময়কালে রাজশাহী কলেজে আবদুল ওয়াজেদের সহপাঠী ছিলাম। আমরা দু'জনই বিজ্ঞানের ছাত্র। ওয়াজেদ সাহেব পড়তেন 'বি' সেকশনে।
আমি 'এ' সেকশনে। তিনি থাকতেন ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের 'এ' ব্লকে। আমি 'ই' ব্লকে। উভয়ই উত্তরবাংলার বাসিন্দা। তার বাড়ি রংপুরে। আমার নওগাঁয়।
আজও চোখে ভাসছে, ছিপছিপে গড়নের লম্বা শ্যামবর্ণের এক ছেলে। স্বল্পভাষী। শান্ত স্বভাবের মানুষ। ক্লাসে যাচ্ছেন। ক্লাস থেকে হেঁটে হোস্টেলে ফিরছেন। ওই বয়সেই তার মধ্যে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করতেও দেখিনি তাকে। পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল তার সাদামাটা। পাজামা পরতেন। ফুলপ্যান্টের ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি। আমারও অভ্যাস ছিল তেমনটি। শীতকালে ক্লাসে যাওয়া-আসার সময় দেখেছি গায়ে ফুলহাতা গরম কাপড়ের শার্ট। কোট, জ্যাকেট তো দূরের কথা সোয়েটারও পরিধান করতেন না তিনি। হোস্টেল রুমে গায়ে গরম চাদর জড়িয়ে থাকতেন। বলা যেতে পারে, ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন সহজ, সরল এক আদর্শ শিক্ষার্থী।
পঞ্চাশের দশকের রাজশাহী কলেজ শিক্ষকদের ক'জনই বেঁচে আছেন। মনে জাগে এ মুহূর্তে, শ্রদ্ধাভাজন নিবেদিতপ্রাণ দু'জন শিক্ষকের স্মৃতি। বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী। কবীর চৌধুরী স্যার আমাদের পড়াতেন ড্রামা 'আব্রাহাম লিংকন'। ড. আশরাফ সিদ্দিকী স্যার 'জমিদার দর্পণ'।
ইন্টারমিডিয়েটের পর ওয়াজেদ সাহেব অনার্স পড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হলেন। আমি গণিতে অনার্স নিয়ে রাজশাহীতেই থেকে গেলাম। পরে ওয়াজেদ সাহেব বিদেশে পাড়ি জমালেন। আমিও ইংল্যান্ড এলাম। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপনা করলাম রাজশাহী, ইসলামাবাদ (পাকিস্তান), ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ড. ওয়াজেদ ঢাকার বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন। দেখতাম ঘন ঘন চা পান করছেন। এক সময় বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির সভাপতি পদেও অধিষ্ঠিত হলেন তিনি। আমিও হলাম বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি (২০০৮, ২০০৯ কার্যকাল)। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইতালির ত্রিয়েস্তের আন্তর্জাতিক তাত্তি্বক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্রের অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হয়েছিলেন ড. ওয়াজেদ। আমারও সৌভাগ্য হয়েছে ওই আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হওয়ার (১৯৯০-৯৫)। ত্রিয়েস্তে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ হয়েছে ১৯৮৩-এর আগস্টে।
ওয়াজেদ সাহেব বঙ্গবন্ধুর জামাতা এই সূত্র ছাড়াও আওয়ামী লীগের প্রতি আমার আকৃস্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। শেখ হাসিনা ও আমার স্ত্রী ঢাকায় আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল ও (বদরুন্নেসা) গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ালেখা করতেন। শেখ হাসিনা ছিলেন তার এক বছরের সিনিয়র। এই নেত্রীর প্রতি, দেখেছি, এক অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ তাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও আমি নওগাঁ কে ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আবদুল জলিলের এক বছরের সিনিয়র আমি। ১৯৬৬-৬৯-এর দিকে লন্ডনে তার অকৃপণ আতিথেয়তা ভোলা সহজ নয়। আবদুল জলিল একজন মহানুভব ব্যক্তি বললে অত্যুক্তি হবে না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজনবোধ করছি, নিকট অতীতে বঙ্গবন্ধু নিয়ে আমার কিছু লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে প্রকাশিত শ্রদ্ধাঞ্জলি ১৫ আগস্ট ২০০০ সম্পাদনা করেছি আমি।
পরমাণু বিজ্ঞানকে অপরিমেয় অবদানে সমৃদ্ধ করে তোলা এই স্বনামধন্য একনিষ্ঠ বিজ্ঞানসাধক, এই মনস্বী শিক্ষাবিদ, এই বড়মাপের মানুষটির ওপর ষাটোর্ধ্ব বয়সে ভর করল যত রোগশোক। তার জীবনপ্রদীপ নিভে দিল।
ড. ওয়াজেদের স্মৃতি জাগরূক রাখার লক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর শরীফ এনামুল কবিরের অকুণ্ঠ প্রচেষ্টায়, বলতে হয় এ প্রকল্প সার্থক রূপ লাভ করেছে।
জীবনমাত্রেরই মৃত্যু বিশ্বস্রষ্টার এক অমোঘ বিধান। কবির ভাষায়, 'জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে।' তাই মরণকে বরণ করে রংপুর পীরগঞ্জের ফতেপুর গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত সর্বজনপ্রিয় 'সুধা মিয়া' তার মহৎ কীর্তির উৎকর্ষেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে আমাদের স্মৃতিতে রইবেন সমুজ্জ্বল।
প্রফেসর এম শামসুর রহমান : সাবেক প্রফেসর গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আজও চোখে ভাসছে, ছিপছিপে গড়নের লম্বা শ্যামবর্ণের এক ছেলে। স্বল্পভাষী। শান্ত স্বভাবের মানুষ। ক্লাসে যাচ্ছেন। ক্লাস থেকে হেঁটে হোস্টেলে ফিরছেন। ওই বয়সেই তার মধ্যে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করতেও দেখিনি তাকে। পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল তার সাদামাটা। পাজামা পরতেন। ফুলপ্যান্টের ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি। আমারও অভ্যাস ছিল তেমনটি। শীতকালে ক্লাসে যাওয়া-আসার সময় দেখেছি গায়ে ফুলহাতা গরম কাপড়ের শার্ট। কোট, জ্যাকেট তো দূরের কথা সোয়েটারও পরিধান করতেন না তিনি। হোস্টেল রুমে গায়ে গরম চাদর জড়িয়ে থাকতেন। বলা যেতে পারে, ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন সহজ, সরল এক আদর্শ শিক্ষার্থী।
পঞ্চাশের দশকের রাজশাহী কলেজ শিক্ষকদের ক'জনই বেঁচে আছেন। মনে জাগে এ মুহূর্তে, শ্রদ্ধাভাজন নিবেদিতপ্রাণ দু'জন শিক্ষকের স্মৃতি। বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী। কবীর চৌধুরী স্যার আমাদের পড়াতেন ড্রামা 'আব্রাহাম লিংকন'। ড. আশরাফ সিদ্দিকী স্যার 'জমিদার দর্পণ'।
ইন্টারমিডিয়েটের পর ওয়াজেদ সাহেব অনার্স পড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হলেন। আমি গণিতে অনার্স নিয়ে রাজশাহীতেই থেকে গেলাম। পরে ওয়াজেদ সাহেব বিদেশে পাড়ি জমালেন। আমিও ইংল্যান্ড এলাম। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপনা করলাম রাজশাহী, ইসলামাবাদ (পাকিস্তান), ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ড. ওয়াজেদ ঢাকার বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন। দেখতাম ঘন ঘন চা পান করছেন। এক সময় বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির সভাপতি পদেও অধিষ্ঠিত হলেন তিনি। আমিও হলাম বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি (২০০৮, ২০০৯ কার্যকাল)। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইতালির ত্রিয়েস্তের আন্তর্জাতিক তাত্তি্বক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্রের অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হয়েছিলেন ড. ওয়াজেদ। আমারও সৌভাগ্য হয়েছে ওই আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হওয়ার (১৯৯০-৯৫)। ত্রিয়েস্তে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ হয়েছে ১৯৮৩-এর আগস্টে।
ওয়াজেদ সাহেব বঙ্গবন্ধুর জামাতা এই সূত্র ছাড়াও আওয়ামী লীগের প্রতি আমার আকৃস্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। শেখ হাসিনা ও আমার স্ত্রী ঢাকায় আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল ও (বদরুন্নেসা) গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ালেখা করতেন। শেখ হাসিনা ছিলেন তার এক বছরের সিনিয়র। এই নেত্রীর প্রতি, দেখেছি, এক অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ তাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও আমি নওগাঁ কে ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আবদুল জলিলের এক বছরের সিনিয়র আমি। ১৯৬৬-৬৯-এর দিকে লন্ডনে তার অকৃপণ আতিথেয়তা ভোলা সহজ নয়। আবদুল জলিল একজন মহানুভব ব্যক্তি বললে অত্যুক্তি হবে না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজনবোধ করছি, নিকট অতীতে বঙ্গবন্ধু নিয়ে আমার কিছু লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে প্রকাশিত শ্রদ্ধাঞ্জলি ১৫ আগস্ট ২০০০ সম্পাদনা করেছি আমি।
পরমাণু বিজ্ঞানকে অপরিমেয় অবদানে সমৃদ্ধ করে তোলা এই স্বনামধন্য একনিষ্ঠ বিজ্ঞানসাধক, এই মনস্বী শিক্ষাবিদ, এই বড়মাপের মানুষটির ওপর ষাটোর্ধ্ব বয়সে ভর করল যত রোগশোক। তার জীবনপ্রদীপ নিভে দিল।
ড. ওয়াজেদের স্মৃতি জাগরূক রাখার লক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর শরীফ এনামুল কবিরের অকুণ্ঠ প্রচেষ্টায়, বলতে হয় এ প্রকল্প সার্থক রূপ লাভ করেছে।
জীবনমাত্রেরই মৃত্যু বিশ্বস্রষ্টার এক অমোঘ বিধান। কবির ভাষায়, 'জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে।' তাই মরণকে বরণ করে রংপুর পীরগঞ্জের ফতেপুর গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত সর্বজনপ্রিয় 'সুধা মিয়া' তার মহৎ কীর্তির উৎকর্ষেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে আমাদের স্মৃতিতে রইবেন সমুজ্জ্বল।
প্রফেসর এম শামসুর রহমান : সাবেক প্রফেসর গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments