সংবিধান-মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হোক সংশোধনের মাপকাঠি by আবু সাঈদ খান
সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হলে তা হবে মঙ্গলজনক। তবে সেটি হতে হবে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দুই দল একমত হয়ে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দেয়, তবে তা কারও কাম্য হতে পারে না।
আমরা সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ কামনা করি, তাই বলে তারা এগিয়ে না এলে যৌক্তিক সংশোধনী আনা হবে না, তা মনে করি না
দেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ সংবিধান সংশোধন। মূলত পঞ্চম সংশোধনীর ওপর সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে '৭২-এর সংবিধানের মৌল কাঠামো পুনরুজ্জীবিত করার পর সংবিধান নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে সংসদ বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। বিশেষ কমিটি বিচারক, আইনজ্ঞ, রাজনীতিক, পত্রিকার সম্পাদক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিশেষ কমিটিতে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়নি। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির প্রতিনিধিরা কমিটিতে উপস্থিত হয়ে তাদের মতামত দেওয়ার আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি তারা বিশেষ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তবে বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য থেকে যে বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তা হলো, '৭২-এর সংবিধানের মূল কাঠামোয় যেতে তারা নারাজ। সংবিধানের শিরোনামে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' এবং রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষেই রয়েছেন।
আরও একটি আলোচিত বিষয়_ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা, না রাখা বা এর সংস্কার। এ প্রশ্নে বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে আছে সেভাবেই রাখতে হবে। তবে ক্ষমতাসীন জোটের প্রস্তাব অনুসারে ৯০ দিন সীমা নির্ধারণ কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি সংকুচিত করার কোনো উদ্যোগে তারা আপত্তি করবে না বলে অনুমিত হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব অনুযায়ী ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলে পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করছেন তারা। অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া রোধে কোনো বিধান প্রবর্তনে তাদের দ্বিমত নেই বলে ধরে নেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে আস্থার সমস্যা থাকলেও নীতিগতভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির খুব বেশি তফাত আছে বলে মনে হচ্ছে না।
সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম বিধান, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অধিকার প্রশ্নে মহাজোটের শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রবল আপত্তি থাকলেও আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে প্রকাশিত সংবিধানে (যেটিকে এখন খসড়া সংবিধান বলা হচ্ছে) পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযুক্ত 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' এবং অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম বিধানও সনি্নবেশিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ফরমানে সংসদে পঞ্চম সংশোধনী গ্রহণকালে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ ও ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিল। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ফরমানে রাষ্ট্রধর্ম আইন প্রণয়নকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল রাজপথের সংগ্রামে শামিল ছিল। সেদিন দুই প্রধান দলই এই বিধানের সমালোচনা করেছিল। আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত বাম দলগুলোর দৃষ্টিতে এসব পদক্ষেপ ছিল স্বৈরশাসকের অপকর্ম। দলগুলো পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম সংশোধনী বাতিলের ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার থেকেছে। বিএনপিও অগণতান্ত্রিক বিধান বাতিলের প্রশ্নে ইতিবাচক বক্তব্যই রেখেছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল এবং বাম ৫ দল প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব বিধান বাতিলের কথা। দুই দলই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গৌরবগাথা নিয়ে কাড়াকাড়িও করছে। তাই খতিয়ে দেখা যেতে পারে যে, কোনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কোনটি নয়; কিংবা কোনটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী, কোনটি নয়। এই সুস্থধারার বিতর্ক হলে তা হবে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করে; কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। সেটি থাকলে তা হয় অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। এ বিবেচনায় '৭২-এর সংবিধানের অন্যতম নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করা হয়।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। ধর্মের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই বৈষম্যের অবসান চেয়েছি, সমমর্যাদা অর্জনের জন্য হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে; বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, খাসিয়া প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। একাত্তরে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গড়েছি। বলাবাহুল্য, আমরা কোনো ধর্মরাষ্ট্র গড়িনি।
আমরা পাকিস্তানের ২৪ বছর ধর্মের নামে শাসন-শোষণ প্রত্যক্ষ করেছি। ধর্ম রক্ষার নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা সেদিন নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, ৩০ লাখ নর-নারীকে হত্যা করেছে, ৩ লাখ মা-বোনকে লাঞ্ছিত করেছে। ধর্মান্ধতার সেই বীভৎসতার পুনরাবৃত্তি রোধে সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার রাষ্ট্রীয় নীতি মুক্তিযুদ্ধের অর্জন। এ অর্জন কেউই মুছে ফেলতে পারে না। অতিসম্প্রতি প্রধান বিচারপতি যথার্থই বলেছেন, সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারেও মুক্তিযুদ্ধের অর্জন সুরক্ষার কথা বলেছে। এখন ভাবনার বিষয়, ক্ষমতাসীনদের প্রস্তাব অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম কি একই সঙ্গে কার্যকর থাকতে পারে?
'৭২-এর সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে (যা আদালতের রায়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে) উল্লেখ আছে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাদের ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।' এই নীতি সংবিধানের কোনো ধর্মীয় প্রলেপ অনুমোদন করে না। তারপরও যদি এমন গোঁজামিল দেওয়া হয়, তবে তা হবে সুকুমার রায়ের সেই ছড়ার মতো_ 'হাঁস ছিল, সজারু/(ব্যাকরণ মানি না)/হয়ে গেল হাঁসজারু/কেমনে তা জানি না।'
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ যেমন কোনো ধর্মরাষ্ট্র নয়, তেমনি কোনো জাতিরাষ্ট্রও নয়। এটি বাংলাদেশে বসবাসকারী সব ধর্মের, সব জাতির রাষ্ট্র। কিন্তু '৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছিল, জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করা ছিল সংখ্যালঘু জাতিগুলোর প্রতি বৈরী আচরণ। পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে বাঙালি করার ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দিয়েছিল, রূপ নিয়েছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের। সুখকর ঘটনা হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলে শান্তিচুক্তি সশস্ত্র সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়েছে। তবে পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদের জাতিসত্তা এবং সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ৯নং অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে বাঙালি জাতির পাশাপাশি আদিবাসীদের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা সংবিধানের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী হবে না, বরং হবে সঙ্গতিপূর্ণ।
সংবিধানের অন্যতম 'রাষ্ট্রীয় নীতি' সমাজতন্ত্র নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক তুলেছেন। তাদের কথা হচ্ছে, দেশে আজ মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু রয়েছে। সেখানে সমাজতন্ত্র বেমানান। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা যায়, মুক্তবাজার কি উন্নয়নের যৌক্তিক পদক্ষেপ? এর আগে মুক্তবাজারের দোহাই পেড়ে কৃষি, শিল্প থেকে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রের শিক্ষা ও সেবাখাতকে সংকুচিত করা হয়েছিল, যা জাতীয় অগ্রগতির চাকাকে ব্যাহত করেছে। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই তাদের শাসনামলে অভিজ্ঞতার আলোকে কৃষিখাতে ভর্তুকি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবাখাতের দিকে নজর বাড়িয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকার কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকতর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের উদ্যোগী হয়েছে, এটি তাদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত পদক্ষেপ। তবে এ উদ্যোগই শেষ কথা নয়, আরও বহু দূর তাকাতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। এখানে অবাধ পুঁজির শোষণ মানুষের জন্য কতখানি কল্যাণ বয়ে আনবে? এ ক্ষেত্রে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের বিকল্প নেই। নিদেনপক্ষে সমাজতন্ত্রের অভিমুখী একটি কৃষক-শ্রমিক-গরিববান্ধব নীতি গ্রহণ কি যুক্তিযুক্ত নয়? সেই বিবেচনায় সমাজতন্ত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রেখে জনস্বার্থে কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই যৌক্তিক।
সংবিধানের চার নীতির অন্যতম 'গণতন্ত্র'। যেটি নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো তাত্তি্বক বিরোধ নেই। কিন্তু ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে গণতন্ত্র বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন অপশাসকের স্বার্থে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কালাকানুন, যা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের পথে বাধা। বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে ক্ষমতার পুঞ্জীভবন ঘটেছে, সেটি কি গণতন্ত্রের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে সরকারপ্রধান, দলীয়প্রধান ও সংসদ নেতা থাকতে পারেন। অনেক দেশেই আইনি বাধা না থাকলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে কোনো ব্যক্তি এই তিন পদে থাকছেন না। ভারতের কথাই বলা যাক_ মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী, সোনিয়া গান্ধী দল ও মোর্চাপ্রধান এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় লোকসভা নেতা। ক্ষমতার এই বণ্টন গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যও জরুরি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করার বিধানের স্থলে মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শক্রমে কার্যপরিচালনার প্রস্তাবটিও বিবেচনায় আনা যায়।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদও গণতন্ত্র বিকাশের প্রতিবন্ধক। এই খড়্গের নিচে থেকে সংসদ সদস্যরা তাদের মত প্রকাশ করতে পারছেন না। কারণ দলের পক্ষে ভোট না দিলে সদস্যপদ হারানোর নিয়ম আছে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ভয় থেকে সাংসদদের নিষ্কৃতি দেওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হবে। এ আলোকে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হলে তা হবে একধাপ অগ্রগতি।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের দাবিটি এ সংশোধনীর প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। নারী সদস্যের সংখ্যা বাড়িয়ে দেড়শ'তে উন্নীত করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট করে উচ্চকক্ষে শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্ব থাকলে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে পারে।
এ লেখায় সংবিধান পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। আমি পরিশেষে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অনালোচিত বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। '৯০-এর পর গত দুই দশকে আমি প্রস্তাবটি বেশ কয়েকবার তুলে ধরেছি। সেটি হলো, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। দলগুলো সমগ্র দেশে প্রাপ্য ভোটের অনুপাতে সংসদের সদস্যলাভ করবে, যেটি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দুটিরই সংমিশ্রণও হতে পারে। যেমন ধরা যাক, এলাকাভিত্তিক ৩০০ আসন এবং সংখ্যানুপাতিকভাবে আরও ৩০০ আসন। সে ক্ষেত্রে সংসদ হতে পারে ৬০০ আসনবিশিষ্ট। এ বিধান অধিকতর গণতান্ত্রিক। এটি করা হলে চিন্তায় অগ্রসর ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের মধ্যে সদস্য সংখ্যায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য ক্ষমতার এ ভারসাম্য অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলতে চাই, সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হলে তা হবে মঙ্গলজনক। তবে সেটি হতে হবে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দুই দল একমত হয়ে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দেয়, তবে তা কারও কাম্য হতে পারে না। আমরা সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ কামনা করি, তাই বলে তারা এগিয়ে না এলে যৌক্তিক সংশোধনী আনা হবে না, তা মনে করি না।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
দেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ সংবিধান সংশোধন। মূলত পঞ্চম সংশোধনীর ওপর সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে '৭২-এর সংবিধানের মৌল কাঠামো পুনরুজ্জীবিত করার পর সংবিধান নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে সংসদ বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। বিশেষ কমিটি বিচারক, আইনজ্ঞ, রাজনীতিক, পত্রিকার সম্পাদক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিশেষ কমিটিতে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়নি। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির প্রতিনিধিরা কমিটিতে উপস্থিত হয়ে তাদের মতামত দেওয়ার আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি তারা বিশেষ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তবে বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য থেকে যে বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তা হলো, '৭২-এর সংবিধানের মূল কাঠামোয় যেতে তারা নারাজ। সংবিধানের শিরোনামে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' এবং রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষেই রয়েছেন।
আরও একটি আলোচিত বিষয়_ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা, না রাখা বা এর সংস্কার। এ প্রশ্নে বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে আছে সেভাবেই রাখতে হবে। তবে ক্ষমতাসীন জোটের প্রস্তাব অনুসারে ৯০ দিন সীমা নির্ধারণ কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি সংকুচিত করার কোনো উদ্যোগে তারা আপত্তি করবে না বলে অনুমিত হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব অনুযায়ী ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলে পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করছেন তারা। অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া রোধে কোনো বিধান প্রবর্তনে তাদের দ্বিমত নেই বলে ধরে নেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে আস্থার সমস্যা থাকলেও নীতিগতভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির খুব বেশি তফাত আছে বলে মনে হচ্ছে না।
সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম বিধান, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অধিকার প্রশ্নে মহাজোটের শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রবল আপত্তি থাকলেও আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে প্রকাশিত সংবিধানে (যেটিকে এখন খসড়া সংবিধান বলা হচ্ছে) পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযুক্ত 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' এবং অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম বিধানও সনি্নবেশিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ফরমানে সংসদে পঞ্চম সংশোধনী গ্রহণকালে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ ও ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিল। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ফরমানে রাষ্ট্রধর্ম আইন প্রণয়নকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল রাজপথের সংগ্রামে শামিল ছিল। সেদিন দুই প্রধান দলই এই বিধানের সমালোচনা করেছিল। আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত বাম দলগুলোর দৃষ্টিতে এসব পদক্ষেপ ছিল স্বৈরশাসকের অপকর্ম। দলগুলো পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম সংশোধনী বাতিলের ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার থেকেছে। বিএনপিও অগণতান্ত্রিক বিধান বাতিলের প্রশ্নে ইতিবাচক বক্তব্যই রেখেছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল এবং বাম ৫ দল প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব বিধান বাতিলের কথা। দুই দলই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গৌরবগাথা নিয়ে কাড়াকাড়িও করছে। তাই খতিয়ে দেখা যেতে পারে যে, কোনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কোনটি নয়; কিংবা কোনটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী, কোনটি নয়। এই সুস্থধারার বিতর্ক হলে তা হবে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করে; কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। সেটি থাকলে তা হয় অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। এ বিবেচনায় '৭২-এর সংবিধানের অন্যতম নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করা হয়।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। ধর্মের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই বৈষম্যের অবসান চেয়েছি, সমমর্যাদা অর্জনের জন্য হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে; বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, খাসিয়া প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। একাত্তরে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গড়েছি। বলাবাহুল্য, আমরা কোনো ধর্মরাষ্ট্র গড়িনি।
আমরা পাকিস্তানের ২৪ বছর ধর্মের নামে শাসন-শোষণ প্রত্যক্ষ করেছি। ধর্ম রক্ষার নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা সেদিন নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, ৩০ লাখ নর-নারীকে হত্যা করেছে, ৩ লাখ মা-বোনকে লাঞ্ছিত করেছে। ধর্মান্ধতার সেই বীভৎসতার পুনরাবৃত্তি রোধে সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার রাষ্ট্রীয় নীতি মুক্তিযুদ্ধের অর্জন। এ অর্জন কেউই মুছে ফেলতে পারে না। অতিসম্প্রতি প্রধান বিচারপতি যথার্থই বলেছেন, সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারেও মুক্তিযুদ্ধের অর্জন সুরক্ষার কথা বলেছে। এখন ভাবনার বিষয়, ক্ষমতাসীনদের প্রস্তাব অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম কি একই সঙ্গে কার্যকর থাকতে পারে?
'৭২-এর সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে (যা আদালতের রায়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে) উল্লেখ আছে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাদের ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।' এই নীতি সংবিধানের কোনো ধর্মীয় প্রলেপ অনুমোদন করে না। তারপরও যদি এমন গোঁজামিল দেওয়া হয়, তবে তা হবে সুকুমার রায়ের সেই ছড়ার মতো_ 'হাঁস ছিল, সজারু/(ব্যাকরণ মানি না)/হয়ে গেল হাঁসজারু/কেমনে তা জানি না।'
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ যেমন কোনো ধর্মরাষ্ট্র নয়, তেমনি কোনো জাতিরাষ্ট্রও নয়। এটি বাংলাদেশে বসবাসকারী সব ধর্মের, সব জাতির রাষ্ট্র। কিন্তু '৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছিল, জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করা ছিল সংখ্যালঘু জাতিগুলোর প্রতি বৈরী আচরণ। পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে বাঙালি করার ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দিয়েছিল, রূপ নিয়েছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের। সুখকর ঘটনা হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলে শান্তিচুক্তি সশস্ত্র সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়েছে। তবে পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদের জাতিসত্তা এবং সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ৯নং অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে বাঙালি জাতির পাশাপাশি আদিবাসীদের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা সংবিধানের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী হবে না, বরং হবে সঙ্গতিপূর্ণ।
সংবিধানের অন্যতম 'রাষ্ট্রীয় নীতি' সমাজতন্ত্র নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক তুলেছেন। তাদের কথা হচ্ছে, দেশে আজ মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু রয়েছে। সেখানে সমাজতন্ত্র বেমানান। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা যায়, মুক্তবাজার কি উন্নয়নের যৌক্তিক পদক্ষেপ? এর আগে মুক্তবাজারের দোহাই পেড়ে কৃষি, শিল্প থেকে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রের শিক্ষা ও সেবাখাতকে সংকুচিত করা হয়েছিল, যা জাতীয় অগ্রগতির চাকাকে ব্যাহত করেছে। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই তাদের শাসনামলে অভিজ্ঞতার আলোকে কৃষিখাতে ভর্তুকি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবাখাতের দিকে নজর বাড়িয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকার কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকতর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের উদ্যোগী হয়েছে, এটি তাদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত পদক্ষেপ। তবে এ উদ্যোগই শেষ কথা নয়, আরও বহু দূর তাকাতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। এখানে অবাধ পুঁজির শোষণ মানুষের জন্য কতখানি কল্যাণ বয়ে আনবে? এ ক্ষেত্রে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের বিকল্প নেই। নিদেনপক্ষে সমাজতন্ত্রের অভিমুখী একটি কৃষক-শ্রমিক-গরিববান্ধব নীতি গ্রহণ কি যুক্তিযুক্ত নয়? সেই বিবেচনায় সমাজতন্ত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রেখে জনস্বার্থে কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই যৌক্তিক।
সংবিধানের চার নীতির অন্যতম 'গণতন্ত্র'। যেটি নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো তাত্তি্বক বিরোধ নেই। কিন্তু ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে গণতন্ত্র বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন অপশাসকের স্বার্থে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কালাকানুন, যা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের পথে বাধা। বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে ক্ষমতার পুঞ্জীভবন ঘটেছে, সেটি কি গণতন্ত্রের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে সরকারপ্রধান, দলীয়প্রধান ও সংসদ নেতা থাকতে পারেন। অনেক দেশেই আইনি বাধা না থাকলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে কোনো ব্যক্তি এই তিন পদে থাকছেন না। ভারতের কথাই বলা যাক_ মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী, সোনিয়া গান্ধী দল ও মোর্চাপ্রধান এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় লোকসভা নেতা। ক্ষমতার এই বণ্টন গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যও জরুরি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করার বিধানের স্থলে মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শক্রমে কার্যপরিচালনার প্রস্তাবটিও বিবেচনায় আনা যায়।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদও গণতন্ত্র বিকাশের প্রতিবন্ধক। এই খড়্গের নিচে থেকে সংসদ সদস্যরা তাদের মত প্রকাশ করতে পারছেন না। কারণ দলের পক্ষে ভোট না দিলে সদস্যপদ হারানোর নিয়ম আছে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ভয় থেকে সাংসদদের নিষ্কৃতি দেওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হবে। এ আলোকে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হলে তা হবে একধাপ অগ্রগতি।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের দাবিটি এ সংশোধনীর প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। নারী সদস্যের সংখ্যা বাড়িয়ে দেড়শ'তে উন্নীত করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট করে উচ্চকক্ষে শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্ব থাকলে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে পারে।
এ লেখায় সংবিধান পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। আমি পরিশেষে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অনালোচিত বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। '৯০-এর পর গত দুই দশকে আমি প্রস্তাবটি বেশ কয়েকবার তুলে ধরেছি। সেটি হলো, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। দলগুলো সমগ্র দেশে প্রাপ্য ভোটের অনুপাতে সংসদের সদস্যলাভ করবে, যেটি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দুটিরই সংমিশ্রণও হতে পারে। যেমন ধরা যাক, এলাকাভিত্তিক ৩০০ আসন এবং সংখ্যানুপাতিকভাবে আরও ৩০০ আসন। সে ক্ষেত্রে সংসদ হতে পারে ৬০০ আসনবিশিষ্ট। এ বিধান অধিকতর গণতান্ত্রিক। এটি করা হলে চিন্তায় অগ্রসর ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের মধ্যে সদস্য সংখ্যায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য ক্ষমতার এ ভারসাম্য অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলতে চাই, সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হলে তা হবে মঙ্গলজনক। তবে সেটি হতে হবে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দুই দল একমত হয়ে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দেয়, তবে তা কারও কাম্য হতে পারে না। আমরা সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ কামনা করি, তাই বলে তারা এগিয়ে না এলে যৌক্তিক সংশোধনী আনা হবে না, তা মনে করি না।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments