বাঘা তেঁতুল-সরকারের সত্যাচার by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আগামীকাল ঈদ। এবার প্রধানমন্ত্রীর ঈদের শুভেচ্ছা তাঁর অফিসের কর্মকর্তারা ১২ নভেম্বরের কয়েক দিন আগেই বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এবার ঈদে বেগম জিয়া কোথায় কোন ঠিকানায় থাকেন, সেই অনিশ্চয়তা থেকে সম্ভবত একটু আগেই ঈদের শুভেচ্ছা পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী তাঁর ঈদের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীকে পাঠাতে পেরেছেন কি না তা কাগজে দেখিনি।
পুরোনো বাড়িঘর ছেড়ে নতুন কোনো বাড়িতে যাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ রয়েছে। বেগম জিয়া এবার নতুন বাড়িতে ঈদ করবেন। এটা বিশ্বায়নের যুগ। আমাদের পৃথিবীর নতুন নাম হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজ—বৈশ্বিক গ্রাম। তাঁর দুই ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনিরা ঈদ করবেন দুই ভিনদেশে। সুতরাং এবার তাঁর আনন্দের শেষ নেই।
আমাদের দেশের উন্নততর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক দলের নেতা অন্য দলের নেতাকে কোনো কারণেই ধন্যবাদ জানান না। এমনকি যদি কেউ মাঘ মাসে অক্সিজেন ছাড়া হিমালয়ের চূড়ায় ওঠেন অথবা ডিঙি নৌকায় আটলান্টিক পাড়ি দেন, তবু তাঁকে তাঁর প্রতিপক্ষ অভিনন্দন জানাবেন না। কিন্তু আনন্দের সঙ্গে পুরোনো বাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাওয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সরকারি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ এক নজিরহীন নম্র ও উদার আচরণ। খামাকা ধন্যবাদ জানানো হয়নি। ধন্যবাদ তিনি পেয়েছেন ‘সামরিক ভূসম্পত্তি বিভাগের সিদ্ধান্ত এবং আদালতের রায়ে সেনানিবাসের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ায়।’
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) খালেদা জিয়াকে খোশ আমদেদ জানিয়েছেন, ‘বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন’ বলে। অর্থাৎ গৃহত্যাগের প্রথম দিন বেগম জিয়ার ওপর নানা দিক থেকে অভিনন্দন বর্ষিত হয়।
শ্লেষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ব্যাপারগুলো কথাশিল্পী ও কলাম লেখক যখন করেন, তখন মানুষ কিছু মনে করে না। বরং উপভোগ করে। হাসে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন ব্যক্তিকে নিয়ে রগড় করে, তখন তা কিছু লোক উপভোগ করলেও দেশের কোটি কোটি মানুষের তাতে গা জ্বালা করে। সরকার কার গলায় মালা পরাবে আর কার গলায় সজোরে ধাক্কা দেবে, তা সরকারের এখতিয়ার ও অভিরুচি। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যখন কাউকে নিয়ে রগড় করে, তখন তা মানুষের ব্রহ্মতালুতে গিয়ে আঘাত করে।
প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তাই হোন আর কোনো বিভাগের জনসংযোগের কর্মকর্তাই হোন, তাঁরা যে মজুরি-ভাতা পান, যা দিয়ে তাঁরা পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ করেন, সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠান বা চিরকালের জন্য আমেরিকায় পাঠান, তা শুধু আওয়ামী লীগের ভোটাররা দেন না। বেগম জিয়ার সমর্থকেরাও দেন। চাকরির মেয়াদ শেষে যে পেনশন মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচ বছর তার পরিবার পায়, সেটাও কোনো দলের তহবিল থেকে দেওয়া হয় না। দেশের মানুষ দেয়। সাংবাদিকদের সামনে দলের নেতারা নোংরা ভাষায় কথা বলতে পাবেন, তাঁর দায়িত্ব তাঁর, কিন্তু কর্মচারীদের সে অধিকার নেই।
গৃহত্যাগের পর রাতটি না পোহাতেই তাঁকে যে মোবারকবাদ জানানো হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়। খালেদা জিয়া ‘সেজেগুজে’, ‘অকথ্য ভাষায়’, ‘সেনাবাহিনীকে গালিগালাজ’ করেছেন, তা এক কর্মচারীর মুখে শোনা গেল। যাঁরা তাঁকে সসম্ভ্রমে গাড়িতে তুলে দিয়ে ‘বাই বাই’ বলতে গিয়েছিলেন, তিনি নাকি শাসিয়েছেন, ‘আমি সবার চেহারা চিনে রাখছি,...।’ বাস্তবতা হলো, সেদিন তিনি সাজগোজ করতে গিয়ে টেলিভিশন দেখার ফুরসত পাননি। টেলিভিশন দেখেছে বাংলার মানুষ। যদি চিনে রাখারই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সেদিনের ভদ্রলোকদের বাংলার মানুষই চিনে রেখেছে।
জাতি হিসেবে আমরা এমন একটি সমষ্টিগত স্বভাব অর্জন করেছি। যেকোনো ধরনের কুৎসিত ও নিষ্ঠুর ঘটনা আমাদের গভীর আনন্দ দেয়। পৈশাচিক আনন্দে আমরা প্রত্যেকেই অভ্যস্ত। কাল যদি বঙ্গবন্ধু সেতুটি ধসে পড়ে, কিছু লোক হয়তো আনন্দে ফেটে পড়বে। তখন সাড়ে তিন কোটি লোক বলবে, আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালের মধ্যে খালেদা জিয়া যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তার কারণেই এটা ধসে পড়েছে। অন্য সাড়ে তিন কোটি বলবে, ব্রিজের কাজ শেষ করেছিল হাসিনার সরকার। তাই আজ ধসে পড়ল।
বাড়িঘর, জোত-জমির মালিকানা শরিকানা আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার বিষয়। পুরোনো ও নব্য কলাম লেখকেরা এ নিয়ে পত্রিকার পাতাই শুধু ভরাট করতে পারেন। আসল কথা বলতে পারেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা—তাঁর দলীয় দায়বদ্ধতা ও আনুগত্য যা-ই হোক। অ্যাটর্নি জেনারেল গৃহত্যাগের পরদিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ওপরে আর কোনো কথা হয় না। তিনি বলেছেন, মামলায় জিতলে খালেদা জিয়া বাড়ি ফিরে পাবেন। কথাটা এক শ ভাগ সত্যি। তিনি জানিয়ে দিলেন, মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, সেটা হবে ২৯ নভেম্বর। আনন্দে ঈদ করার জন্য দেশনেত্রীকে তাঁর পছন্দমতো বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। জমির চিরস্থায়ী মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বেগম জিয়া মিথ্যাচার করেছেন। অর্থাৎ সরকারি লোকেরা করছেন সত্যাচার।
স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার দৃশ্যটি দেখে অন্তত কিছু মানুষ তাদের জীবনের সর্বোচ্চ সুখ উপভোগ করেছে। কয়েক কোটি মানুষ হয়তো মনে মনে বলছে, বেশ হয়েছে। তবে আট-দশ কোটি মানুষের মনের অবস্থা আমাদের মতো অ-মনোবিজ্ঞানীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাদের মনোভাব জানা যাবে ২০১৩-র ডিসেম্বরে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পুরোনো বাড়িঘর ছেড়ে নতুন কোনো বাড়িতে যাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ রয়েছে। বেগম জিয়া এবার নতুন বাড়িতে ঈদ করবেন। এটা বিশ্বায়নের যুগ। আমাদের পৃথিবীর নতুন নাম হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজ—বৈশ্বিক গ্রাম। তাঁর দুই ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনিরা ঈদ করবেন দুই ভিনদেশে। সুতরাং এবার তাঁর আনন্দের শেষ নেই।
আমাদের দেশের উন্নততর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক দলের নেতা অন্য দলের নেতাকে কোনো কারণেই ধন্যবাদ জানান না। এমনকি যদি কেউ মাঘ মাসে অক্সিজেন ছাড়া হিমালয়ের চূড়ায় ওঠেন অথবা ডিঙি নৌকায় আটলান্টিক পাড়ি দেন, তবু তাঁকে তাঁর প্রতিপক্ষ অভিনন্দন জানাবেন না। কিন্তু আনন্দের সঙ্গে পুরোনো বাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাওয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সরকারি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ এক নজিরহীন নম্র ও উদার আচরণ। খামাকা ধন্যবাদ জানানো হয়নি। ধন্যবাদ তিনি পেয়েছেন ‘সামরিক ভূসম্পত্তি বিভাগের সিদ্ধান্ত এবং আদালতের রায়ে সেনানিবাসের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ায়।’
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) খালেদা জিয়াকে খোশ আমদেদ জানিয়েছেন, ‘বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন’ বলে। অর্থাৎ গৃহত্যাগের প্রথম দিন বেগম জিয়ার ওপর নানা দিক থেকে অভিনন্দন বর্ষিত হয়।
শ্লেষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ব্যাপারগুলো কথাশিল্পী ও কলাম লেখক যখন করেন, তখন মানুষ কিছু মনে করে না। বরং উপভোগ করে। হাসে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন ব্যক্তিকে নিয়ে রগড় করে, তখন তা কিছু লোক উপভোগ করলেও দেশের কোটি কোটি মানুষের তাতে গা জ্বালা করে। সরকার কার গলায় মালা পরাবে আর কার গলায় সজোরে ধাক্কা দেবে, তা সরকারের এখতিয়ার ও অভিরুচি। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যখন কাউকে নিয়ে রগড় করে, তখন তা মানুষের ব্রহ্মতালুতে গিয়ে আঘাত করে।
প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তাই হোন আর কোনো বিভাগের জনসংযোগের কর্মকর্তাই হোন, তাঁরা যে মজুরি-ভাতা পান, যা দিয়ে তাঁরা পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ করেন, সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠান বা চিরকালের জন্য আমেরিকায় পাঠান, তা শুধু আওয়ামী লীগের ভোটাররা দেন না। বেগম জিয়ার সমর্থকেরাও দেন। চাকরির মেয়াদ শেষে যে পেনশন মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচ বছর তার পরিবার পায়, সেটাও কোনো দলের তহবিল থেকে দেওয়া হয় না। দেশের মানুষ দেয়। সাংবাদিকদের সামনে দলের নেতারা নোংরা ভাষায় কথা বলতে পাবেন, তাঁর দায়িত্ব তাঁর, কিন্তু কর্মচারীদের সে অধিকার নেই।
গৃহত্যাগের পর রাতটি না পোহাতেই তাঁকে যে মোবারকবাদ জানানো হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়। খালেদা জিয়া ‘সেজেগুজে’, ‘অকথ্য ভাষায়’, ‘সেনাবাহিনীকে গালিগালাজ’ করেছেন, তা এক কর্মচারীর মুখে শোনা গেল। যাঁরা তাঁকে সসম্ভ্রমে গাড়িতে তুলে দিয়ে ‘বাই বাই’ বলতে গিয়েছিলেন, তিনি নাকি শাসিয়েছেন, ‘আমি সবার চেহারা চিনে রাখছি,...।’ বাস্তবতা হলো, সেদিন তিনি সাজগোজ করতে গিয়ে টেলিভিশন দেখার ফুরসত পাননি। টেলিভিশন দেখেছে বাংলার মানুষ। যদি চিনে রাখারই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সেদিনের ভদ্রলোকদের বাংলার মানুষই চিনে রেখেছে।
জাতি হিসেবে আমরা এমন একটি সমষ্টিগত স্বভাব অর্জন করেছি। যেকোনো ধরনের কুৎসিত ও নিষ্ঠুর ঘটনা আমাদের গভীর আনন্দ দেয়। পৈশাচিক আনন্দে আমরা প্রত্যেকেই অভ্যস্ত। কাল যদি বঙ্গবন্ধু সেতুটি ধসে পড়ে, কিছু লোক হয়তো আনন্দে ফেটে পড়বে। তখন সাড়ে তিন কোটি লোক বলবে, আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালের মধ্যে খালেদা জিয়া যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তার কারণেই এটা ধসে পড়েছে। অন্য সাড়ে তিন কোটি বলবে, ব্রিজের কাজ শেষ করেছিল হাসিনার সরকার। তাই আজ ধসে পড়ল।
বাড়িঘর, জোত-জমির মালিকানা শরিকানা আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার বিষয়। পুরোনো ও নব্য কলাম লেখকেরা এ নিয়ে পত্রিকার পাতাই শুধু ভরাট করতে পারেন। আসল কথা বলতে পারেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা—তাঁর দলীয় দায়বদ্ধতা ও আনুগত্য যা-ই হোক। অ্যাটর্নি জেনারেল গৃহত্যাগের পরদিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ওপরে আর কোনো কথা হয় না। তিনি বলেছেন, মামলায় জিতলে খালেদা জিয়া বাড়ি ফিরে পাবেন। কথাটা এক শ ভাগ সত্যি। তিনি জানিয়ে দিলেন, মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, সেটা হবে ২৯ নভেম্বর। আনন্দে ঈদ করার জন্য দেশনেত্রীকে তাঁর পছন্দমতো বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। জমির চিরস্থায়ী মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বেগম জিয়া মিথ্যাচার করেছেন। অর্থাৎ সরকারি লোকেরা করছেন সত্যাচার।
স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার দৃশ্যটি দেখে অন্তত কিছু মানুষ তাদের জীবনের সর্বোচ্চ সুখ উপভোগ করেছে। কয়েক কোটি মানুষ হয়তো মনে মনে বলছে, বেশ হয়েছে। তবে আট-দশ কোটি মানুষের মনের অবস্থা আমাদের মতো অ-মনোবিজ্ঞানীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাদের মনোভাব জানা যাবে ২০১৩-র ডিসেম্বরে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments