ইউরোপের চিঠি-চীন ও দুর্লভ ধাতু নিয়ে উদ্বেগ by পিটার কাস্টার্স

ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদের সূত্রপাত। পরে যে আন্তর্জাতিক শোরগোল উঠল, তার সঙ্গে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। গত ৭ সেপ্টেম্বর তাইওয়ানের উত্তর-পূর্বে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের অদূরে একটি চীনা ট্রলার জাপানের উপকূলপ্রহরীদের নৌকার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।


এখানকার ছোট ছোট দ্বীপ বর্তমানে জাপানের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকেই চীন দ্বীপগুলোর ওপর সার্বভৌমত্বের দাবি করে আসছে। সেদিনের ঘটনায় জাপান চীনা ট্রলারটির ক্যাপ্টেনকে আটক করে। এতে চীন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। এশিয়ার এ দুই বড় শক্তির মধ্যকার কূটনৈতিক বিবাদ শুধু সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের ওপর নিজেদের দাবি পুনর্ব্যক্ত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ২০ সেপ্টেম্বর নাগাদ চীনা বন্দরগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে জাপানে ‘দুর্লভ ধাতু’ বা রেয়ার আর্থ মেটালস পরিবহন বন্ধ করে দেয়। অথচ এসব পদার্থ উচ্চপ্রযুক্তির পণ্য উৎপাদনের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশ্ববাজারে প্রভাব খাটিয়ে চীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, এমন অভিযোগ যদিও চীন অস্বীকার করেছে, তবু এসব ধাতু ব্যবহারকারী বিদেশি কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক ফাটকাবাজদের উদ্বেগ এখনো কমেনি। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী বিচলতা সৃষ্টি হয়। প্রধান প্রধান পশ্চিমা সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে চীন এসব দুর্লভ ধাতুর রপ্তানি ৭০ শতাংশ কমিয়েছে। তা ছাড়া চীন ঘোষণা দিয়েছে, আগামী বছর এসব কাঁচামাল রপ্তানিতে আরও প্রতিবন্ধকতা আরোপ করতে তারা বাধ্য হবে। চীনের যে শিল্পগুলো এসব ধাতু ব্যবহার করে তাদের সুরক্ষার কথা ভেবেই এমন নীতি।
তাহলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিবাদের পেছনে বাস্তবিক ও বড় কারণগুলো কী? কয়েক শতাব্দী ধরে পশ্চিমারা কৌশলগত কাঁচামালের ওপর যে একচেটিয়া অথবা বিশেষ অধিকার ভোগ করে আসছে, সেই আধিপত্যকে চীন কি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে? এখানে সংক্ষেপে দুর্লভ ধাতু বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যাক। মাত্র এক বছর আগেও বিশ্বগণমাধ্যমে এ শব্দের দেখা মেলা কঠিন ছিল। কপার ও স্টিলের মতো বিপুল পরিমাণ ব্যবহূত খনিজ থেকে আলাদা রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের ১৭টি ধাতুকে একসঙ্গে দুর্লভ ধাতু বলা হয়। নাম থেকে যতটা দুর্লভ মনে হয়, ততটা দুর্লভ নয়। পৃথিবীর উপরিতলে এমন ধাতু বেশ ভালোই দেখা যায়। কিন্তু সাধারণত আলাদাভাবে এগুলো সংগ্রহ করা যায় না। খনি থেকে সংগ্রহ করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আলাদা করা হয়। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ফ্ল্যাট স্ক্রিন টেলিভিশন প্রস্তুতকারক কারখানা থেকে শুরু করে সৌর প্যানেল, হাওয়াকল ও অস্ত্র তৈরির কারখানা পর্যন্ত নানা আধুনিক শিল্প এসব খনিজের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বর্তমানে এসব ধাতু প্রায় ১২৫ হাজার টন আহরণ ও বিক্রি হয়। তবে বিশ্ববাজারে প্রতিবছর এর চাহিদা বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। এ ক্ষেত্রে মূল চাবিকাঠি চীনের হাতেই। কেননা, এখন দুর্লভ ধাতুর ৯৮ শতাংশই আহরণ করে চীন। যেমন, বলা যায় নিওডিমিয়াম ধাতুর কথা। আধুনিক হাওয়াকল তৈরিতে এটা লাগে। এ ধাতুর ৯৮ শতাংশ জোগান আসে চীন থেকে। সৌর প্যানেল তৈরিতে ব্যবহূত দুই কাঁচামাল ইলিয়াম (৬০ শতাংশ) ও গ্যালিয়ামের (৮৩ শতাংশ) প্রধান সরবরাহকারীও চীন।
কারও মনে হতে পারে, চীনের এই একচেটিয়াত্ব ইতিহাসের দৈব ঘটনা অথবা প্রকৃতির দান। কিন্তু এ ভাবনা বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। চীনের নিশ্চিত মজুদের পরিমাণ সারা বিশ্বের মোট পরিমাণের এক-তৃতীয়াংশ থেকে প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আসলে অন্য দেশগুলোর মাটির নিচেও আছে বিপুল পরিমাণে। এমনই এক দেশ কাজাখস্তান। দুর্লভ ধাতুর বাণিজ্যের বর্তমান বৈশ্বিক কাঠামো চীনের সচেতন কৌশলের ফল বলে মনে হয়। আর চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের দূরদৃষ্টির অভাবও এতে ভূমিকা রেখেছে। সত্তরের দশকেই চীন এসব ধাতু আহরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। তৎকালীন শাসক দেং শিয়াও পিং বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কাছে অশোধিত তেল যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতে চীনের জন্য এই ১৭টি ধাতুও তেমনি হয়ে উঠতে পারে। তখন থেকেই চীনের সরকার বড় আকারে খনি প্রকল্প শুরু করে। অবশ্য তাতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য এবং তেজস্ক্রিয় ও অন্যান্য বর্জ্য নিঃসরণের প্রতি তারা বিশেষ মনোযোগ দেয়নি। তা ছাড়া অন্য অনেক খাতে অবাধে বেসরকারি কোম্পানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলেও দুর্লভ ধাতুর খনি নিয়ন্ত্রণ করে অল্প কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বাউতোউ স্টিল। ফরাসি মাসিক পত্রিকা লঁ মঁদ ডিপ্লোমেটিক-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে চীনের কৌশলটির চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। স্বদেশে কম্পিউটার ও অন্য উচ্চপ্রযুক্তির পণ্যের বাজার দ্রুত বিস্তৃত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চীন এখন ভবিষ্যতের জন্য মজুদের এক অংশ রেখে দিতে চায়। তাই এসব দ্রব্য আহরণের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করছে।
এ ক্ষেত্রেও চীনের পুঁজিবাদী দূরদৃষ্টির ফলে বর্তমান একচেটিয়া অবস্থান অর্জিত হয়েছে। আবার দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমারা তা চ্যালেঞ্জহীনভাবে মেনে নেওয়ার ফলেও সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের ঘটনাবলির অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত বেসামরিক থিংক ট্যাংক ও গবেষণাকেন্দ্রগুলো তাদের প্রতিবেদনে বিশদ বর্ণনা করেছিল, কেমন করে উচ্চপ্রযুক্তির কোম্পানিগুলো এবং অস্ত্রশিল্প চীনের দুর্লভ ধাতু সরবরাহের ওপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল হয়ে আছে। এসব প্রতিবেদনে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্কিন শিল্পের জন্য চীন সার্বিক কৌশলগত অবস্থান অর্জন করেছে, যা বন্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারিতে চীনের বিনিয়োগের ফলে তাদের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা সৃষ্টির সমান্তরাল। তা ছাড়া নয়া উদারতাবাদের যুগে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে দুর্লভ খনিজ আহরণের বিষয়টি অবহেলিত থেকেছে। ঐতিহাসিকভাবে দেং শিয়াও পিং শাসনামলের আগে, এ ধরনের ধাতু আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ছিল। কিন্তু চীন যখন এসব ধাতু বিশ্ববাজারে সরবরাহ করতে শুরু করল, তখন যুক্তরাষ্ট্রে এসব খনিজ আহরণে ভাটা পড়ল; মূলত, চীন থেকে আমদানি কম ব্যয়সাপেক্ষ বিবেচিত হওয়ার কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দুর্লভ ধাতু আহরণস্থল মাউন্টেন পাস তখন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। মার্কিন উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর শিল্পগুলো তখন সহজলভ্য আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।
এই গল্পের তাৎপর্য কী? ইতিহাসে কখনো এমন ঘটেছে কি না বলা কঠিন: পশ্চিমা শক্তিগুলো এ ক্ষেত্রে কমবেশি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য সামনের সারির শিল্পের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের নিয়ন্ত্রণ অপশ্চিমা কোনো দেশের হাতে থাকাকে মেনে নিয়েছে। চীন রপ্তানির ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করলে এসব শিল্পে উৎপাদনের যে সংকট সৃষ্টি করতে পারে, তার সমাধান নিয়ে ওয়াশিংটনে যেমন, ব্রাসেলসেও তেমনি নীতিনির্ধারকেরা এখন পথ খুঁজছেন। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা দুর্লভ ধাতু আহরণ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আইন প্রণয়ন বিষয়ে আলোচনা করছেন। মাউন্টেন পাস খনি শিগগিরই চালু করা হবে। তবে একেবারে নতুনভাবে নীতিনির্ধারণের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়াতেই সত্যিকারের দূরদৃষ্টির দেখা মিলবে। ভোগ্য পণ্য উৎপাদনের জন্য চীনের ওপর পশ্চিমাদের নির্ভরতার উল্টো পিঠে আবার কম্পিউটার ও অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য পশ্চিমা ভোক্তারা ব্যবহার করার পর বর্জ্য হিসেবে তা পাঠানো হচ্ছে চীনে। চীন থেকে যেসব জাহাজ ভোগ্য পণ্য নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে, সেগুলোর কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রের বর্জ্য বোঝাই না করে ফেরে না। অনেক ক্ষেত্রে অনেক দুর্লভ ধাতুনির্মিত দ্রব্য রিসাইকেল করার হার যুক্তরাষ্ট্রের শূন্য। সে ক্ষেত্রে দুর্লভ ধাতু রপ্তানিতে চীনের অনাগ্রহের জবাবে সমাধান হয়তো শিল্পায়িত অর্থনীতিগুলোর রূপান্তর ঘটানো! আমার ধারণা, এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে মানবিক ও পরিবেশগতভাবে দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত সচেতনভাবে তাদের নিজেদের দেশের ভেতর রিসাইক্লিং বহুগুণে বাড়িয়ে তোলা এবং শিল্পের রূপান্তরের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া। আর এমন পদক্ষেপ বহু আগেই নেওয়া দরকার ছিল।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক ও বাংলাদেশ বিষেশজ্ঞ; প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.