শিল্পের স্বার্থেই শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন-শ্রমনীতি হতে হবে শ্রমিকবান্ধব

গত কয়েক বছরের শ্রম পরিস্থিতির একটি শিক্ষা হচ্ছে, মজুরি ঠিক নেই তো উৎপাদনও ঠিক নেই। মজুরি ও কর্মপরিবেশের কারণে অশান্তি-বিক্ষোভ ও সহিংসতায় নাগরিক জীবনও বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। শিল্প-উৎপাদন ও ব্যবসার অন্যতম চালিকাশক্তি হলো শ্রমিকের শ্রম। শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক বিকাশেরও শর্ত।


সরকারের খসড়া শ্রমনীতিকে এই আলোকেই বিবেচনা করা দরকার।
শেষ শ্রমনীতি প্রণীত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। পরের ৩০ বছরে যুগোপযোগী শ্রমনীতি না থাকা থেকেই বোঝা যায়, শ্রম ও শ্রমিকের ব্যাপারে পূর্বাপর সরকার কতটা উদাসীন ছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিক শ্রম বিক্রি করেন এবং মালিক তা কেনেন। উভয়ের এই সম্পর্কের মাধ্যমে শ্রমিকের মানবিক জীবন ও অধিকার পাওয়ার কথা আর বিনিয়োগকারীর নিশ্চিত করার কথা মুনাফা। কিন্তু দেখা যায়, মুনাফা নিশ্চিত হলেও শ্রমিক শ্রমের ন্যায্য মূল্য পান না এবং পান না ন্যূনতম মানবিক আচরণ।
দেশে এখন বিরাট অনানুষ্ঠানিক শিল্প খাত গড়ে উঠেছে, কৃষিতেও শ্রম ভাড়া করার হার বেড়েছে। সেবা খাতেও কাজ করছেন অসংখ্য শ্রমিক। এসব খাতের মজুরির মধ্যে কোনো সাযুজ্য নেই, উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম মজুরিটুকুও নির্ধারিত হয় না। এ ছাড়া নারীশ্রমিক, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিক এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত শ্রমিকেরা অধিক বঞ্চনার শিকার হন। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবায়ন সুদূর পরাহত। এসব বিবেচনায় নতুন শ্রমনীতির কাছে শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা অনেক।
অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ প্রবাসে কর্মরত। তাদের ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়। দেশের ভেতরে ও বাইরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়োজনে খসড়া শ্রমনীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সময়ে সময়ে দ্রব্যমূল্য ও অন্যান্য পরিস্থিতির সাপেক্ষে মজুরি পর্যালোচনার যে সুযোগ খসড়া শ্রমনীতিতে রাখা হয়েছে, তাও ইতিবাচক।
শ্রম কেবল কেনা-বেচার বিষয় নয়, শ্রম ও শ্রমিকের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও এর সঙ্গে জড়িত। এবং চূড়ান্তভাবে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই। শ্রমনীতি যে অর্থনীতিরই অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়, সেই উপলব্ধি নিয়োগকর্তাদের অনেকেরই নেই। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি যে অর্থনৈতিক সাফল্যের শর্ত, তা আমেরিকার ফোর্ড কোম্পানি কিংবা ভারতের টাটা-বিড়লাসহ বিশ্বের সমৃদ্ধ দেশের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা যায়। শ্রমিকবান্ধব শ্রমনীতি, কেবল শ্রমিকের স্বার্থেই নয়, অর্থনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন।
আশা করি, খসড়া শ্রমনীতি অবিলম্বে চূড়ান্ত হবে এবং এর বাস্তবায়নেও সরকার আন্তরিক থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.