সম্পাদকীয়-কবীর চৌধুরীর প্রয়াণ ও কবিতা প্রসঙ্গ

বীর চৌধুরী একাধারে শিক্ষক, অনুবাদক, অসাম্প্রদায়িক মননের প্রতীক হিসেবে বাঙালি জাতির কাছে সুপরিচিত। তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন অভিভাবক হারাল। মুক্তমনের মানুষের অভাব পৃথিবীতে সর্বকালেই ছিল। সম্প্রদায়গত কিংবা ব্যক্তিগত সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব মানুষ এখন ভাবতে পারে না, সেখানে মুক্তমনের বিবেকবান মানুষ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তাই কবীর চৌধুরীর মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের।


কবিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করার প্রধান কারণ, এবারের নোবেল লরিয়েট টমাস ট্রান্সট্রোমারের নোবেল ভাষণ। ভাষণটি কয়েকটি কবিতার সমাহার, যেখানে জীবনের সমগ্রতার প্রকাশ মেলে। বাস্তব-পরাবাস্তব-মানুষ ও প্রকৃতির হাত ধরাধরি করে বেড়ে ওঠা এই কবিতাগুলো যে অপর এক বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হলো বাংলা কাব্যসৃষ্টির দুটি ধারার কথা। মিল ও অমিল ছন্দের ব্যবহার বাংলা কবিতায় কবে থেকে ঘটেছে? এই যে মধুসূদন দত্তের কবিতায় অমিল ছন্দের ব্যবহার, এটা কি প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে নেওয়া, নাকি ইংরেজি সাহিত্যের ষোড়শ শতক থেকে? আশ্চর্য সত্য হলো প্রাচীন সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন কিংবা আরবি কবিতায় মিল নেই।
বাংলার কবিরা সংস্কৃত সাহিত্য থেকে আত্মস্থ করেছেন ঠিকই; কিন্তু কেন লিখলেন মিল-অন্ত্যমিলের কবিতা_এ রহস্য এখন অবধি থেকেই গেল। মাইকেলই প্রথম বাংলায় অমিল ছন্দের প্রবর্তক। এই যে দুই ধারার সূচনা ঘটল, যা বাংলা কবিতায় আজ অবধি সাহিত্যিক রুচি ও কাব্যদেহের গঠনের আদর্শে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, কখনো মাইকেলীয়, কখনো সংস্কৃত কাব্যের আবহে, ইংরেজি ব্লাঙ্ক ভার্সের কাছ থেকেই, নাকি সংস্কৃত কাব্যের শরীর থেকে এই চর্চার শুরু বলা মুশকিল। ইংরেজি কাব্যচর্চাকারীদের মধ্যে মিলের বিরোধিতা করে টমাস গ্যাসকোয়েন গ্রন্থ লিখলেন ১৫৭৫ সালে।
সেসব বিস্তর কথা; বিশেষ করে বাংলায়, অনুমান করা হয়, লোকগীতি বা ছড়ায় মিলের প্রথম আবির্ভাব। অভিজাত কাব্যে মিলের আবির্ভাব রহস্যময়। আভাসে-ইঙ্গিতে পুরনো গদ্যে বা পদ্যে মিল-অন্ত্যমিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ধ্বনির পুনরাবৃত্তি বা শব্দের ব্যবহারে, কখনো বাক্যের পুনরাবর্তনের ফলে মিলের সৃষ্টি।
কবিতার এই অলংকরণের শাখা-প্রশাখা অনেক, সেসব আলোচ্য বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয় গত দুই দশকে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বুঝে না বুঝে অমিল ছন্দের চর্চা হয়েছে কবিতায়। সর্বকালে যা ঘটে_প্রতিভাবানরাই টিকে থাকেন সেসব নিরীক্ষাধর্মী লেখায়, যা পরবর্তীকালে ধ্রুপদী সাহিত্যে রূপ লাভ করে। প্রচলকে ভাঙাই তো নতুনদের কাজ। সেই নতুনদের জয় হোক, যাঁরা জেনে-বুঝে প্রচলকে ভেঙে নতুন পথ সৃষ্টি করছেন।

No comments

Powered by Blogger.