বইপত্র-তাঁর সাহিত্যকৃতির অন্বেষা by আখতার হুসেন
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব: আবদুল মান্নান সৈয়দ \ সম্পাদক: পিয়াস মজিদ \ প্রকাশক: শুদ্ধস্বর \ প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল \ মূল্য: ২০০ টাকা অক্লান্ত অভিযানী ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিশেষত তাঁর উজান-বাওয়া লেখক-জীবনের পথপরিক্রমার ক্ষেত্রে। বিশ শতকের ছয়ের দশকে তিরিশের মুখ্য কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্যকৃতি নিয়ে প্রথম তিনি প্রকাশ করেন শুদ্ধতম কবি, কিংবা তার একটু আগেভাগে যখন
প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটগল্পের বই সত্যের মতো বদমাশ, আমাদের নিস্তরঙ্গ এঁদো ডোবাতুল্য সাহিত্য-ভুবনে তা ঢিল ছোড়ার মতো ঘটনা হয়ে উঠেছিল। বিশ শতকের ছয়ের দশকের সাহিত্য কারুকারদের মধ্যে মান্নান সৈয়দের পঠনপাঠনের ব্যাপ্তি যেমন গভীর ছিল, ছিল সদ্য ও সদাই ঝালাই করা, তেমনই যে বিষয়ে লিখতেন, বিশেষত প্রবন্ধ, তাতে আলোচ্য বিষয়ে ফাঁকফোকর খোঁজার অবকাশ যেমন মিলত না, তেমনই অনুপুঙ্খতার গুণে তা একান্তই মান্নানীয় হয়ে উঠত। এর স্বাক্ষর যেমন বিধৃত তাঁর শুদ্ধতম কবিতে, তেমনই সমভাবে বিধৃত তাঁর সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব-এও। ‘প্রবেশক’ শিরোনামি ভূমিকা থেকে আমরা জানতে পারি, গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলো লেখা হয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের সময়গত পরিসরে। গ্রন্থধৃত নয়টি প্রবন্ধ একাদিক্রমে লেখা না হলেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সামগ্রিক কবি ও সাহিত্যকৃতির মূল্যায়নে এগুলোর অপরিহার্যতাকে কোনোক্রমেই ন্যূন বলে ভাবার অবকাশ পাওয়া যাবে না বরং রীতিমতো বিস্মিতই হতে হয় সময়ের বেশ বড় ব্যবধানে প্রবন্ধগুলো রচিত হলেও, তাদের বিষয়-সংশ্লিষ্ট ধারাক্রমে কী আশ্চর্য রকমের সাযুজ্য! একমাত্র কবির জীবনী রচনা ছাড়া (সংক্ষিপ্তভাবে হলেও) তাঁর কবি বা সাহিত্যকৃতির কোনো দিকই বাদ যায়নি। অবশ্য, জীবনী রচনা না করলেও কোন পরিবেশে কবির বেড়ে ওঠা এবং তাঁর সমকাল তাঁর অন্তর্গত জীবনে কিংবা তাঁর কাব্য-ভাবনায় কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, মান্নান তাকে স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে যাননি। এই সূত্রেই তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমি মনে করি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একালের শ্রেষ্ঠ কবি-প্রতিনিধি; দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়, তথা অর্ধবিংশ শতক, একজন বাঙালি কবির ওপর কী নিরীশ্বর, অবিশ্বাসী, অপ্রেমের শরীর ও মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল তাঁর ছয়টি (অনুবাদ-কাব্য প্রতিধ্বনি বাদ দিয়ে) পরিপূরক কাব্যগ্রন্থে তার নগ্ন, তুঙ্গ ও মারাত্মক প্রকাশ। আমি বলতে চাচ্ছি, এই কবির ভেতর ভূগোলব্যাপ্ত বিষাদ ও নৈরাশ্য-পরিপূর্ণ আকুতি পেয়েছে, আচ্ছাভাবে তাঁকে কামড়ে ধরেছে মরিয়া সমকাল, তাঁর সমকালীন আর সব বাঙালি কবির চেয়ে বেশি করে, আর সেটাই সুধীন্দ্রীয় প্রতিকৃতি। প্রথম কাব্য ‘তন্বী’ অতিরাবীন্দ্রিক, তবু সেখানেই তাঁর ভবিষ্যৎ চরিত্রের ধ্বনি আসন্ন প্রসঙ্গ, প্রকরণ ও বিন্যাসে। প্রথম কাব্য হলেও এটি অভিজ্ঞতার পরিণতিপর্বে লেখা (সার্থকতার কথা বলছি না); স্মৃতিভরা; “মৃত প্রেম”, “ভ্রষ্ট লগ্ন” ইত্যাদি কবিতা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।’
এই গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম উদ্ধৃত করা যাক, যার থেকে বোঝা যাবে মান্নান সৈয়দ কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে দেখতে চেয়েছেন—চেয়েছেন মূল্যায়ন করতে। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব’, ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ’, ‘সুধীন্দ্রনাথ: কবিতার গদ্য’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের “জাতিস্মর”’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দচিন্তা’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দ’, ‘প্রাবন্ধিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘পরিচয়: কয়েকটি সংখ্যা’ এবং ‘জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ’—প্রবন্ধগুলোর ইত্যাকার শিরোনামই বলে দেয় মান্নান সৈয়দ তিরিশের এই প্রধান কবিকে কতটা গভীর ও চুলচেরা বিশ্লেষণে বিশ্লিষ্ট করতে চেয়েছেন।
এই গ্রন্থের পাঠ শুরু করলে পাঠক উৎসুক না হয়ে পারবেন না। মান্নান সৈয়দই তাঁদের এ ব্যাপারে প্ররোচিত করবেন। যখন তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সুধীন্দ্রনাথ “নিখিল নাস্তি”র জয়গান যতই করুন—তাঁর কবিতায় নাস্তিকতা কেঁপে গেছে। যতই নিজেকে “যুক্তিবাদী” বলুন, আবেগের বিস্ফোরণে কখনো কখনো যুক্তি গেছে তলিয়ে—এবং সে-আবেগের অনেকখানি তাঁর প্রেমজ অভিজ্ঞতার দান। দশমীর কবিকে কি আর শূন্যবাদী বলা চলবে? সুধীন্দ্রনাথের পূর্ব-কাব্যে মরুভূমির বিস্তার, কিন্তু এই শেষ কাব্যে সঞ্চারিত হয়েছে “প্রাদেশিক শ্যামলিয়া” (তাঁরই ভাষায়)। ১৯৫৬ সালে একটি গদ্যলেখায় সুধীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন (‘পুনশ্চ’, স্বগত) : তাঁর প্রাক্তন কবিতায় “চিত্রকল্পের পরিবর্তে কবিপ্রসিদ্ধির ব্যবহার” বেশি—একে সুধীন্দ্রীয় বিনয় বলে অগ্রাহ্য করা উচিত হবে না, কেননা দশমীর কবিতাগুচ্ছে আমরা দেখি চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্পের উপস্থাপনা।’ এ-জাতীয় উচ্চারণের পরপরই মান্নান যখন আবারও বলেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যবিজ্ঞাসায় আধেয়ের চেয়ে আধারের গুরুত্ব বেশি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধেয়েও—অর্থাৎ জীবনজিজ্ঞাসায়ও—সুধীন্দ্রনাথ যদি আলাদা না-হতেন, তাঁকে কি আমরা বড়ো কবি বলে মানতাম?’, তখন আমাদের থমকে গিয়ে ধন্ধে পড়তে হয়। এবং তারও সমাধান করে তিনি আমাদের মননকে সমৃদ্ধ করেন প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে সুধীন্দ্রনাথকে আমূল বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে।
সম্পাদক পিয়াস মজিদকে আন্তরিক অভিনন্দন এ-রকম অমূল্য একটি গ্রন্থের সম্পাদনা করার জন্য।
এই গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম উদ্ধৃত করা যাক, যার থেকে বোঝা যাবে মান্নান সৈয়দ কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে দেখতে চেয়েছেন—চেয়েছেন মূল্যায়ন করতে। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব’, ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ’, ‘সুধীন্দ্রনাথ: কবিতার গদ্য’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের “জাতিস্মর”’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দচিন্তা’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দ’, ‘প্রাবন্ধিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘পরিচয়: কয়েকটি সংখ্যা’ এবং ‘জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ’—প্রবন্ধগুলোর ইত্যাকার শিরোনামই বলে দেয় মান্নান সৈয়দ তিরিশের এই প্রধান কবিকে কতটা গভীর ও চুলচেরা বিশ্লেষণে বিশ্লিষ্ট করতে চেয়েছেন।
এই গ্রন্থের পাঠ শুরু করলে পাঠক উৎসুক না হয়ে পারবেন না। মান্নান সৈয়দই তাঁদের এ ব্যাপারে প্ররোচিত করবেন। যখন তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সুধীন্দ্রনাথ “নিখিল নাস্তি”র জয়গান যতই করুন—তাঁর কবিতায় নাস্তিকতা কেঁপে গেছে। যতই নিজেকে “যুক্তিবাদী” বলুন, আবেগের বিস্ফোরণে কখনো কখনো যুক্তি গেছে তলিয়ে—এবং সে-আবেগের অনেকখানি তাঁর প্রেমজ অভিজ্ঞতার দান। দশমীর কবিকে কি আর শূন্যবাদী বলা চলবে? সুধীন্দ্রনাথের পূর্ব-কাব্যে মরুভূমির বিস্তার, কিন্তু এই শেষ কাব্যে সঞ্চারিত হয়েছে “প্রাদেশিক শ্যামলিয়া” (তাঁরই ভাষায়)। ১৯৫৬ সালে একটি গদ্যলেখায় সুধীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন (‘পুনশ্চ’, স্বগত) : তাঁর প্রাক্তন কবিতায় “চিত্রকল্পের পরিবর্তে কবিপ্রসিদ্ধির ব্যবহার” বেশি—একে সুধীন্দ্রীয় বিনয় বলে অগ্রাহ্য করা উচিত হবে না, কেননা দশমীর কবিতাগুচ্ছে আমরা দেখি চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্পের উপস্থাপনা।’ এ-জাতীয় উচ্চারণের পরপরই মান্নান যখন আবারও বলেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যবিজ্ঞাসায় আধেয়ের চেয়ে আধারের গুরুত্ব বেশি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধেয়েও—অর্থাৎ জীবনজিজ্ঞাসায়ও—সুধীন্দ্রনাথ যদি আলাদা না-হতেন, তাঁকে কি আমরা বড়ো কবি বলে মানতাম?’, তখন আমাদের থমকে গিয়ে ধন্ধে পড়তে হয়। এবং তারও সমাধান করে তিনি আমাদের মননকে সমৃদ্ধ করেন প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে সুধীন্দ্রনাথকে আমূল বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে।
সম্পাদক পিয়াস মজিদকে আন্তরিক অভিনন্দন এ-রকম অমূল্য একটি গ্রন্থের সম্পাদনা করার জন্য।
No comments