চরাচর-স্বেচ্ছায় রক্তদান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একটি বিশেষ দিনে জীবনদায়ী রক্তের রক্তাভ মহিমাকে চিরভাস্বর করে রাখার জন্য প্রতিবছর '১৪ জুন' দিবসটিকে চিহ্নিত করেছে 'বিশ্ব রক্তদাতা দিবস' হিসেবে। রক্তদান আন্দোলনের জনক ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার ১৮৮৬ সালের ১৪ জুন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। রক্তদান আন্দোলনের এ প্রবাদপুরুষের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সারা বিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হয়।
স্বেচ্ছায় যাঁরা রক্ত দান করেন, বিনিময়ে কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন না_শুধু দুঃখী মানুষের সেবা করার দায়-দায়িত্বকেই জীবনের এক অন্যতম ব্রত বলে মনে করেন। তাঁদের প্রয়াসকে অন্তরের গভীর স্বীকৃতি জানানোই বিশ্ব রক্তদাতা দিনটি উৎসর্গীকৃত সেসব মরমি মানুষের জন্য, যাঁরা প্রচারের আলোয় আসতে চান না; কিন্তু নিঃশব্দে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে অনেক মৃত্যুপথযাত্রীর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে থাকেন। বিজ্ঞানের বদৌলতে বহু ওষুধ, বহু যন্ত্রপাতি, বহু চিকিৎসা-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞান আজও রক্তের বিকল্প উদ্ভাবন করতে পারেনি। তাই কোনো রোগীর চিকিৎসার জন্য রক্ত দরকার হলে অন্য একজন মানুষের দেহ থেকেই তা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ত্রুটিপূর্ণ বিজ্ঞান শিক্ষাব্যবস্থা, রক্ত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ইত্যাদি থেকে প্রসূত অনীহার ফলে আজও এ দেশে বহু শিশু, অনেক মা এবং অজস্র রোগাক্রান্ত মানুষ রক্তের অভাবে বাধ্য হচ্ছেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে। মানুষের দেহে এক-দেড় লিটার অতিরিক্ত রক্ত মজুদ থাকে। কিন্তু সাধারণত ওই রক্ত না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। হঠাৎ কোনো কারণে দেহ থেকে প্রচুর রক্তপাত না হলে ওই অতিরিক্ত রক্ত এমনিতেই বয়ে বেড়াই আমরা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেই রক্ত থেকে যদি ৩০০ মিলিলিটার আমরা কোনো রোগীকে দান করি, তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। ২১ দিনের মধ্যে সেই রক্ত আমাদের দেহে তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু যদি দান না করি, তবুও আমাদের শরীরে রক্ত জমতে থাকবে না, যতটা ছিল ততটাই থাকবে। মানুষের রক্তকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চার ভাগ করা হয়েছে। এর নাম ইংরেজি অক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে A, B, C এবং AB। এ ছাড়া আরেক রকম বিশেষত্বের ভিত্তিতে পজিটিভ এবং নেগেটিভও রয়েছে। ফলে রক্ত মূলত আট রকমের। A(+), A(-), B(+), B(-), O(+), O(-), AB(+) এবং AB(-)। শতকরা ৯৪-৯৫ জন মানুষের দেহে পজিটিভ রক্ত থাকে।
নেগেটিভ রক্ত গ্রুপের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ১০০ জনের মধ্যে পাঁচ-ছয়জন মাত্র। ফলে নেগেটিভ রক্তের কেউ অসুস্থ হলে খুবই সমস্যা হয়, রক্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জন্যই বলা হয়, সবাই নিজের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে জেনে রাখুন। যদি আপনার রক্ত নেগেটিভ গ্রুপের হয়, তাহলে আরেকটু বেশি সতর্ক হোন। মানুষ কেন রক্তদান করতে চায় না? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে যেসব কারণ পাওয়া গেছে, সেগুলো মোটামুটি এ রকম_কেউ কোনো দিন রক্তদানের জন্য বলেনি, মোটা সুচের খোঁচা খেতে ভয় লাগে, রক্ত দিলে দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, রক্ত দেখলেই ভয় হয়, অন্যের রোগে আমি নিজেই আক্রান্ত হয়ে যাব, বাড়িতে মা-বাবা-স্ত্রী আপত্তি করবেন, গরিব খেটে-খাওয়া মানুষ, নিজের শরীরের রক্ত দিলে ভালো খাবারও খেতে পারব না_এমনতর দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। রক্ত দেওয়ার জন্য কারো অনুরোধের অপেক্ষা করবেন না, নিজে থেকেই এগিয়ে আসুন।
আফতাব চৌধুরী
No comments