তেল ও জলের দর by মাহবুব মোর্শেদ
দুধ বেচে মদ খাওয়ার কথা আমাদের লোকপ্রবাদে আছে। মূল্যজ্ঞান লোপ হয়েছে এমন ব্যক্তির পরিস্থিতি বর্ণনা করতে দুধ বেচে মদ খাওয়ার উদাহরণ দেওয়া হয়। আমাদের সামাজিক ধারণায় মদ্যপান অহিতকর, পরিত্যাজ্য। পুষ্টির জন্য দুগ্ধপান উৎসাহিত করা হয়। ফলে বাজারে মদ যে দামেই বিক্রি হোক, কেউ যদি দুধ বেচে মদ খায় তবে তার মূল্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে বলে ধরা হয়। দুধ বেচে যে মদ খায় সে নিশ্চিত উচ্ছন্নে গিয়েছে। অবশ্য ভ্রমণপিপাসু
লোকদের কাছে শুনেছি, কোনো কোনো দেশে নাকি পানি, ওয়াইন আর দুধের মূল্য এক। কোথাও কোথাও নাকি একগ্গ্নাস পানির দর এক পেগ হুইস্কির চাইতে বেশি। বাজারে কোন জিনিসের দাম বেশি হবে তা ওই জিনিসের প্রাপ্যতা ও উৎপাদন খরচের ওপর নির্ভর করে। যেখানে মদের চাইতে পানির দাম বেশি সেখানে পানি উৎপাদনের খরচও নিশ্চয় বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে এটি জানবার মতো খবর বটে। কেননা মদ এখানে দুর্মূল্য। অন্যদিকে সস্তায় কোনো জিনিস বিক্রি হলে আমরা বলি_ পানির দরে বিক্রি হচ্ছে, বোঝা যায় পানির দাম কত কম। অবশ্য ক্রমশ পানির দাম বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে পানির দাম, দুধের দাম, মদের দাম কখনও এক হবে বলে মনে হয় না। কেননা, বাজারই শুধু মূল্য নির্ধারণ করে না। সমাজও মূল্য তৈরি করে, এমনকি মূল্যবোধও তৈরি করে। আমরা কথায় কথায় বলি, অমুক আর অমুক এক পঙ্ক্তিতে বসতে পারে না। পঙ্ক্তি মানে কবিতার লাইন নয়, বসার লাইন। খাবার আসরে একই মর্যাদার মানুষের একই পাতে বা লাইনে বসার রেওয়াজ। অসম মর্যাদার ব্যক্তিরা একই পঙ্ক্তিতে বসলে তাতে মূল্যের হানি ঘটে বলে সামাজিক ধারণা। অনেক সময় বলা হয়, অমুক ও অমুককে একই পাল্লায় মেপো না। পাল্লাও এখানে মর্যাদারই স্মারক। যে পাল্লায় চাল মাপা হয়, একই পাল্লায় মিষ্টি মাপার রেওয়াজ নেই। একইভাবে বলা হয়, তেল ও জলের দাম এক করো না। সমাজের মূল্যবোধ বদলের সঙ্গে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এক পঙ্ক্তিতে বসার ক্ষেত্রে মর্যাদার প্রশ্ন ওঠে না। আকবর বাদশাহ আর হরিপদ কেরানীকে এক পাল্লায় মাপলে কেউ সমালোচনার তর্জনী বাড়িয়ে দেন না। জলজ পানীয়গুলোর সমমূল্য কোনো দেশে থাকলে তা বিস্ময়কর হলেও, অগ্রহণযোগ্য খবর নয়। কিন্তু তেল ও জলের দাম এক হওয়া কঠিন। মাঝে মধ্যে দেশে অভিনব কিছু খবর মেলে, তাতে তেলের বদলে পানি, কচুরিপানা, খড় দিয়ে গাড়ি চালনার মতো বিস্ময়কর আবিষ্কারের কথা বলা হয়। এত আবিষ্কারের পরও তেলের মূল্য আর পানির মূল্য এক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বোঝা যায়, তেল ও পানির ক্ষেত্রে বাজার ও সমাজের মূল্যবোধ এখনও অটুট। ভবিষ্যতে বহুদিন তা থাকবে। তবে সম্প্রতি ভারত সরকার তেল ও জলের মূল্য এক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা পেট্রোলের দাম খুব বেশি কমায়নি, আপাতত রাজনৈতিক কৌশলের কারণে স্থিতিশীল রেখেছে। কিন্তু ভারত-রত্ন পুরস্কারকে গণচরিত্র দিয়েছে। ভারতের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাবটি এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের রথী-মহারথীদের বাইরের লোকদের মধ্যেও বিতরণ করা হবে। ক্রিকেটার ও চলচ্চিত্র অভিনেতারাও পুরস্কৃত হবেন। এ নিয়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় শোর উঠেছে। নাগরিক সমাজও সোচ্চার হয়েছে। তারা বলছেন, ক্রিকেট জনপ্রিয়, বলিউডের ফিল্মও জনপ্রিয়। কিন্তু বিদ্যা-জ্ঞান ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এগুলোর অবদান কী? শচীন টেন্ডুলকার কি সিভি রমণ রাধাকৃষ্ণনের মতো পণ্ডিতদের পঙ্ক্তিতে বসতে পারেন? ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কন্ডেয় কাটজু বলেছেন, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মির্জা গালিবকে ভারত-রত্ন দেওয়ার কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এখন ফিল্মস্টার আর ক্রিকেট স্টারদের পুরস্কার দেওয়ার কথা হচ্ছে। এটা করা হলে তার কোনো সামাজিক গুরুত্ব থাকবে না, এটা হবে স্রেফ একটা পরিহাস। ক্রিকেটারদের দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যে ভারতীয় পত্রিকাগুলো যেভাবে কথা বলছে ভারত-রত্নের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে তা প্রশংসনীয় বটে। জনপ্রিয়তাই যদি একমাত্র মানদণ্ড হয় তবে তো সমাজে কোনো দণ্ডই স্থির থাকতে পারে না। ফলে তেল ও জলের দাম কখনও এক হওয়া উচিত নয়। জলের কাছে তেলের কাজ আশা করাও ভুল কিংবা তেলের কাছে জলের কাজ। ভারতের সৌভাগ্য যে, সে দেশে তেল ও জল সকলে চেনে। আমাদের দেশে সমাজের জ্ঞানী-বিদ্বানদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থাই নেই। ফলে এসব কথা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলেই মনে হয়।
No comments