পরীক্ষামূলক ট্রানজিট আর কত দিন? by আরিফুর রহমান খাদেম
কয়েকদিন আগে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে টিপাইমুখ বাঁধের ওপর বিশদ একটি আর্টিক্যাল লিখি। এটি প্রকাশের পর বিভিন্ন মাধ্যমে (ই-মেইল, ফেসবুক, ফোন ইত্যাদি) দেশ-বিদেশের পাঠকের যে পরিমাণ প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য আমি পেয়েছি, তা যত্সামান্য হলেও প্রমাণ করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ।
প্রায় সবাই বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ভূমিকা ও ভারতের এ কুৎসিৎ আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে এমনও কিছু পাঠক ছিল, যারা সব সময়ই ভারত বলতে অন্ধ ছিল এবং কেউ কেউ বর্তমান সরকারের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। আমার লেখার ওপর তাদের মন্তব্যগুলো আমাকে যতটুকু উত্সাহিত করেছে, তার চেয়েও আমি হাজার গুণ বেশি মুগ্ধ হয়েছি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম দেখে। যেকোনো দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার্থে এর বিকল্প নেই।
কোনো এককালে দেশের কিছু মানুষের মুখে প্রায়ই শুনতাম ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে বা দখল করবে। কথাগুলো আমার কাছে নিতান্তই হাস্যকর মনে হতো। কারণ একটা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশকে কীভাবে আরেকটা দেশ আক্রমণ করতে পারে। এটা এ আধুনিক যুগে কী করে সম্ভব? আজকাল ওই সব ব্যক্তির কথা আমার প্রায়ই মনে হচ্ছে। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে তাদের মন মতো নিয়ন্ত্রণ করছে। পাকিস্তানি শোষণের হাত থেকে মুক্তির জন্যই ৩০ লাখের অধিক দেশপ্রেমিক অজস্র রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছিল; ভারতের কাছে সেটা পরোক্ষভাবে বিক্রির জন্য নয়। যদি ভারতকে খুশি করাই আমাদের নীতি ও আদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, ’৭১-এ এত আন্দোলন বা সংগ্রামের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা যা যেভাবে তাই তত্ক্ষণাত্ পাচ্ছে। তারা শুধু আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ আদায়েই ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের ভূমি, কৃষি, বনজ ও জীববৈচিত্র্য, বিভিন্ন নদী ও দেশের নিরাপত্তাকেও রীতিমত হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিস্তা ও টিপাইমুখের চেয়ে ভালো আর উদাহরণ কী হতে পারে! ফারাক্কার ইতিহাস আর এখানে টেনে আনতে চাচ্ছি না। তারা ভালো করেই জানে যে তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে ও টিপাইমুখে বাঁধ করা থেকে বিরত থাকলে বাংলাদেশ মহা বিপদ থেকে বেঁচে যাবে; অন্যদিকে ভারতের কোনো ক্ষতিই হবে না। তবুও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চাচ্ছে।
স্কুলজীবনে শিখেছি স্বাধীন দেশ কাকে বলে। একটি দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার থাকতে হবে, ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়ে নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকতে হবে, জনসংখ্যা ও এর সার্বভৌমত্ব থাকতে হবে। এ মৌলিক বিষয়গুলোর একটির অভাব হলেই একে স্বাধীন দেশ বলা যাবে না। আমাদের দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও জনসংখ্যা থাকলেও, জনমনে অন্য দুটির ওপর প্রশ্ন আছে। প্রায়ই বিভিন্ন সীমান্তে শোনা যায়, দুই দেশের কৃষকদের মাঝে লড়াই বা খুন। এরই জের ধরে দফায় দফায় দুই দেশের ফোর্সদের মধ্যে অমীমাংসিত ও অসফল ফ্ল্যাগ মিটিং হয়। তাছাড়া প্রায়ই সীমান্ত এলাকায় শোনা যায় ভারত আমাদের কিছু অংশ বা জমি নিয়ে নিয়েছে, যদিও কাগজে-কলমে এগুলো বাংলাদেশের অংশ। এ সমস্যার ইতি না হতেই এখন দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন। অনেকেই মন্তব্য করে থাকেন, ‘বাংলাদেশ কি সিকিম হয়ে যাচ্ছে?’ এগুলো মোটেও গুজব নয়। ‘যাহা রটে কিছুটা হলেও বটে’। আমি এ চিরন্তন প্রবাদটি পুরোপুরি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ পুরোপুরি সিকিম না হলেও বাস্তবে ভারত আমাদের সেভাবেই ট্রিট করছে এবং জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
এতদসত্ত্বেও আমরা তাদের পরম বন্ধুই ভেবে যাচ্ছি, একতরফা প্রেমের মতো। আর অন্যদিকে তারা আচরণ করছে এর ঠিক উল্টো। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দিনের পর দিন শত শত ভারী ও কখনও কখনও ১২৮-১৪০ চাকাবিশিষ্ট দীর্ঘ মালবোঝাই ট্রাক ও লরি যাচ্ছে। কোনো হিসাব নেই, চেকিং নেই, শুল্ক নেই। এমনকি আমাদের দেশের পুলিশও তাদের মাল নিরাপদে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে। বিভিন্ন সময় আখাউড়া চেকপোস্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসছে। অথচ বাংলাদেশের সীমানায় আমাদের দেশের নিরীহ কোনো কৃষক বা রাখালকে দেখলে বিএসএফ কালবিলম্ব না করে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে লাশগুলোও বেওয়ারিশ লাশের মতো টেনে নিয়ে যায় এবং ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাছাড়া প্রায়ই ভিসা নিতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অফিসে আবেদনকারীরা বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন।
সম্প্রতি আমি ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে মালবোঝাই ট্রাক ও লরির কিছু ছবি দেখেছি। ছবিগুলো দেখার আগে আমাদের ধারণা ছিল, হয়তো দিনে বা সপ্তাহে দু-একটা ট্রাক আমাদের ওপর দিয়ে আগরতলা যায়। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট দিয়েছে। কিন্তু দেশে স্থানীয় কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পেলাম। যদি এরই নাম হয় পরীক্ষামূলক ট্রানজিট, তাহলে স্থায়ী ট্রানজিট কাকে বলব? ট্রানজিট যদি লিখিতভাবে স্থায়ী করা হয়, তাহলে সপ্তাহে কয়েক হাজার ট্রাক গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। তখন দেশের ওই অঞ্চলের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? দেশের নিরাপত্তাই শুধু হুমকির মুখোমুখি হবে না, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপন্ন হবে। রাস্তাঘাট নিমেষেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পথচারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেবে।
এরই মধ্যে স্থানীয় অনেকেই ট্রানজিটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিভিন্ন মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন। এদের পাশে দাঁড়াতে ও আন্দোলনকে সফল করতে সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও এর আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় সম্মেলন ও গণসংযোগ করেছেন। দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার ডাকে সাড়া দিয়েছে ওই এলাকার হাজার হাজার লোক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আখাউড়ায় তার আগমনকে কেন্দ্র করে এবং অনুষ্ঠানগুলো অসাধারণ সফলতা অর্জন করবে আশঙ্কায় সেখানে কৌশলে সব অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয়া হয়, যা গণতান্ত্রিক ধারার পরিপন্থী।
সম্প্রতি ভারতীয় কিছু মিডিয়ায় ও কয়েকজন নামকরা কলামিস্ট জোরালোভাবে মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ শুধু ভারতকে দিয়েই এসেছে। এখন ভারতের বাংলাদেশকে দেয়ার পালা। বিলম্বে হলেও কিছু ভারতীয়ের বাংলাদেশের প্রতি তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। তবে আমাদের দেশের সরকারপ্রধানদের ভূমিকা হতে হবে যুগোপযোগী। দুই দেশের মধ্যে বিবদমান সমস্যা নিরসনের মধ্যেই বর্তমান সরকারের প্রধান সার্থকতা জড়িত আছে। তাদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যা দেশের মানুষ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। কারণ জনগণের জন্যই তো সরকার এবং সেই জনগণের জন্যই দেশ। স্থায়ী ট্রানজিট দেয়ার আগে বারবার ভাবতে হবে, এ থেকে দেশ কতটুকু লাভবান হবে? ভারী যান চলাচলের ফলে রাস্তার যে ক্ষতি হবে, তা সঠিকভাবে মেরামতে ভারতের ভূমিকা কী হবে? যদিও শুনেছি ট্রানজিটে ব্যবহৃত রাস্তার জন্য ভারত বাংলাদেশকে মোটা অংকের ঋণ দিয়েছে। দেশের ক্ষতি করে বা নিরাপত্তা বিকিয়ে দিয়ে কোনো কিছু করাই সমীচীন হবে না। এ নজির দুনিয়ার কোথাও নেই। চিন্তা করতে হবে অদূর ভবিষ্যতের কথা। কারণ ট্রানজিট একবার স্থায়ী হলে তা ভারতের প্রাপ্য অধিকার হয়ে দাঁড়াবে এবং সরানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
লেখক : অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক
arifurk2004@yahoo.com.au
No comments