সাদাকালো-মৃত্যুর মিছিলে আর কত তরুণী by আহমদ রফিক

থা ও লেখা শুরু হয়েছিল 'ইভ টিজিং' নামে। পরে অবশ্য যুক্তিসংগত কারণে 'যৌন হয়রানি' কথাটাই প্রাধান্য পায়। তখন পর পর অনেক ঘটনায় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে লেখার তোলপাড় শুরু হয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত এগিয়ে এসে সমর্থক ভূমিকা নেওয়ার পরও সরকার এসব অবাঞ্ছিত মৃত্যু বন্ধ করতে কোনো দৃঢ় ও প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। স্বভাবতই বখাটেদের অবৈধ অন্যায় আচরণে উৎসাহ বেড়েছে। শুধু যে বখাটে তরুণের হাতে


কিশোরী-তরুণী লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়েছে, তা-ই নয়; পাঠক পত্রিকার পাতায় মনোযোগ দিলে দেখতে পাবেন, ইতিমধ্যে শিক্ষায়তনে, কর্মক্ষেত্রে, কোচিং সেন্টারে অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরে যৌন হয়রানিই নয়, শ্লীলতাহানির ঘটনা অনেক মাত্রায় বেড়ে গেছে। ভিকারুননিসার ঘটনা এর মধ্যেই ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
সামাজিক অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছাত্রী শিক্ষকের ওপর ভরসা করতে পারছে না, মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর, বন্ধুর বন্ধুকে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবোধের চরম ক্ষয়ে ক্ষতবিক্ষত সমাজ। তাই পথেঘাটে চলারও কোনো নিরাপত্তা নেই। গত কয়েক দিনে কাগজের পাতায় দেখা গেছে, যৌন অত্যাচারের ও যৌন হয়রানির ঘটনা লাঞ্ছিত বা অত্যাচারিতকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যৌন অত্যাচার এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত। গত কয়েক বছরে এতগুলো কিশোরী, তরুণীর প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না, তাদের মানবিক চেতনায় কেন আঘাত পড়ছে না তা বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। মানুষ এতটা অমানুষ ও বর্বর হয়ে উঠেছে যে শিশুরাও তাদের যৌন লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দুই দিন আগেও একটি নামি দৈনিকে ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের খবর বেরিয়েছে। এত সব দেখেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এবং স্বয়ং সরকারই বা চুপ থাকে কিভাবে?
অনেক সময় যৌন নির্যাতনের পরও আশা মেটে না নির্যাতনকারীর। নির্যাতনের ভিডিও চিত্র তুলে ইন্টারনেটে ফেসবুকে ব্যবহারের ভয় দেখিয়ে নির্যাতিতাকে কব্জায় আনতে চেষ্টা করে। ফলে আত্মধিক্কারে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তরুণী। এ-জাতীয় বেশ কিছু ঘটনার খবর ইতিমধ্যেই কাগজে বেরিয়েছে। এর পরও সমাজে আলোড়ন ওঠে না। কেউ আসে না যৌথ চেষ্টায় সরকারকে নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়নে বাধ্য করতে।
সমাজ ও সরকার যখন নারীদের ওপর অব্যাহত নির্যাতনের ঘটনা সত্ত্বেও বধির, স্থির, তখন অগতির গতি বা শেষগতি উচ্চ আদালতের প্রতি আমাদের আহ্বান কিছুটা কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে, যাতে সরকার বাধ্য হয় নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে। সে আইন এমন হওয়া দরকার, যাতে আইনি প্যাঁচের ফাঁকে অপরাধী বেরিয়ে যেতে না পারে। আমাদের আবেদন থাকবে, সে আইনে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি যেন জামিনের অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা ক্ষান্ত হবে না। একই ধরনের আহ্বান অনেকেই রেখেছিলেন দুর্বৃত্ত বাস-ট্রাকচালকদের নরহত্যা বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে না, সরকার তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। অথচ দুর্ঘটনা তথা হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে। নির্ভয়, নির্বিকার বাস-ট্রাকচালক। হয়তো সরকারের অনীহার কারণে মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে বছর কয়েক আগে হাইকোর্টে যে রিট আবেদন করা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট সদর্থক হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ সময়েও এ বিষয়ে সরকারপক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একটি সামাজিক ব্যাধির নিরাময়কল্পে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াই তো দরকার ছিল।
কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি বা কেন হচ্ছে না, এর রহস্য বুঝে ওঠা দায়। কর্তৃপক্ষ কি চায় যে এ ধরনের সামাজিক অন্যায় দেশজুড়ে চলতে থাকুক? যা হোক এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে আইন কমিশনও সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ পাঠায়। তা সত্ত্বেও সরকারি পরিস্থিতির স্থির জলে কোনো ঢেউ ওঠেনি এবং ঘটনা ঘটেই চলেছে। এখন অবস্থা এমন যে কাগজ পড়াই অসহনীয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন নির্যাতিত বা হয়রানির শিকার কিশোরী ও তরুণীদের আত্মহননের মিছিল চলছে।
এ অবস্থায় আগেও লিখেছিলাম কিশোরী-তরুণীদের উদ্দেশে_অন্যায়ের বদলা যদি আত্মদানের পথ হয়ে ওঠে, তাহলে দুর্বৃত্তরা তো অন্যায়ে আরো উৎসাহিত হতে থাকবে। বরং এ ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা হওয়া উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো_তাতে অন্তত সমাজের কিছুসংখ্যক সচেতন মানুষকে কাছে পাওয়া যাবে। আত্মহনন সে পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। বেশ কয়েকটি কাগজে এ ধরনের লেখালেখির পরও দেখছি আত্মহননের সংখ্যা কমছে না। আমরা জানি এ ধরনের ঘটনা লাঞ্ছিতার দেহমনে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করে। তাই পরিণামে আত্মহত্যা। আর সে জন্যই এসব ক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের রয়েছে গুরুদায়িত্ব। তাঁদের পক্ষে দরকার নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ানো, তাকে সাহস, সমবেদনা ও সহযোগিতার আশ্বাস জানানো। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পথ নিতে দরকার লাঞ্ছিতা বা নির্যাতিতাকে উদ্বুদ্ধ করা। এ ব্যাপারে প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারই হতে পারে সর্বোত্তম মাধ্যম। কিন্তু কখনো এর বিপরীতটাই দেখা যায়।
অবস্থা যেখানে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমাদের মনে হয় দেনদরবারে অনেক সময়ের অপচয় ঘটেছে। এখন সময় এসেছে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের, সংঘবদ্ধভাবে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমাজের উল্লেখযোগ্য নারী-পুরুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে পথে নামা, আন্দোলনে নামা; তা না হলে অন্যায়ের প্রতিকার সুদূরপরাহত। শুধু ব্যক্তিক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, দরকার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় হয়ে ওঠা।
সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিকারের লক্ষ্য নিয়ে একটি সমন্বিত মঞ্চ গড়ে তুলতে মহিলা সংগঠন, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ছাত্রসংগঠনগুলো কি পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে পারে না? কাজটা কি এতই কঠিন? আমরা নিশ্চিত, এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের পরোক্ষ সমর্থন মিলবে। আইনজীবী সমিতিগুলোও কিন্তু এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে। কাউকে না কাউকে এ ক্ষেত্রে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে এগিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু সে কাজটাই হচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশে গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী_এককথায় প্রগতিশীল সংগঠনের তো অভাব নেই। মহিলা সমিতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠনের সংখ্যা অনেক। তাদের সবার প্রতি আমাদের আহ্বান, আর বসে থাকা নয়, এতগুলো প্রাণের অপচয় ঘটার পর এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার সময় পার হয়ে গেছে, এখন সক্রিয় হওয়ার পালা। এ ব্যাপারে কাউকে প্রাথমিক উদ্যোগ নিতে হবে। সে উদ্যোগ নিক না কেন মহিলা সংগঠনের কোনো একটি। একবার পাথর গড়ানো শুরু হলে অনেক পাথর গড়াবে, গড়াতেই থাকবে। সে আওয়াজে সরকারের ঘুম ভাঙতেই হবে। তখন তাদের সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। আসুন না, সবাই মিলে সে চেষ্টার সূচনা ঘটাই। হতভাগ্য মেয়েগুলোকে অবাঞ্ছিত পরিণাম থেকে রক্ষা করি, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো লাঞ্ছিত মেয়ে জীবন অপচয়ের পথ বেছে না নেয়। নামি সংগীতজ্ঞ একাত্তরে গেয়েছিলেন 'একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।' আসলে তো একটি নয়, অনেক অনেক ফুল অর্থাৎ অনেক অসহায়, নম্র, নিষ্পাপ প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধ। এ ক্ষেত্রেও দরকার হয়ে পড়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ যুদ্ধ_অসহায় প্রাণগুলোকে বাঁচানোর জন্য। এ যুদ্ধ গোলাবারুদের নয়, এ যুদ্ধ সুদৃঢ় প্রতিবাদী আন্দোলনের।
এই লেখার শেষ পর্যায়ে একটি খবর দিই, আত্মহননেও রক্ষা নেই_পুরো পরিবারকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা এখন এমনই এক পর্যায়ে পেঁৗছেছে। ৯ অক্টোবর একটি খবরে প্রকাশ, 'সিমির আত্মহনন মামলার আসামিরা সবাই এখন জামিনে মুক্ত।' সিমির বাড়ি থেকে পুলিশি পাহারা উঠিয়ে নেওয়ার পর তাদের বাড়িতে তিন দফা আগুন দেওয়া হয়েছে। বাড়ির প্রধান বৈদ্যুতিক লাইনে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরা।
এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি আরেকটু তৎপর হতে পারে না? পারে না ১০ বছর ধরে চলতে থাকা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে? এমনকি বর্তমান কর্মকাণ্ডের জন্য নতুন করে আসামিদের মামলা দায়ের করে নির্যাতিত পরিবারটিকে রক্ষা করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে একজন মহিলা হয়েও নারী নির্যাতনের বিষয়গুলোকে কি বিশেষ গুরুত্বে গ্রহণ করতে পারেন না? পারেন না কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিতে?
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, কবি,
প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী
৯-১০-২০১১

No comments

Powered by Blogger.