বিশেষ রচনা-অসাম্প্রদায়িক মননের প্রতীক অধ্যাপক কবীর চৌধুরী by নয়ন রহমান

কেবারে আচম্বিতে চলে গেলেন আমাদের একান্ত আপনজন, অনুবাদ-সাহিত্যের প্রতিভূ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। বাংলাদেশের আকাশ থেকে যেন একটা নক্ষত্রের পতন হলো স্বাধীনতার ৪০ বছরের বিজয় দিবসের এই মাসে। সদাহাস্য অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর বিদুষী স্ত্রী মেহের কবীর আপার সৌজন্যে। মেহের কবীর আপা তখন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের অন্যতম উপদেষ্টা। অসুস্থ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি লেখিকা সংঘের


সভায় আসতেন। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে আমি স্যার নয়, ভাই সম্বোধন করতাম। প্রচণ্ডভাবে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের অধিকারী অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আমার নামটিকেও অসাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত করে অনেকের কৌতূহল নিবৃত্ত করেছিলেন। দেখা হলেই একটা মিষ্টি হাসি উপহার পেতাম। তাঁকে কখনো গুরুগম্ভীর বা বিমর্ষ দেখিনি। হাঁটতেন ঋজু ভঙ্গিতে। বক্তব্য দিতেন সরসভাবে, দৃঢ় কণ্ঠে।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর অনুবাদ-সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। 'প্রাঙ্গণ' পত্রিকার সম্পাদক রায়হানা হোসেনের সৌজন্যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী অনূদিত উপন্যাস-গল্প প্রায় প্রতি সংখ্যায় পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। রায়হানা হোসেন বললেন, "স্যারের কাছে গল্প চেয়ে আমরা কখনো বিমুখ হইনি। গল্পটি লেখা হলেই বলতেন, 'শেষ হয়েছে, নিয়ে যাও তাড়াতাড়ি'।" তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে সম্যক পরিচিত হয়ে মনে হয়েছে তিনি জ্ঞানের সমুদ্র। সাবলীল ও আক্ষরিক অনুবাদ।
অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাঁর প্রাঞ্জল বক্তৃতা শুনেছি। বাংলা একাডেমীর বার্ষিক সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি ও প্রাণবন্ত বক্তব্য আমাদের সবাইকে আনন্দ দিত।
বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের প্রতিও তাঁর সুদৃষ্টি ছিল। আমরা যখনই আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি, সানন্দচিত্তে তিনি আমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন।
২০০৯ সালে তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে অপারগতা প্রকাশ করলেন। আমরাও নাছোড়বান্দা। অল্প সময়ের জন্য আসার অনুরোধ জানালে সম্মত হলেন তিনি।
তাঁকে অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা এবং পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো ঝর্ণা দাশপুরকায়স্থকে। ঝর্ণা লেখিকা সংঘের অন্যতম সহসভাপতি। আমি সে সময় সংঘের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। একটু বিলম্বেই তিনি উপস্থিত হলেন। হল ভর্তি শ্রোতা-দর্শক তাঁকে অভিবাদন জানালে তিনি হাত নেড়ে হাসিমুখে সবাইকে সম্ভাষণ জ্ঞাপন করলেন। দেখলাম, সত্যি তাঁর শরীর ভালো নেই। কিন্তু তাঁকে খুব প্রাণবন্ত মনে হয়েছিল। হাসিটি ধরা ছিল দুই ঠোঁটে। অসুস্থতা সত্ত্বেও সেদিন অধ্যাপক চৌধুরী বেশ খানিকটা সময় আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। মঞ্চ আলোকিত করে তিনি বসেছিলেন। মঞ্চ আলোকিত বলছি এ জন্য যে তিনি গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরিধান করে এসেছিলেন। আর তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভা তো ছিলই। এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আহমেদ কবীর এবং বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বেগম মমতাজ হোসেন।
প্রধান অতিথি অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর পাশে আমি বসেছিলাম কিছুটা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে। তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, 'শরীর এখন কেমন?' তিনি জানতেন স্ট্রোকের ধাক্কায় আমার জীবনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সযত্ন পরিচর্যায় উঠে দাঁড়িয়েছি মাত্র। বললাম, 'ভালো আছি।'
তিনি বললেন, 'সাহস হারাবে না। ভালো আছি, এটা সব সময় মনে রাখবে।'
খুব দ্রুত পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ করা হলো। সেইবার 'লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক' পেয়েছিলেন সুসাহিত্যিক খালেক বিন জয়েনউদ্দিন এবং বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রায়হানা হোসেন।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে লেখিকা সংঘের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আশা ব্যক্ত করেন। তাঁর বক্তব্যের মূলকথাই ছিল, অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ধারক ও বাহক হয়ে মুক্ত মন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির কাজে নিমগ্ন থাকতে হবে। নারী-পুরুষ বিভাজন কাম্য নয়। ভালো কাজের মূল্যায়ন যথার্থ হতে হবে। বলেছিলেন, 'লেখনী যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনায় ঝলসে ওঠে। নারীর ত্যাগ, নারীর অর্জন কোনো অংশে কম নয়। সমান সমান না, অনেক অনেক বেশি।' এ কথায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা হর্ষধ্বনি করে করতালিতে মুখর করে তুলেছিল হলটি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান অনেক বেশি। তাঁর কথায় আমাদের মনও আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল।
আমরা অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সাক্ষাৎ আর পাব না এই বাস্তব জগতে। তিনি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে।
বিভিন্ন সভায়, বিশেষ করে, বাংলা একাডেমীর বার্ষিক সম্মেলনে আমরা তাঁর দর্শন থেকে বঞ্চিত হব। আমাদের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হবে। কিন্তু সারা জীবন তিনি যে আদর্শের কথা দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, সেই আদর্শের পথ ধরে আমরা চলতে পারলে তাঁর অনিঃশেষ উচ্চ প্রত্যাশার প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হবে।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর চিরবিদায়ের খবর কবি বেগম রাজিয়া হোসাইনের কাছে শুনে বিচলিত মনে 'মৃত্যু' (ফজলুল আলম অনূদিত) শিরোনামের বইটি হাতে নিলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান।' আমরা কেউ কি মানতে পারি_মৃত্যু প্রিয়? তবে এ কথা তো ঠিক যে মৃত্যু জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এই পরিণতি মেনে নিতেই হয়।
তবে মৃত্যু মহীয়ান হয় ব্যক্তির উদ্যমী কর্মের মধ্যে। সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে। এদিক দিয়ে বিচার করলে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মৃত্যু এক মহৎ প্রস্থান বলা যায়। তিনি সারা জীবন উদ্যমী ছিলেন। সৃষ্টিশীল কাজে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর কাজের পেছনে ছিল শুভ চিন্তা, শুভ উদ্দেশ্য।
কেবল সাহিত্য রচনা করেই তিনি তাঁর উদ্যম নিঃশেষ করেননি। দেশ ও দশের উন্নতির জন্য মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তাঁর স্বচ্ছ চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে তিনি নিরবধি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। মানুষে-মানুষে নানা বিভেদ দূর করার জন্য তিনি যেমন কর্মযজ্ঞে নিবিষ্ট ছিলেন, তেমনি সঠিক বাক্যটি উচ্চারণে তাঁর কণ্ঠ এতটুকু কাঁপেনি। অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর কণ্ঠ ও লেখনী সমানভাবে ছিল সোচ্চার। এ জন্যই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন অবলীলায়।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর দেশপ্রেম ও সাহিত্যপ্রেমের কোনো কমতি ছিল না। দেশি সাহিত্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে বিদেশি সাহিত্য অনুবাদের মহৎ কাজটি তিনি নিরবধি করে গেছেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মস্তিষ্ক ক্রিয়াশীল ছিল, হৃদয় জাগ্রত ছিল। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব। বয়সের ভারে শরীর কিছুটা ন্যুব্জ হয়েছিল সত্যি, কিন্তু চিন্তাধারা ছিল স্বচ্ছ_স্ফটিকের মতো। যে রাতের শেষ প্রহরে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান, সেই রাতের মধ্য প্রহরেও পরিকল্পনা করেছিলেন, সূর্যোদয়ের পরই তিনি কোন গ্রন্থটির অনুবাদের জন্য কাগজ-কলম নিয়ে বসবেন। এমনটি কারো জীবনে সচরাচর দেখা যায় কি? এটাও তাঁর জীবনের একটা ব্যতিক্রমী দিক।
শেষযাত্রাটি সহজ-সরলভাবে সম্পন্ন করার নির্দেশ তিনি লিখিতভাবে রেখে গেছেন। অতিসত্বর কাছের মসজিদে জানাজা এবং সাধারণের মতো দাফন করার বিষয়টিও ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও মানবিক। এখানে তিনি হার মানিয়েছেন অনেককে।
খুবই সাধারণভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর পারিবারিক জীবনও উন্নতমানের এবং মাধুর্যে পরিপূর্ণ ছিল। আমাদের প্রিয় মেহের কবীর আপা ডায়াবেটিসের কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন অনেক দিন আগে। তাঁর প্রতি খুবই মনোযোগী ও যত্নশীল ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। বিশেষ করে মেহের আপাকে সময়মতো ওষুধ সেবন এবং খাবারের বিষয়টি তিনি নিজেই দেখতেন। তিনি সুকন্যার পিতা হিসেবে সর্বজনবিদিত ছিলেন। তাঁর কন্যারা তাঁরই আদর্শে মানুষ হয়েছেন এবং জনকল্যাণে নিবেদিত আছেন।
মর্যাদপূর্ণভাবেই অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর অন্তিম যাত্রা সম্পন্ন হয়েছে। এই মহান-উদার-বরেণ্য সহিত্যিককে আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। এই মুক্ত মনের মানুষটির আত্মা দেহমুক্ত হয়ে অসীমে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি

No comments

Powered by Blogger.