ইউরোপের জানালা-ইউরো-সংকট আর সম্ভাবনার এক যুগ by সরাফ আহমেদ
বড়দিন উৎসবের জন্য প্রতিবছরের মতো এবারো ইউরোপের দেশে দেশে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। বাড়িঘর, আঙিনা, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, বাজার-কেন্দ্র সর্বত্র আলো ঝলমলে এলাহী অবস্থা। কিন্তু এই আলো ঝলমলে অবস্থা ইউরোপীয় অর্থনীতির নেই। কয়েক মাস আগে থেকে ইউরোর মুদ্রামান নিয়ে যে সংকট চলেছে, তার সমাধান করতে হিমশিম খাচ্ছেন রাজনীতিকেরা। এই সংকটকে ঘিরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে গ্রিস, ইতালি আর স্পেনে।
১২ বছর আগে, ১৯৯৯ সালে ইউরো মুদ্রা চালুর শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ১১টি দেশ—বেলজিয়াম, জার্মান, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, আয়ারলান্ড, ইতালি, লুক্সেমবুর্গ, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন আর অষ্ট্রিয়া যুক্ত হয়েছিল। পরে ছয়টি দেশ—গ্রিস, মাল্টা, স্ল্লোভাকিয়া, সাইপ্রাস স্লোভেনিয়া, এস্টল্যান্ড—সব মিলিয়ে ১৭টি দেশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের পর এত বড় অর্থনৈতিক সংকট আর দেখা যায়নি। অবশ্য যুদ্ধপূর্ব ১৯৩০ সাল বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট ও পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে। ইউরো মুদ্রা চালু হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিকে আরও স্বাবলম্বী ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিশ্বমানের মুদ্রা ব্যবস্থাসহ ইউরো মুদ্রাভুক্ত দেশগুলো নিজেদের আমদানি-রপ্তানিকে আরও সহজ ও অর্থবহ করার জন্য।
১৯৩০ সালের এবং এর পরবর্তী সংকট ছিল উৎপাদন সেক্টর থেকে; কিন্তু বর্তমান সংকট ফিন্যান্স সেক্টর থেকে। আর এই সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে কিছু দেশের সরকারের অদূরদর্শী নীতি, ঘাটতি বাজেট ও প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কার না করা।
মাত্রাতিরিক্ত ঋণের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি চালানোর প্রবণতা যে কিছু দেশকে দেউলিয়ার শেষ সীমায় নিয়ে গেছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ইউরো জোনের আপাত দুর্বল দেশ আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি,পর্তুগালের মতো দেশগুলো।
যখন কোনো দেশে শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার চাকরি সুরক্ষা, উৎপাদন ব্যবস্থার এবং লভ্যাংশের কিছুটা হলেও প্রাপ্তি থাকে, তখন অধিকারপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে। আর এভাবেই মুক্তবাজার অর্থনীতি সফল হয়।
জার্মানিতে এ ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজার কাঠামো ভালোই চলছিল এবং এই মডেল ইউরোপের আরও কিছু দেশ গ্রহণ করেছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন—আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি—এসব সেবামূলক গ্যারান্টি এই পুঁজিপতি দেশগুলোতে আছে, এটা একধরনের সামাজিক গ্যারান্টি।
আশির দশকের পর শিল্পায়নে প্রতিযোগিতায় অতিরিক্ত মুনাফা লাভ, অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির জন্য অনেক দেশেই সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজার কাঠামো অনেকটাই ছেঁটে ফেলা হয়। শ্রমিক সুরক্ষা আইন আলগা হয়ে যায়, অর্থাৎ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ক্রমেই কমতে থাকে। বাজারব্যবস্থায় অদৃশ্য হাতের কারসাজি বা স্বার্থ-দ্বন্দ্ব সব সময় যে পণ্যমূল্যের ভারসাম্য আসে না, আজকের বিশ্ব বা ইউরোপীয় অর্থনীতির সংকট তার প্রমাণ।
জার্মানিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বড় সমালোচক বারলিন মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলমার আল্টভাটার, যিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে বেশ কিছু বই লিখেছেন। তিনি জার্মানির বনেদি সাপ্তাহিকদ্য জাইট-এ (উওঊ তঊওঞ) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পুঁজিবাদী কৌশলের মারপ্যাঁচে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের এখনই সময় এই কৌশল থেকে মুক্ত হয়ে আসার।’ তিনি বলেছেন, বিখ্যাত জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী রোসা লুক্সেমবুর্গ বলেছিলেন, পুঁজিবাদ সেই সময় ভেঙে পড়বে, যখন সূর্য আমাদের এই ধরণীতে পতিত হবে। আমি তা বলি না। বলি, পুঁজিবাদব্যবস্থা বহুমুখী এবং পরিবর্তনযোগ্য (উুহধসরপ ধহফ ঋষবীধনষব)। ফলে বিগত চার-পাঁচ শ বছর থেকে এই ব্যবস্থা টিকে রয়েছে। তার মানে এই নয় যে এই ব্যবস্থা আরও বহু বছর টিকে থাকবে। তাই ভয়াবহ পুঁজিবাজার এবং শিল্পবাজারের ক্ষমতার রাস টেনে না ধরলে সংকট আরও প্রবল হবে।
ইউরোপে ইউরো মুদ্রাকে পুঁজি করে, পুঁজিবাদের স্বত্বভোগকারী ও পুঁজিবাজার লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীসহ শ্রমিক, সাধারণ নাগরিক বা মিডিয়া সর্বত্রই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, শ্রমিক, সাধারণ নাগরিক পথে নেমে আসছেন। শুধু সংবাদপত্র বা নাগরিক আন্দোলনের বিতর্কই নয়, ইউরোপের রাজনৈতিক দলগুলো দলে এবং সংসদে নিয়মিত বিতর্ক করছে, আলোচনা হচ্ছে কীভাবে ভবিষ্যতে করনীতিতে আইন করে শ্রমজীবীদের সংকট মোকাবিলা করে সংকট সৃষ্টিকারীদের পুঁজির লাগাম টেনে ধরা যায়।
অনেকের ধারণা, সমাজতন্ত্র হয়তো জার্মানিতে ফিরবে না, তবে মুক্তবাজার ও রাষ্ট্রর মিশ্র অর্থনীতিকে সঙ্গে নিয়েই দেশ চালাতে হবে তা রাজনীতিবিদেরা টের পাচ্ছেন, বা বলা যায় রাজনীতিবিদেরা সমাজের নানা শ্রম আর পেশার মানুষের এই আলোচনাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যতিক্রম যে নেয় তা বলা যাবে না, এই ইউরোকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার নানা পালাবদল বিগত ছয় মাসেই ঘটছে। স্লোভাকিয়ার সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার করতে হয়েছে। স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে, বিরোধী দলের চাপের মুখে আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হতে হয়েছেন। একই ঘটনা আয়ারল্যান্ডেও। ক্ষমতার শরিক গ্রিন দল কোয়ালিশন থেকে বের হওয়ার ফলে আগামী মার্চে নতুন নির্বাচন দিতে হচ্ছে। স্পেনে হাতবদল হয়ে ক্ষমতা এসেছে রক্ষণশীলদের হাতে। আর গ্রিস ও ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।
ইউরোপে ইউরো মুদ্রা চালুর পর থেকে বিগত ১২ বছরে সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো বজায় রেখেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ প্রয়োজনীয় সংস্কার করেছে, কিন্তু সেই ধরনের সংস্কার আয়ারল্যান্ড, গ্রিস বা ইতালিতে হয়নি ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শিতার কারণে।
যেমন—গ্রিস বা ইতালিতে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময়সীমা ৫৫ বছর এবং অবসরের পর ওই ব্যক্তি মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা আজীবন অবসর ভাতার ২৫ শতাংশ পেতে থাকবেন। এ ছাড়া মাথা ভারী প্রসাশন, দুর্নীতি, বছরের পর বছর ভারসাম্যহীন বাজেট দিয়ে দেশ চালাতে গিয়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে আর পরবর্তী সময়ে দেশগুলো ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিকভাবে শক্তিধর দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ সংকট উত্তরণের প্যাকেজ জোগাতে ইউরো মুদ্রাভুক্ত দুর্বল দেশগুলো অনেক আগে থেকেই কৃচ্ছসাধনের কথা বলছে। অবশেষে আয়ারল্যান্ড, গ্রিস বা ইতালির সংসদ তা অনুমোদন করেছে।
ইউরোপের দেশে দেশে এই সংকটের মুখে ইউরো মুদ্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে ইউরো জোনভুক্ত ১৭টি দেশ মিলে ইউরো বন্ড চালুর কথা উঠেছিল দুর্বল দেশগুলোর পক্ষ থেকে। অর্থাৎ কোনো দেশের পৃথক বন্ড নয়, গোটা ইউরো এলাকার জন্য একক বন্ড; যার দায়দায়িত্ব বহন করবে ইউরো জোনভুক্ত ১৭টি দেশ। এতে দুর্বল দেশগুলোর অর্থনৈতিক দুর্বলতা অনেকটাই কেটে যেত। কিন্তু জার্মানসহ আরও কিছু দেশের জনগণ এবং সেসব দেশের সংসদ এই ইউরো বন্ড চালুর বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি, দুর্বল দেশগুলোর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, অদক্ষতার ভাগীদার অন্য দেশগুলোর করদাতারা হতে পারেন না।
ইউরো-সংকট ঘিরে ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা নিরসনে ৯ ডিসেম্বর ব্রাসেলসে, ২৭ জাতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে ইউরোপীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাতে, সর্বশেষ লিসাবন চুক্তির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রস্তাব পেশ করে। আগামীতে ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলোতে সংকট থাকা পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার বৈঠকে বসা, নিয়ন্ত্রিতভাবে দেশগুলোর জাতীয় বাজেটের সমন্বয়, অধিক কৃচ্ছ্র সাধন, ইউরো ব্যাংকের হাতে অধিক ক্ষমতা দেওয়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ২৭ দেশের মধ্য ১৭টি ইউরো জোনভুক্ত দেশ থাকলেও বাদ বাকি অন্য ১০ সদস্য এই বৈঠকে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে এবং ভোটাভুটিতে অংশ গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। বৈঠকে যুক্তরাজ্য ইউরো জোনভুক্ত দেশ না হয়েও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো প্রদান করে। এরপরও ১৭টি ইউরো জোনভুক্ত দেশ তাদের সংকট নিরসনে জার্মান ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। ফলে আগামীতে অর্থনৈতিক সংস্কার ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউরো মুদ্রাকে শক্তিশালী এবং এই সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে কয়েক সপ্তাহজুড়ে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজি একাধিকবার বৈঠক করে এই প্রস্তাব তৈরি করেছেন বলে এ নতুন প্রস্তাবনাকে বলা হচ্ছে ইউরোপীয় অর্থনীতি বাঁচাতে ‘মেরকোজি পরিকাল্পনা’।
ইউরো মুদ্রার ১২ বছর পূর্তিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও সুদৃঢ় করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর চেষ্টা এই মহাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সরাফ আহমেদ, প্রথম আলো, জার্মান প্রতিনিধি।
Sharaf.ahmed¦gmx.net
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের পর এত বড় অর্থনৈতিক সংকট আর দেখা যায়নি। অবশ্য যুদ্ধপূর্ব ১৯৩০ সাল বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট ও পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে। ইউরো মুদ্রা চালু হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিকে আরও স্বাবলম্বী ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিশ্বমানের মুদ্রা ব্যবস্থাসহ ইউরো মুদ্রাভুক্ত দেশগুলো নিজেদের আমদানি-রপ্তানিকে আরও সহজ ও অর্থবহ করার জন্য।
১৯৩০ সালের এবং এর পরবর্তী সংকট ছিল উৎপাদন সেক্টর থেকে; কিন্তু বর্তমান সংকট ফিন্যান্স সেক্টর থেকে। আর এই সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে কিছু দেশের সরকারের অদূরদর্শী নীতি, ঘাটতি বাজেট ও প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কার না করা।
মাত্রাতিরিক্ত ঋণের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি চালানোর প্রবণতা যে কিছু দেশকে দেউলিয়ার শেষ সীমায় নিয়ে গেছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ইউরো জোনের আপাত দুর্বল দেশ আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি,পর্তুগালের মতো দেশগুলো।
যখন কোনো দেশে শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার চাকরি সুরক্ষা, উৎপাদন ব্যবস্থার এবং লভ্যাংশের কিছুটা হলেও প্রাপ্তি থাকে, তখন অধিকারপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে। আর এভাবেই মুক্তবাজার অর্থনীতি সফল হয়।
জার্মানিতে এ ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজার কাঠামো ভালোই চলছিল এবং এই মডেল ইউরোপের আরও কিছু দেশ গ্রহণ করেছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন—আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি—এসব সেবামূলক গ্যারান্টি এই পুঁজিপতি দেশগুলোতে আছে, এটা একধরনের সামাজিক গ্যারান্টি।
আশির দশকের পর শিল্পায়নে প্রতিযোগিতায় অতিরিক্ত মুনাফা লাভ, অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির জন্য অনেক দেশেই সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজার কাঠামো অনেকটাই ছেঁটে ফেলা হয়। শ্রমিক সুরক্ষা আইন আলগা হয়ে যায়, অর্থাৎ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ক্রমেই কমতে থাকে। বাজারব্যবস্থায় অদৃশ্য হাতের কারসাজি বা স্বার্থ-দ্বন্দ্ব সব সময় যে পণ্যমূল্যের ভারসাম্য আসে না, আজকের বিশ্ব বা ইউরোপীয় অর্থনীতির সংকট তার প্রমাণ।
জার্মানিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বড় সমালোচক বারলিন মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলমার আল্টভাটার, যিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে বেশ কিছু বই লিখেছেন। তিনি জার্মানির বনেদি সাপ্তাহিকদ্য জাইট-এ (উওঊ তঊওঞ) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পুঁজিবাদী কৌশলের মারপ্যাঁচে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের এখনই সময় এই কৌশল থেকে মুক্ত হয়ে আসার।’ তিনি বলেছেন, বিখ্যাত জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী রোসা লুক্সেমবুর্গ বলেছিলেন, পুঁজিবাদ সেই সময় ভেঙে পড়বে, যখন সূর্য আমাদের এই ধরণীতে পতিত হবে। আমি তা বলি না। বলি, পুঁজিবাদব্যবস্থা বহুমুখী এবং পরিবর্তনযোগ্য (উুহধসরপ ধহফ ঋষবীধনষব)। ফলে বিগত চার-পাঁচ শ বছর থেকে এই ব্যবস্থা টিকে রয়েছে। তার মানে এই নয় যে এই ব্যবস্থা আরও বহু বছর টিকে থাকবে। তাই ভয়াবহ পুঁজিবাজার এবং শিল্পবাজারের ক্ষমতার রাস টেনে না ধরলে সংকট আরও প্রবল হবে।
ইউরোপে ইউরো মুদ্রাকে পুঁজি করে, পুঁজিবাদের স্বত্বভোগকারী ও পুঁজিবাজার লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীসহ শ্রমিক, সাধারণ নাগরিক বা মিডিয়া সর্বত্রই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, শ্রমিক, সাধারণ নাগরিক পথে নেমে আসছেন। শুধু সংবাদপত্র বা নাগরিক আন্দোলনের বিতর্কই নয়, ইউরোপের রাজনৈতিক দলগুলো দলে এবং সংসদে নিয়মিত বিতর্ক করছে, আলোচনা হচ্ছে কীভাবে ভবিষ্যতে করনীতিতে আইন করে শ্রমজীবীদের সংকট মোকাবিলা করে সংকট সৃষ্টিকারীদের পুঁজির লাগাম টেনে ধরা যায়।
অনেকের ধারণা, সমাজতন্ত্র হয়তো জার্মানিতে ফিরবে না, তবে মুক্তবাজার ও রাষ্ট্রর মিশ্র অর্থনীতিকে সঙ্গে নিয়েই দেশ চালাতে হবে তা রাজনীতিবিদেরা টের পাচ্ছেন, বা বলা যায় রাজনীতিবিদেরা সমাজের নানা শ্রম আর পেশার মানুষের এই আলোচনাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যতিক্রম যে নেয় তা বলা যাবে না, এই ইউরোকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার নানা পালাবদল বিগত ছয় মাসেই ঘটছে। স্লোভাকিয়ার সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার করতে হয়েছে। স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে, বিরোধী দলের চাপের মুখে আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হতে হয়েছেন। একই ঘটনা আয়ারল্যান্ডেও। ক্ষমতার শরিক গ্রিন দল কোয়ালিশন থেকে বের হওয়ার ফলে আগামী মার্চে নতুন নির্বাচন দিতে হচ্ছে। স্পেনে হাতবদল হয়ে ক্ষমতা এসেছে রক্ষণশীলদের হাতে। আর গ্রিস ও ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।
ইউরোপে ইউরো মুদ্রা চালুর পর থেকে বিগত ১২ বছরে সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো বজায় রেখেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ প্রয়োজনীয় সংস্কার করেছে, কিন্তু সেই ধরনের সংস্কার আয়ারল্যান্ড, গ্রিস বা ইতালিতে হয়নি ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শিতার কারণে।
যেমন—গ্রিস বা ইতালিতে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময়সীমা ৫৫ বছর এবং অবসরের পর ওই ব্যক্তি মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা আজীবন অবসর ভাতার ২৫ শতাংশ পেতে থাকবেন। এ ছাড়া মাথা ভারী প্রসাশন, দুর্নীতি, বছরের পর বছর ভারসাম্যহীন বাজেট দিয়ে দেশ চালাতে গিয়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে আর পরবর্তী সময়ে দেশগুলো ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিকভাবে শক্তিধর দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ সংকট উত্তরণের প্যাকেজ জোগাতে ইউরো মুদ্রাভুক্ত দুর্বল দেশগুলো অনেক আগে থেকেই কৃচ্ছসাধনের কথা বলছে। অবশেষে আয়ারল্যান্ড, গ্রিস বা ইতালির সংসদ তা অনুমোদন করেছে।
ইউরোপের দেশে দেশে এই সংকটের মুখে ইউরো মুদ্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে ইউরো জোনভুক্ত ১৭টি দেশ মিলে ইউরো বন্ড চালুর কথা উঠেছিল দুর্বল দেশগুলোর পক্ষ থেকে। অর্থাৎ কোনো দেশের পৃথক বন্ড নয়, গোটা ইউরো এলাকার জন্য একক বন্ড; যার দায়দায়িত্ব বহন করবে ইউরো জোনভুক্ত ১৭টি দেশ। এতে দুর্বল দেশগুলোর অর্থনৈতিক দুর্বলতা অনেকটাই কেটে যেত। কিন্তু জার্মানসহ আরও কিছু দেশের জনগণ এবং সেসব দেশের সংসদ এই ইউরো বন্ড চালুর বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি, দুর্বল দেশগুলোর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, অদক্ষতার ভাগীদার অন্য দেশগুলোর করদাতারা হতে পারেন না।
ইউরো-সংকট ঘিরে ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা নিরসনে ৯ ডিসেম্বর ব্রাসেলসে, ২৭ জাতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে ইউরোপীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাতে, সর্বশেষ লিসাবন চুক্তির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রস্তাব পেশ করে। আগামীতে ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলোতে সংকট থাকা পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার বৈঠকে বসা, নিয়ন্ত্রিতভাবে দেশগুলোর জাতীয় বাজেটের সমন্বয়, অধিক কৃচ্ছ্র সাধন, ইউরো ব্যাংকের হাতে অধিক ক্ষমতা দেওয়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ২৭ দেশের মধ্য ১৭টি ইউরো জোনভুক্ত দেশ থাকলেও বাদ বাকি অন্য ১০ সদস্য এই বৈঠকে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে এবং ভোটাভুটিতে অংশ গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। বৈঠকে যুক্তরাজ্য ইউরো জোনভুক্ত দেশ না হয়েও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো প্রদান করে। এরপরও ১৭টি ইউরো জোনভুক্ত দেশ তাদের সংকট নিরসনে জার্মান ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। ফলে আগামীতে অর্থনৈতিক সংস্কার ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউরো মুদ্রাকে শক্তিশালী এবং এই সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে কয়েক সপ্তাহজুড়ে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজি একাধিকবার বৈঠক করে এই প্রস্তাব তৈরি করেছেন বলে এ নতুন প্রস্তাবনাকে বলা হচ্ছে ইউরোপীয় অর্থনীতি বাঁচাতে ‘মেরকোজি পরিকাল্পনা’।
ইউরো মুদ্রার ১২ বছর পূর্তিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও সুদৃঢ় করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর চেষ্টা এই মহাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সরাফ আহমেদ, প্রথম আলো, জার্মান প্রতিনিধি।
Sharaf.ahmed¦gmx.net
No comments